গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে বিএনপি নেতারা
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা হরতাল ঘিরে কঠোর অবস্থানে রয়েছে সরকার। কর্মসূচির আড়ালে নাশকতার আশঙ্কায় জোটের ‘সন্দেহভাজন’ নেতা-কর্মীদের তালিকা নিয়ে মাঠে নেমেছে আইনশৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনী। রাজধানীতে বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতার বাসায় অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে। রাজধানীর বাইরে আটক করা হয়েছে বিএনপি ও জোটের ১৭-১৮ জন নেতা-কর্মীকে। এ অবস্থায় গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপন করেছেন বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের বেশির ভাগ নেতা।
রাজধানীর বকশীবাজারে সংঘর্ষের পর গাজীপুরে খালেদা জিয়াকে সমাবেশ করতে না দেওয়ার প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল এবং গাজীপুরে হরতালের কর্মসূচি দিয়েছিল ২০ দলীয় জোট। সর্বশেষ আজ সোমবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে তারা। কিন্তু হরতাল কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকেই সরকার কঠোর অবস্থানে রয়েছে। চলছে জোটের নেতা-কর্মীদের বাসায় তল্লাশি আর ধরপাকড়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে গ্রেপ্তার করা হয় গত শুক্রবার। গত শনিবার মধ্য রাতে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বিএনপি নেতা ও যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে। গতকাল রবিবার তাঁকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আদাবর থানা বিএনপির সভাপতি ও তাঁর ছেলেকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে ওই দিন। আরো ১০-১২ জন নেতার বাসায় হানা দিয়েছেন আইনশৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। গত শনিবার গভীর রাতে পুলিশ যায় শাহজাহানপুরে ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসের বাসায়। তবে পরিবারের লোকজন গেট না খোলায় ভেতরে ঢুকতে পারেনি পুলিশ। ওই রাতেই হানা দেওয়া হয় ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুল আউয়াল মিন্টুর বাসায়।
মির্জা আব্বাসের ব্যক্তিগত সহকারী সোহেল জানান, শনিবার রাত দেড়টার দিকে বেশ কিছু পুলিশ সদস্য মির্জা আব্বাসের বাসার গেট খুলতে পরিবারের সদস্যদের নির্দেশ দেন। ওই সময় তাঁরা গেটে ধাক্কাধাক্কি করতে থাকেন। গেট ভেঙে ফেলারও হুমকি দেওয়া হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে গেট না খোলায় ফিরে যায় পুলিশ। পরে রাত সোয়া ২টার দিকে পুলিশ ফের মির্জা আব্বাসের বাসায় যায়। তখনো গেট খোলা হয়নি।
এর আগে শান্তিনগরে ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব হাবীব-উন-নবী খান সোহেলের বাসায়, শাহজাহানপুরে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল বারী বাবুর বাসায়, যুবদল মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাহাঙ্গীর ও দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম মজনুর বাসায়, খিলগাঁও থানা বিএনপির সভাপতি ইউনুস মৃধা ও সাধারণ সম্পাদক ফারক উল ইসলামের বাসায় এবং ছাত্রদল সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ বিএনপির ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাদের বাসায় হানা দিয়েছে পুলিশ।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, গ্রেপ্তার, হামলা-মামলা রাজনৈতিক ভাষা হতে পারে না। সরকারকে এ পথ পরিহার করার আহ্বান জানান তিনি। দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী বলেন, ‘একদলীয় দুঃশাসন নিশ্চিত করতেই অবৈধ সরকার দেশব্যাপী এ গ্রেপ্তার অভিযান শুরু করেছে; কিন্তু এতে তারা পার পাবে না। অতীতেও কোনো স্বৈরাচার পার পায়নি। এ অবৈধ সরকারও পাবে না।’
সরকার গণহারে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাড়িতে হানা দিয়েছে বলে দাবি করেন রিজভী। তিনি অভিযোগ করেন, এখন পর্যন্ত পুলিশ ঢাকা মহানগরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দেড় শতাধিক নেতা-কর্মীকে আটক করেছে। বিএনপির একাধিক নেতা জানান, আগামী ৩ ও ৫ জানুয়ারি জনসভা সফল করতে তাঁরা কাজ করছেন। ওই জনসভার আগে কোনোভাবেই গ্রেপ্তার হওয়া যাবে না- এমন নির্দেশ রয়েছে হাইকমান্ড থেকে।
আলাল তিন দিনের রিমান্ডে : আদালতে খালেদা জিয়ার হাজিরাকে কেন্দ্র করে বকশীবাজারে সংঘর্ষের ঘটনায় চকবাজার থানার মামলায় যুবদলের সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে। গত শনিবার রাত পৌনে ১২টার দিকে আলালকে মোহাম্মদপুরে তাঁর বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা, মারধর ও ভাঙচুরের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে গতকাল আলালকে আদালতে হাজির করে ১০ দিন রিমান্ড চান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওসি (তদন্ত) ইলিয়াস হোসেন। শুনানি শেষে ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আলী মাসুদ শেখ সতর্কতার সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন। এর আগে সংসদ সদস্য ছবি বিশ্বাস হত্যাচেষ্টার মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ চারজনকে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়।
আওয়ামী লীগকেও সমাবেশ করতে না দেওয়ার হুমকি : বিএনপির সমাবেশে বাধা দেওয়া হলে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকেও দেশের কোথাও নির্বিঘ্নে সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না বলে হুমকি দিয়েছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ। গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দুই দফা সংবাদ সম্মেলনে এ হুমকি দেন রিজভী।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফের এক বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় রিজভী বলেন, ‘হানিফ সাহেব বলেছেন, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য প্রত্যাহার না করলে বিএনপিকে দেশের কোথাও সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না। আমরা দৃঢ়কণ্ঠে বলতে চাই, বিএনপির সমাবেশে বাধা দিলে আওয়ামী লীগও দেশের কোথাও নির্বিঘ্নে সমাবেশ করতে পারবে না। মানুষের সম্মিলিত শক্তিতে তা প্রতিহত করা হবে।’
খিলগাঁও বিএনপির সহসভাপতি ফরহাদ হোসেন, বরিশালের স্বেচ্ছাসেবক দলের হাবিবুর রহমান পিন্টু, পটুয়াখালীর শাহাবুদ্দিন, আহসান উল্লাহ পিন্টু, শাহজাহান হাওলাদারসহ বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার নেতা-কর্মীদের মুক্তি দাবি করেন রিজভী।
আজ হরতালে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা মাঠে থাকবেন কি না- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে রিজভী বলেন, ‘বিএনপি কোনো ভুঁইফোড় সংগঠন নয়। বিএনপির নেতারা ঘরে বসে নেই।
এদিকে বিকেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে রিজভী বলেন, দেশব্যাপী বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সোমবারের সকাল-সন্ধ্যা হরতাল সামনের রেখে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গণহারে গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। তিনি অভিযোগ করেন, এখন পর্যন্ত পুলিশ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিএনপির দেড় শতাধিক নেতা-কর্মীকে আটক করেছে।
নোয়াখালীতে বিএনপি, জামায়াত নেতাসহ তিনজন গ্রেপ্তার : নোয়াখালী থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলায় বিএনপি নেতা ও স্থানীয় ছাতারপাইয়া ইউপি চেয়ারম্যান, জামায়াত নেতাসহ তিনজনকে গতকাল গ্রেপ্তার করা হয়। এর জের ধরে দুপুরে বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা সেনবাগ-সোনাইমুড়ী সড়ক এক ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে অবরোধকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। হরতালে নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে গতকাল সকাল ৯টার দিকে সেনবাগ থানার মোড়ের একটি দোকান থেকে পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফারুক বাবুল ও জামায়াত নেতা আলাউদ্দিন আলোকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে উপজেলার ছাতারপাইয়া বাজার থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ছাতারপাইয়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও ছাতারপাইয়া ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর রহমানকে।
ময়মনসিংহে বিএনপির পাঁচ কর্মী আটক : ময়মনসিংহ থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, গতকাল কোতোয়ালি পুলিশ বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বাসায় অভিযান চালিয়ে যুবদল ও ছাত্রদল নেতা ইবনে খালিদ বাবু, হাসান মাহমুদ, জাকির আনাম, ইনসান ও তৌকির হোসেনকে আটক করে। পরে বিকেলে তাঁদের বিস্ফোরক মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়।
মাদারীপুরে আটক ৪ : মাদারীপুর প্রতিনিধি জানান, জেলা বিএনপির সভাপতি আবু বক্কর সিদ্দিক আবু মুন্সীসহ পাঁচ নেতা-কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। গতকাল ভোরে সদর উপজেলার চরমুগরিয়ায় নিজ বাড়ি থেকে আবু বক্কর সিদ্দিককে আটক করা হয়। তবে সকালেই তাঁকে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। অন্য চারজন আটক রয়েছেন।
ধামরাইয়ে আটক ৩ : ধামরাই (ঢাকা) প্রতিনিধি জানান, ধামরাইয়ে শনিবার রাতে পুলিশ বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে পৌর যুবদলের সাধারণ সম্পাদকসহ তিন নেতা-কর্মীকে আটক করেছে।
মুন্সীগঞ্জে বিএনপি নেতা গ্রেপ্তার : মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, নাশকতার আশঙ্কায় সদর উপজেলার আধারা ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জজ মিয়াকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। শনিবার গভীর রাতে শহরের খালইস্ট ভাড়া বাসা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।