মানবতাবিরোধী অপরাধে কায়সারের ফাঁসি
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ জাতীয় পার্টির সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় হত্যা ধর্ষণসহ ১৪টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ তাকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন।
কায়সারের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগের বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। এর মধ্যে ৪ ও ১৫ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
১৪ অভিযোগ প্রমাণিত, সাতটিতে ফাঁসি
অভিযোগ-১: ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল বেলা দেড়টা থেকে বিকেল ৩টার মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া (তৎকালীণ কুমিল্লা মহকুমা) সদরের পুলিশ ফাঁড়ি ও ইসলামপুর গ্রামের কাজীবাড়িতে শাহজাহান চেয়ারম্যানকে হত্যা, নায়েব আলী নামের একজনকে জখম ও লুটপাট করে কায়সার ও তার লোকজন। (যাবজ্জীবন কারাদণ্ড)
অভিযোগ-২: একই দিনে হবিগঞ্জ জেলার (তৎকালীন মহকুমা) মাধবপুর বাজারের পশ্চিমাংশ ও পার্শ্ববর্তী কাটিয়ারায় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে সৈয়দ কায়সার ও তার লোকজন। এ সময় কামিনী রায়, বিনোদ বিহারী মোদক, শচীন্দ্র রায়, হীরেন্দ্র রায়, রতি বাবু, অহিদ হোসেন পাঠানের দোকানসহ প্রায় ১৫০টি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। (১০ বছর কারাদণ্ড)
অভিযোগ-৩: ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় হবিগঞ্জ জেলার (তৎকালীন মহকুমা) মাধবপুর থানার কৃষ্ণনগর গ্রামের অহিদ হোসেন পাঠান, চেরাগ আলী, জনাব আলী ও মধু সুইপারকে হত্যা করে কায়সার ও তার লোকজন। তাদের বাড়িঘরে লুটপাট করার পর আগুন দেয়া হয়। (ফাঁসি)
অভিযোগ-৪: প্রসিকিউশনের অভিযোগ অনুযায়ী, সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল হবিগঞ্জের মাধবপুর বাজারের উত্তর পূর্ব অংশে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় তারা পূর্ব মাধবপুরের আব্দুস সাত্তার, লালু মিয়া ও বরকত আলীকে হত্যা করে এবং কদর আলীকে জখম করে। (প্রমাণিত হয়নি)
অভিযোগ-৫: ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল দুপুর থেকে বিকেলের মধ্যে হবিগঞ্জ সদরের শায়েস্তাগঞ্জ খাদ্যগুদাম এবং শায়েস্তাগঞ্জ পুরান বাজারের রেলব্রিজ এলাকায় আব্দুল আজিজ, আব্দুল খালেক, রেজাউল করিম, আব্দুর রহমান এবং বড়বহুলা এলাকার আব্দুল আলী ওরফে গ্যাদা উল্লাহ, লেঞ্জাপাড়া এলাকার মাজত আলী ও তারা মিয়া চৌধুরীকে আটক করে নির্যাতনের পর হত্যা করে সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। (ফাঁসি)
অভিযোগ-৬: ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল সন্ধ্যার পর হবিগঞ্জ সদরের পুরানবাজার পয়েন্টে সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ এবিএম মহিউদ্দিনের বাড়িতে হামলা হয়। এছাড়া লস্করপুর রেল লাইনের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে সালেহ উদ্দিন আহমেদ এবং হীরেন্দ্র চন্দ্র রায়কে ধরে নিয়ে নির্যাতনের পর হত্যা করে সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। (ফাঁসি)
অভিযোগ-৭: সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল হবিগঞ্জ সদরের এনএনএ মোস্তফা আলীর বাড়িসহ ৪০/৫০টি বাড়িঘর, দোকানপাটে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। (৭ বছর কারাদণ্ড)
অভিযোগ-৮: মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১ মে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানার চাঁদপুর চা বাগানে সাঁওতাল নারী হীরামনিকে ধর্ষণ করে সৈয়দ কায়সারের বাহিনী। সৈয়দ কায়সার এ সাঁওতাল নারীকে ধর্ষণে সহায়তা করেছিলেন বলে অভিযোগ এনেছে প্রসিকিউশন। (ফাঁসি)
অভিযোগ-৯: ১৯৭১ সালের ১৫ মে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরের লোহাইদ এলাকার আব্দুল আজিজ, আব্দুল গফুর, জমির উদ্দিন, আজিম উদ্দিন, এতিমুনেছা, নূর আলী চৌধুরী, আলম চাঁনবিবি ও আব্দুল আলীকে হত্যা করে সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। এদিন আকরাম আলী চৌধুরী (বর্তমানে মৃত) নামে একজনকে জখমও করেন সৈয়দ কায়সার। (যাবজ্জীবন কারাদণ্ড)
অভিযোগ-১০: ওই বছরের ১৩ জুন হবিগঞ্জ সদর, মোকাম বাড়ি, শায়েস্তাগঞ্জ থানার আর অ্যান্ড এইচ ডাকবাংলো এবং মাধবপুর থানার শাহাজীবাজার এলাকার হামলা চালায় সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। এ সময় শাহ ফিরোজ আলী নামের একজনকে অপহরণের পর নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। সাবু মিয়া নামের আরেকজনকে অপহরণের পর চালানো হয় নির্যাতন। (ফাঁসি)
অভিযোগ-১১: ১৯৭১ সালের ২৩ জুন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার হরিপুর থানার নাসিরনগরের গোলাম রউফ মাস্টার ও তার পরিবারের লোকজনদের উপর নির্যাতন চালায় সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। এছাড়া গোলাম রউফ মাস্টারকে অপহরণ ও আটকের পর তার উপর নির্যাতন চলে। এক পর্যায়ে মুক্তিপণ আদায় করে তার বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। (১১ বছর কারাদণ্ড)
এছাড়া একই দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর থানার দয়াল গোবিন্দ রায় ওরফে বাদল কর্মকারের বাড়িতে হামলা চালায় সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। লুটপাটের পর ওই বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
অভিযোগ-১২: সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী অগাস্ট মাসের মাঝামাঝি কোনো একদিন হবিগঞ্জের মাধবপুর থানার বেলাঘর ও জগদীশপুর হাইস্কুল থেকে আতাব মিয়া, আইয়ুব মিয়া, মাজেদা বেগমকে অপহরণ করে। এক পর্যায়ে মাজেদাকে ধর্ষণ করা হয়। (ফাঁসি)
অভিযোগ-১৩: ১৯৭১ সালের ১৮ অগাস্ট হবিগঞ্জের নলুয়া চা বাগান থেকে মহিবুল্লাহ, আবদুস শহীদ, আকবর আলী, জাহির হোসেনকে অপহরণ করে নরপতিতে আব্দুস শাহীদের বাড়ি ও রাজেন্দ্র দত্তের বাড়িতে স্থানীয় শান্তি কমিটির কার্যালয় এবং কালাপুরের পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যায় সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। অপহৃতদের আটকে রেখে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়। (যাবজ্জীবন কারাদণ্ড)
অভিযোগ-১৪: ১৯৭১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জের মাধবপুরে সোনাই নদীর ব্রিজ এলাকা থেকে সিরাজ আলী, ওয়াহেদ আলী, আক্কাস আলী, আব্দুল ছাত্তারকে অপহরণ করে নিয়ে যায় সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। তাদের আটকে রেখে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়। (যাবজ্জীবন কারাদণ্ড)
অভিযোগ-১৫: অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি কোনো একদিন সন্ধ্যায় হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরে শালবন রঘুনন্দ পাহাড় এলাকায় শাহাপুর গ্রামের নাজিম উদ্দিনকে অপহরণের পর আটকে রেখে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। (প্রমাণিত হয়নি)
অভিযোগ-১৬: সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বর ব্রাহ্মণবড়িয়ার ভাটপাড়া থানার দাউরা, নিশ্চিন্তপুর, গুটমা, বুরুঙ্গা, চিতনা, নূরপুর, ফুলপুর, জেঠাগ্রাম, পাঠানিশা, কুলিতুণ্ডা, আন্দ্রাবহ, তিলপাড়া, কমলপুর, গঙ্গানগর, বাঘি, শ্যামপুর, কুয়ারপুর, নোয়াগাঁও, কুণ্ডা, লক্ষ্মীপুর, করগ্রাম গ্রামের ১০৮ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। (ফাঁসি)
উল্লেখ্য, গত ১১ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালে সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৮টি অভিযোগ দাখিল করেন প্রসিকিউশন। এর মধ্যে ১৬টি অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।
গত ১০ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের কাছে প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুমের নেতৃত্বে প্রসিকিউশন টিম কায়সারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন।
গত ১৫ মে বুধবার কায়সারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। এর পর ২১ মে মঙ্গলবার বিকেল পৌণে ৪টায় কায়সারকে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতাল থেকে গ্রেপ্তার করে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।