বিএনপি-জামায়াতের ঐক্য ও সম্পর্কের আন্তরিকতায় ঘাটতি
প্রধান প্রতিবেদকঃ জামায়াত-বিএনপির সম্পর্ক এখন আর আগের মতো গাঁটছড়া বাঁধা নয়; বরং উভয় দলই ‘নিরাপদ দূরত্বে’ থাকার কৌশল বেছে নিয়েছে। কৌশলগত কারণে বলতে গেলে গা বাঁচিয়ে চলছে তারা।
সূত্র মতে, বিএনপি নেতাদের সাম্প্রতিক ভূমিকা ও বক্তব্যে জামায়াতের তৃণমূলে কিছুটা ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। অন্যদিকে নানামুখী চাপে সম্পর্ক নিয়ে বেশি ‘মাতামাতি’ করতে রাজি নয় বিএনপি। ২০ দলের কর্মসূচিতে জামায়াত যোগ দিচ্ছে ঠিকই কিন্তু আগের মতো ততটা খুশি মনে বা নিবেদিতপ্রাণে নয়। বরং সাম্প্রতিককালে সংঘটিত কয়েকটি ঘটনার পর এক ধরনের অসন্তুষ্টি নিয়ে তারা কর্মসূচিতে যাচ্ছে। মূলত চারটি কারণে জামায়াতের মধ্যে বিএনপির প্রতি অসন্তুষ্টির কথা জানা গেছে।
অন্যদিকে জামায়াত নেতা-কর্মীদের খুব বেশি সম্মানের সঙ্গে বিএনপির নেতৃত্ব দেখছেন না। বলা হচ্ছে, তাদের কারণেই সরকারের বাইরে থাকা অন্য দলগুলোকে নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গঠন করতে পারছে না বিএনপি। উপরন্তু জামায়াতের কারণে পশ্চিমা দেশগুলো বিএনপিকে এক ধরনের চাপের মুখে রেখেছে। সব মিলিয়ে ২০ দলীয় জোটের প্রধান শরিক দুই দলে এক ধরনের টানাপড়েন তৈরি হয়েছে। কিন্তু সরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে পরিস্থিতিটা এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে, জামায়াতকে ছাড়তে পারছে না বিএনপি, আবার জামায়াতও বিএনপিকে ছেড়ে কী পাবে এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ গত কয়েক বছরের আন্দোলনে জামায়াতের যে পরিমাণ লোকবল ক্ষয় এবং সাংগঠনিক ক্ষতি হয়েছে, তাতে শীর্ষ পর্যায়ে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করতে চাইলেও দলের তৃণমূল মেনে নেবে না বলে মনে করা হচ্ছে। এ ছাড়া ভেতরে ভেতরে জামায়াতও জানে, বিএনপির কৌশল যতই থাকুক, আন্দোলনের মাঠে তাদের লাগবে।
সব মিলিয়ে জোট টিকে আছে বটে কিন্তু আগের মতো ঐক্য ও সম্পর্কের আন্তরিকতায় এক ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে, যদিও উভয় দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্ব সম্পর্কের এ টানাপড়েনের কথা স্বীকার করতে নারাজ।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, জামায়াতের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কে কোনো ঘাটতি নেই। আন্দোলন প্রশ্নে ঐক্য অটুট আছে দাবি করে তিনি বলেন, আজ পর্যন্ত জামায়াত বা বিএনপির কোনো পর্যায়ের কোনো নেতা ঐক্যের বিরুদ্ধে কথা বলেননি। অথচ এক ধরনের মিডিয়া এ নিয়ে বিভ্রান্তিমূলক কল্পকাহিনী লিখে চলেছে।
পার্লামেন্টে (ইউপি) গৃহীত এক প্রস্তাবে জামায়াতকে দূরে রাখার জন্য বিএনপির প্রতি আহ্বানের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মির্জা ফখরুল বলেন, বিদেশিরা এ দেশে অনেক কিছু বলেন। কিন্তু বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে আজ পর্যন্ত কোনো বিদেশি জামায়াতকে ছাড়তে বলেননি। সম্প্রতি সফরে আসা ইউপি কমিটির প্রধান জিন ল্যাম্বার্টও বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে এ বিষয়ে কিছু বলেননি।
জামায়াতের নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমানের মতে, জামায়াত-বিএনপির সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন হয়নি। ঐক্য আগের মতো অটুট আছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে হয়তো দু-একজন নেতা দু-এক কথা বলতে পারেন। তাঁর মতে, রাজনীতিতে নানা কথা হয়। আবার অনেক সময় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কেউ কেউ অনুমান-নির্ভর কিছু বলতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই।
এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক মুজিবুর বলেন, সন্দেহ-অবিশ্বাস দলীয়ভাবে বিএনপি বা জামায়াতে নেই। জামায়াত কাউকে সন্দেহ করে না। আর ব্যক্তিপর্যায়ে সন্দেহ থাকলে তাতে দলীয় ঐক্যে ক্ষতি হয় না।
জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে আবদুল্লাহিল আমান আযমীর বিএনপিকে ‘অকৃতজ্ঞ’ বলা এবং ‘জামায়াতকে ছাড়া বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারবে না’ বলে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জামায়াতের এই নেতা বলেন, বাবার মৃত্যুর পর আযমী যা বলেছেন তা তাঁর আবেগ থেকে উৎসারিত। এর সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নেই। এ ঘটনায় দুই দলের রাজনীতিতে কোনো প্রভাবও পড়েনি বলে দাবি করেন তিনি।
চার কারণে অসন্তুষ্ট জামায়াত : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে বিএনপির অবস্থান ও এ ইস্যুতে জামায়াতের দেওয়া কর্মসূচিকে সমর্থন না দেওয়া, গত সেপ্টেম্বরে লন্ডনে তারেক রহমানের দেওয়া বক্তব্য এবং সর্বশেষ খালেদা জিয়ার বক্তব্য- এই চার কারণে বিএনপির প্রতি অসন্তুষ্ট জামায়াত।
বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী দলটির নেতারা বিএনপির কৌশলগত অবস্থান বুঝলেও এ ইস্যুতে একেবারে নীরবতা মানতে চাইছেন না। তাঁদের মতে, এই বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব বারবার স্বচ্ছতার প্রশ্ন তুললেও বিএনপি একেবারেই নিশ্চুপ। আগে তারা দু-একবার স্বচ্ছতা ও মানসম্মত বিচারের কথা বললেও সে বক্তব্যে এখন স্থির নেই। বরং বিএনপি গা বাঁচিয়ে চলছে বলে তাঁরা মনে করছেন। পাশাপাশি ফাঁসির আদেশ বা ফাঁসি কার্যকর করার সময় বিএনপির একেবারে নীরবতাকে ‘অস্বাভাবিক’ বলেও মনে করে দলটি।
এদিকে ‘ধর্মের ভিত্তিতে কোনো দল হতে পারে না’ বলে লন্ডনে তারেক রহমানের দেওয়া বক্তব্যেও অসন্তুষ্ট জামায়াত। দলটির নেতা-কর্মীদের মতে, সরকারবিরোধী আন্দোলনের এই ক্রান্তিকালে প্রধান শরিকদের উদ্দেশে এটা এক ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্য। আর এ ধরনের বক্তব্য তারেক রহমান কারও প্ররোচনায় দিয়ে থাকতে পারেন বলে তাঁদের মধ্যে সংশয় রয়েছে। এদিকে নভেম্বরে এক অনুষ্ঠানে ‘জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির নির্বাচনী ঐক্য আদর্শিক ঐক্য নয়’ বলে খালেদা জিয়ার দেওয়া বক্তব্যেরও তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করছে জামায়াত।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জামায়াতের মধ্যম পর্যায়ের এক নেতা বলেন, যে শক্তির প্ররোচনায় তারেক রহমান ওই বক্তব্য দিয়েছেন, সেই শক্তি জোট ভাঙতে চাইছে। কিন্তু তাদের ফাঁদে পড়লে বিএনপির সব যাবে।
এ প্রসঙ্গে জামায়াত নেতা মুজিবুর রহমানের অভিমত, আলাদা আদর্শের কথা বলা দোষের কিছু নয় বা এতে দুই দলের সম্পর্কেও প্রভাব পড়বে না। তিনি বলেন, বিএনপি একটি পৃথক দল। অন্যদিকে কোরআন-সুন্নাহর আলোকে জামায়াত দীন প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে। আবার আওয়ামী লীগ সরকারের অত্যাচার-নির্যাতনে আমরা দুই দলই বিপদে পড়েছি। সুতরাং সরকারবিরোধী আন্দোলন ইস্যুতে আবার আমরা ঐক্যবদ্ধ। তিনি বলেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সর্বশক্তি নিয়ে জামায়াত মাঠে থাকবে ইনশাআল্লাহ।
যে কারণে নিরাপদ দূরত্বে বিএনপি : যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতিসহ নানামুখী চাপে জামায়াতকে নিয়ে এক ধরনের অস্বস্তিতে পড়ে আছে বিএনপি। ফলে জামায়াত প্রশ্নে দলটি গা বাঁচিয়ে চলছে। দেশের ভেতরে একদিকে সুধীসমাজের বড় একটি অংশ এ প্রশ্নে বিএনপিকে তুলাধোনা করছে। পাশাপাশি সরকার ও জামায়াতকে জড়িয়ে প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, দুইয়ে মিলে এমন একটি ‘পারসেপশন’ দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে যে, বিএনপিই একটি স্বাধীনতাবিরোধী দল। ফলে বাধ্য হয়ে জামায়াতের ব্যাপারে তাদের সতর্ক থাকতে হচ্ছে।
অন্যদিকে বহু চেষ্টা ও উদ্যোগ সত্ত্বেও সিপিবি-বাসদ, জেএসডি, গণফোরাম ও কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগসহ সরকারের বাইরে থাকা কয়েকটি দল জামায়াতের কারণে বিএনপির সঙ্গে জোটে আসতে চাইছে না। তারা বলছে, জামায়াত থাকলে কৌশলগত জোট তারা বিএনপির সঙ্গে করবে না। কিন্তু ভোটের হিসাব-নিকাশ এবং আন্দোলনের শক্তি হিসেবে জামায়াতকে ছাড়তে পারছে না বিএনপি।
ওদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দু-একটি দেশ জামায়াতবিরোধী মনোভাব প্রকাশ্য করেছে। তারা বলছে, বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে হবে। অনেকের মতে, অপ্রকাশ্যভাবে জামায়াতের ব্যাপারে সবচেয়ে বড় আপত্তি রয়েছে ভারতের। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রস্তাব বিএনপি তেমন গুরুত্ব না দিলেও ভারতের ভূমিকাকে দলটি গুরুত্ব না দিয়ে পারছে না। দলটির অধিকাংশ নীতিনির্ধারক মনে করেন, ভারতের সমর্থন ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব নয়।
কমে গেছে যোগাযোগের মাধ্যম : সময়ের আবর্তে ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপি-জামায়াত জোটের সম্পর্ক এখন আর চোখে পড়ার মতো অবস্থায় নেই। কারণ যেসব নেতা দুই দলের সম্পর্কের যোগসূত্র রক্ষা করতেন তাঁদের অনেকেই মারা গেছেন এবং অন্যদের একাংশ রয়েছে জেলখানায়। অপর অংশ গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য রয়েছে আত্মগোপনে।
১৯৯৯ সালের নভেম্বরে জামায়াত-বিএনপির নেতৃত্বাধীন তৎকালীন চারদলীয় জোট গঠিত হওয়ার নেপথ্যে দুই দলের বেশ কয়েকজন নেতার ভূমিকা ছিল। জোট গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল সে সময় বিএনপি চেয়ারপারসনের তথ্য উপদেষ্টা প্রয়াত আনোয়ার জাহিদ এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের তৎকালীন ঐক্যবদ্ধ জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী নেতা কাজী জাফর আহমদের। বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া এবং তাঁর সমর্থকদের প্রচণ্ড বিরোধিতা সত্ত্বেও ওই সময় জামায়াতের পক্ষে তৎকালীন আমির গোলাম আযম, মহাসচিব মতিউর রহমান নিজামীসহ আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লাসহ অনেকে জোট গঠনে তৎপর ছিলেন; যাঁদের মধ্যে অনেকেই এখন মারা গেছেন, কেউ কেউ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে।
এদিকে বিএনপিতে জোট গঠন ও জোট রক্ষায় পরবর্তী সময়ে ভূমিকা পালন করেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, এম শামসুল ইসলামসহ আরো অনেকে। এর মধ্যে ড. মোশাররফ ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী কারাগারে এবং শামসুল ইসলাম অসুস্থ। অন্য নেতাদের সঙ্গে জামায়াতের সুসম্পর্ক নেই; নেই জামায়াতকে জোটে রাখার ব্যাপারে তাঁদের কোনো ভূমিকাও। ফলে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক এখন অনেকটাই খালেদা জিয়া-নির্ভর হয়ে পড়েছে।