অসহযোগের পথে হাঁটবে বিএনপি!
কাজী আমিনুল হাসানঃ নতুন নির্বাচন নিয়ে ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত হরতাল-অবরোধসহ কড়া কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দল। সরকার সমাধানের পথে না এলে অবরোধ থেকে অসহযোগের পথে হাঁটবে বিরোধী জোট। দাবি আদায়ে আগামী সপ্তাহে অবরোধের সঙ্গে যুক্ত হবে নতুন কর্মসূচি। ১২ই জানুয়ারি রাজধানীতে আওয়ামী লীগের ঘোষিত জনসভার দিন সমাবেশের ঘোষণা দিতে পারে ২০দলও। সবকিছু ঠিক থাকলে সে ঘোষণা আসতে পারে আজ। আর সমাবেশের অনুমতি না পেলে অবরোধের সঙ্গে টানা হরতাল কর্মসূচি যুক্ত করার নীতিগত সিদ্ধান্তও হয়েছে বিএনপিতে।অবরুদ্ধ থেকেও জেলা ও মহানগর নেতাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ ও নির্দেশনা দিচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া। টানা কর্মসূচিতে রাজপথে থাকতে নেতাকর্মীদের অনুপ্রাণিত করছেন তিনি। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়া সাংবাদিক, পেশাজীবী প্রতিনিধি এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের মাধ্যমে দলের নেতাকর্মীদের জানিয়েছেন, যে কোন মূল্যে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে
এছাড়া রাজধানীতে সভা-সমাবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে না নেয়া পর্যন্ত কার্যালয়ে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন খালেদা জিয়া। নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে প্রথমে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যাবেন তিনি। এমন কি খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হলে কোন কৌশলে আন্দোলন চলবে তারও পরিকল্পনা এবং কিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট নেতাদের। বিএনপি ও ২০দলীয় জোটের একাধিক সিনিয়র নেতা এমন তথ্য জানিয়েছেন।
তারা বলেন, সরকারকে অনেক সময় দিয়েছে বিএনপি। জনগণের কথা ভেবেই এক বছর হরতাল-অবরোধ কিংবা রাজপথে কঠোর কোন কর্মসূচি দেয়নি ২০দল। কিন্তু এটাকে দুর্বলতা ভেবে বিরোধী জোটকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে সরকার। তবে এবার পিছু হটবে না ২০দল। যে কোন পরিস্থিতিতে অটল থাকবে তারা।
এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন অবরুদ্ধ নন এবং ইচ্ছে করলে পুলিশের পাহারায় যেতে পারেন বলে সরকারের তরফে যে বক্তব্য এসেছে সেটাকে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানো ও আন্দোলনের গতিচ্যুতের কৌশল হিসেবে দেখছে বিএনপি।
দলের সিনিয়র নেতারা জানান, রাজধানীতে সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না হলে গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে থেকে বাসায় ফিরবেন না খালেদা জিয়া। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, খালেদা জিয়া বাসায় ফিরলে তাকে সেখানে অবরুদ্ধ করে রাখা হবে। অন্যদিকে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের মতো গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ নেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
অবরুদ্ধ খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি সাংবাদিক ও পেশাজীবী নেতাদের জানিয়েছেন, তার কার্যালয়ের সামনে থেকে পুলিশ সরালে তিনি নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যাবেন। আন্দোলনের মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারে একটি ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি না হলে তিনি বাসায় ফিরবেন না। এদিকে ৩রা জানুয়ারি রাতে অবরুদ্ধ হওয়ার পর থেকে তিনি ফোনে জেলা ও ঢাকা মহানগর নেতাদের সঙ্গে প্রতিদিনই কথা বলছেন।
এ সময় তিনি নেতাকর্মীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দিচ্ছেন। ৫ই জানুয়ারি তার ওপর পুলিশ পেপার স্প্রে ছোড়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।
দুদিন চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্থ হয়েই তিনি ফের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তিনি নেতাদের পরিষ্কার জানিয়েছেন, আন্দোলন থেকে সরে আসা, ঢিল দেয়া বা সমঝে চলার কোন সুযোগ নেই। সরকারকে যথেষ্ট সময় দেয়া হয়েছে। এখন কঠোর থেকে কঠোরতর আন্দোলনের সময় শুরু হয়ে গেছে।
বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বেই আন্দোলন চলছে। তিনিই কৌশল চূড়ান্ত ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছেন। আন্দোলন সংগ্রামের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন নেত্রী খালেদা জিয়ার ওপর জোটের শরিকদলগুলোও আস্থা রেখেছেন।
ওদিকে ইজতেমা চলাকালে অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহারের আহ্বান এসেছিল সরকারের তরফে। নানা মহল থেকেও অবরোধ শিথিলের প্রস্তাব এবং পরামর্শ এসেছিল বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে। কিন্তু কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তৃণমূল নেতৃত্ব।
তারা অতীতের উদাহরণ দেখিয়ে বলেন, আন্দোলনের উত্তুঙ্গ সময়ে কর্মসূচিতে ঢিল দিলে নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা নেমে আসে। পাশাপাশি প্রশাসন ও সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের তৎপরতা মোকাবিলা করে দ্রুত আন্দোলন ফিরতে পারে না। এমন প্রেক্ষিতে ইজতেমার সময়ও অবরোধ অব্যাহত রাখে ২০দল। তবে ইজতেমায় আগতদের বহনকারী যানবাহনগুলো অবরোধের আওতামুক্ত রাখা হয়।
তবে নেতারা জানান, ইজতেমার পর অবরোধ পালন করা হবে কঠোরভাবে। বিএনপি নেতারা জানান, চলমান আন্দোলন একটি কার্যকর পরিণতি দিকেই যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দমন-পীড়ন ও সরকারি দলের কর্মী-সমর্থকদের হামলার মুখেও অনির্দিষ্টকালের অবরোধ ধরে রেখেছে ২০দলের নেতাকর্মীরা। সরকার সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে দাবি করলেও রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তরণে দুইপক্ষকে সংলাপে বসার তাগিদ আসছে কূটনৈতিক মহল, সুশীল সমাজ, ব্যবসায়ী ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তরফে।
গতকাল বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) বলেছে, অবরোধ, হরতালের কারণে পরিবহনখাত অচল হয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ২০দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়াকে দ্রুত সংলাপের তাগিদ দিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির কারণে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির হয়ে উঠেছে। সারা দেশে সহিংসতা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
এ অবস্থা চলতে থাকলে আমরা একটি অকার্যকর রাষ্ট্র, এমনকি গৃহযুদ্ধের দিকেও ধাবিত হতে পারে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বিএনপি-জামায়াতের দালাল আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভারতের ক্ষমতাসীন পার্টি বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ’র ফোনালাপ নিয়ে সরকারের তৎপরতায় বোঝা যায়, তারা সাধারণ কুশলাদি জানার ফোনটিকেও খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা বিএনপিকে নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছে সরকার। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের পাশাপাশি সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরও। এটা প্রমাণ করে সরকার বিরোধী দলের আন্দোলন কার্যকর এবং সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে পুলিশের অবস্থান এবং গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা এখনও অব্যাহত। কার্যালয়ের গেট থেকে ট্রাক সরানো হলেও দুইপাশে পুলিশ ভ্যান দিয়ে রাস্তা আটকে রাখা হয়েছে। নেতাকর্মী তো দূরের কথা সাংবাদিকদেরও ওই সড়কে ঢুকতে হচ্ছে পরিচয় দিয়ে।
প্রতিদিন চলছে তালা লাগানো এবং খুলে দেয়ার নাটক। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে টেলিভিশনে লাইভ সম্প্রচার। এখন সরকার যতই অস্বীকার করুক খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়নি দেশবাসী ও বিশ্ববাসী জানে এটা সরকারের মিথ্যাচার।