সংকট সমাধানে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই!
মাইনুর রহমানঃ দেশে বর্তমানে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সংলাপের তাগিদ আসছে বিভিন্ন মহল থেকে। বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০ দল সংলাপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের পক্ষে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের বাইরে থাকা অনেক রাজনৈতিক দলগুলোও সংকট নিরসনের সমঝোতা চায়। বিএনপির পক্ষ থেকেও বারবার বলা হচ্ছে চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। বিভিন্ন সময় সভা-সেমিনারে ছোট রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে সংলাপের তাগিদ দিচ্ছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সুশীল সমাজ, ব্যবসায়ী ও আইনজীবীদের পক্ষ থেকে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা মিটিয়ে ফেলার আহ্বান অব্যাহত রয়েছে। তাছাড়া পেশাজীবী সংগঠনগুলো ছাড়াও দেশের সাধারণ মানুষ চান আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সংকট সমাধান হোক
গত ৩১ ডিসেম্বর চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে ৭ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তার দেয়া প্রস্তাবগুলো শুধুমাত্র বিএনপির পক্ষে থেকে দেয়া হয়নি। এ প্রস্তাবগুলো ছিল তার নেতৃত্বাধীন ২০ দলের পক্ষ থেকে। খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করার পর অনেকেই ভেবেছিলেন তিনি হয়তো নতুন রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়ার জন্য সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন। কিন্তু বিরোধী জোট নেত্রী আন্দোলনের কর্মসূচি না দিয়ে সরকারকে একটি নতুন জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তার ওই আহ্বানে নির্বাচনের প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কিছু প্রস্তাব দেন। এসময় জোট নেত্রী সাংবাদিকদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেন এবং তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছেন, আলোচনা ও আন্দোলনের মধ্যে কোনটিকে ২০ দল অগ্রাধিকার দিচ্ছে। জবাবে বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছি। সরকার চাইলে আলোচনা হতে পারে। এক্ষেত্রে আমরা কোনো সময়সীমা দিচ্ছি না। দেশবাসী অতিদ্রুত একটি নির্বাচন চান।
বেগম খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনের একদিন পর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সরকারকে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি ১ জানুয়ারি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক সমাবেশে সব রাজনৈতিক দলকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানান। এরশাদ বলেন, আসুন আমরা সকলে মিলে আলোচনা করে রাজনৈতিক সংকট সমাধন করি।
এমনকি আওয়ামী লীগের প্রবীণ বেশ কিছু নেতা ও তৃণমূলের অধিকাংশ নেতারাই সম্ভাব্য সংকট এড়াতে আলোচনার পক্ষে।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের একাধিক সদস্যের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তারা সংঘাত ও সহিংসতা এড়াতে আলোচনার টেবিলেই সমাধান হওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের কিছু নেতা, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট, মহাজোটের বড় শরিক এরশাদের জাতীয় পার্টি সংলাপের পক্ষে। এছাড়া প্রবীণ রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. বি চৌধুরী, প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলনকারী আসম আবদুর রবসহ প্রবীণ রাজনীতিবিদগণ সংলাপের মধ্যে চলমান সংকট উত্তরণের কথা বলে আসছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) শনিবার ঢাকায় এক জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে। ওই সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটি চলমান রাজনৈতিক সংকট ও এর নেপথ্যের কারণগুলো তুলে ধরে রাষ্ট্রপতিকে একটি অর্থবহ সংলাপের উদ্যোগ নিতে অনুরোধ জানায়। একই সঙ্গে সংস্থাটির সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বিএনপি চেয়ারপারসনকে অবরুদ্ধ করে রাখায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এক লিখিত বক্তব্যে তিনি এ ঘটনাকে মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের নতুনমাত্রা বলে আখ্যা দেন।
একই দিন দেশে ব্যবসায়ীদের প্রধান সংগঠন এফবিসিসিআই এর পক্ষ থেকে চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে সংলাপ ও সমঝোতার উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এ আহ্বান জানানো হয়।
রোববার সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির পক্ষে থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে সমাঝোতার মাধ্যমে একটি জাতীয় নির্বাচন দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
কিন্তু এরপরও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকগণ সংলাপে বসতে চাচ্ছেন না। আওয়ামী লীগের প্রবীণ কিছু নেতা ও মহাজোটের শরিকদের পক্ষ থেকে সংলাপের পরামর্শ থাকলেও সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না দলটি। সংলাপ থেকে আওয়ামী লীগকে দূরে রাখতে দলের ভেতরেই প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা তৎপর রয়েছেন বলে সূত্রে জানা গেছে। এর কিছু কারণও ব্যাখ্যা করেছেন বিশ্লেষকগণ।
১. আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকগণ মনে করেন, দেশে অল্প কয়েকদিনের অবরোধে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে। দেশের স্বাভাবিক অবস্থা নেই। এ অবস্থায় সংলাপ মানেই নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হওয়া। কারণ, ইতিমধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন ২০ দলের পক্ষ থেকে নির্বাচন দেয়া আহ্বান জানিয়েছেন। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা সম্পর্ক ২০ দলের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। সে কারণে আওয়ামী লীগ মনে করে নির্বাচন দেয়ার শর্ত মেনে নিয়েই সংলাপে বসতে হবে। আর সে কারণেই সংলাপের জন্য কোনো আহ্বানেই সাড়া দিচ্ছে না দলটি।
২. আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী অনেক নেতাই তাদের নির্বাচনী এলাকায় অজনপ্রিয়। বিশেষ করে দলটি বেশিরভাগ মন্ত্রীর অবস্থাই নাজুক। এক সময়ের প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্যরা (বর্তমানে মন্ত্রী ও দলের উপদেষ্টা) নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় জনপ্রিয় নন। এরা আরেকটি নির্বাচন হলে নির্বাচিত হওয়ার যে কোন সম্ভাবনা নেই তা নিজেরাই জানেন। এদের মধ্যে অনেকেই গত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় প্রচারণা চালাতে গিয়ে বলেছিলেন এটা তাদের জীবনের শেষ নির্বাচন। ভোটারদেরকে বলেছিলেন শেষ নির্বাচনে যেন পরাজিত হয়ে লজ্জিত হতে না হয় সেজন্য শেষবারের মতো ভোট দিতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। দলটির ওইসব জনবিচ্ছিন্ন নেতারা সংলাপ চান না। তারা মনে করেন, সংলাপ হলে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নতুন নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হবে আর সম্ভাব্য ওই নির্বাচনে তারা ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হতে পারবেন না। সেকারণে তারা চাননা তাদের দল সংলাপের পথে অগ্রসর হোক।
৩. আওয়ামী লীগ মনে করে সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমঝোতা সৃষ্টি হলে শিগগিরই একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু এখনই একটি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত নয় আওয়ামী লীগ। দলের ভেতরে বিদ্যমান সমস্যাগুলো নিরসন না করে নির্বাচন দিলে ফলাফল দলটির অনুকূলে নাও আসতে পারে।
৪. আওয়ামী লীগ এখনো তৃণমূলে শৃঙ্খলা ফেরাতে পারেনি। বিভিন্ন সময়ে দলটি তৃণমূলের সংগঠন গোছানোর উদ্যোগ নিলেও তা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন অঙ্গ, সহযোগী ও সমর্থক সংগঠনগুলো সাংগঠনিক কাজের চাইতে দলীয় পরিচয় কাজে লাগিয়ে আর্থিক সুবিধা গ্রহণেই বেশি ব্যস্ত রয়েছে। এ অবস্থায় সংলাপ, সমঝোতা ও নতুন নির্বাচনকে ঝুঁকি মনে করছে দলটির নীতিনির্ধারকগণ।
৫. টানা ৬ বছরের ক্ষমতায় থাকার পরও আওয়ামী লীগের ত্যাগী কিছু নেতা ক্ষমতার সুবিধা ভোগ করতে পারেননি স্থানীয় সংসদ সদস্য, সরকার সমর্থক উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং দলের নব্য প্রভাবশালীদের জন্য। দলে সুবিধাবঞ্চিত এসব নেতাকর্মীদের সংখ্যা খুব কম হলেও সাধারণ কর্মী ও আমজনতার কাছে এদের গ্রহণযোগ্যতা খুবই বেশি। এরা দলের প্রভাবশালীদের উপর ক্ষুব্ধ। একাদশ নির্বাচন নিয়ে দলের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে আলোচনা শুরু হলে সেই সুযোগে বঞ্চিত ত্যাগী নেতারা স্থানীয় মন্ত্রী-এমপিদের উপর বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে পারেন। তাছাড়া ওয়ান-ইলেভেনের পর রাজনীতিকদের যেভাবে ভিন্ন মেরুকরণের পথে হাঁটতে হয়েছে সেই বিষয়গুলোও স্মরণে রেখেছে আওয়ামী লীগ। এসব বিবেচনায় এনে সংলাপের দিকে এগোতে চাচ্ছেন না দলটি।
৬. ইতিপূর্বে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে দেশ ও দেশের বাইরে যেসব গ্রিন সিগনাল ছিল আপাতত সে রকম কোন সিগন্যাল নেই দলীয় শীর্ষ পার্যায়ে। দলটিকে বন্ধু হিসেবে পরিচিত রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলো থেকেও কোনো ধরনের আশ্বস্ত করা হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে সংলাপ ও সমঝোতার মতো এত বড় ধরনের ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না আওয়ামী লীগ। এছাড়াও অনেক অসঙ্গতির কারণের হিসেব মেলাতে পারছে না দলটির সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা।
তবে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি রোববার একটি অনলাইন পত্রিকার সঙ্গে আলাপকালে বলেন, যে যাই বলুক সংলাপের পথেই রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হতে হবে। তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, বালুর ট্রাকে রাজনৈতিক সংকটের কোন সমাধান আসবে না। বিএনপিকে সহিংস কর্মসূচি ছেড়ে সংলাপের পরিবেশ তৈরিরও আহ্বান জানান তিনি।
অপরদিকে রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে সংলাপের সম্ভাবনা একেবারেই নাকচ করে দেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য নূহ উল আলম লেনিন। তিনি একটি অনলাইন পত্রিকার সঙ্গে আলাপকালে বলেন, দেশের এখন এমন কোন অবস্থার সৃষ্টি হয়নি যে তা থেকে উত্তরণের জন্য সংলাপ করতে হবে।
বিএনপি ও তার রাজনৈতিক মিত্রদের সঙ্গে কোনো সংলাপ করা হবে না বলেও উল্লেখ করেন আওয়ামী লীগের এ নীতিনির্ধারক।
তিনি বলেন, যারা (বিএনপি) যুদ্ধাপরাধীদের (জামায়াত) সঙ্গে এক কাতারে আছে তাদের সঙ্গে কোন সংলাপ নয়। তিনি বলেন, বিএনপি নেত্রী ও তার পুত্র মামলার আসামি। আসামিদের সঙ্গে কোন পলিটিক্যাল আলোচনা হতে পারে না।
বিএনপির সংলাপের এজেন্ডা কী এমন প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করছে। ২০১৯ সালের আগে কোন নির্বাচন হবে না। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও আগাম নির্বাচন নিয়ে কারো সঙ্গেই কোন ধরনের আলোচনা হওয়ার সুযোগ নেই।