নীল জলের দ্বীপভূমি
রহমান রুবেলঃ ১৯৯৬ সালে রানাতুঙ্গার নেতৃত্বে বিশ্বকাপ জয় করে শ্রীলঙ্কা। ক্রিকেটে তারা এখন অনেক শক্তিশালী। বিশ্বকাপ ২০১১ শুরুর আগ মুহূর্ত তখন। কলম্বো শহর সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। দেখলাম প্রেমাদাসা স্টেডিয়াম ও সিগিরিয়া যাবার পথে আরও একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম। শহরের মোড়ে মোড়ে বিশ্বের সেরা সেরা ক্রিকেটারদের ছবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড টানানো হয়েছে। তিন দেশ মিলে এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আয়োজন করছে। বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কা। ভেনু হিসেবে বাংলাদেশও প্রস্তুত। উদ্বোধনীসহ আটটি ম্যাচ হবে বাংলাদেশে। পাকিস্তান পারেনি বলেই বাংলাদেশ এই সুন্দর সুযোগটি পেয়েছে। একদিন দেখতে গেলাম শ্রীলঙ্কার ন্যাশনাল মিউজিয়াম। শহরের প্রাণকেন্দ্রের বড় চত্বরের মাঝে সাদা বিল্ডিংয়ের জাদুঘরটিতে রয়েছে শ্রীলঙ্কানদের অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নানান নিদর্শন। সেই আদি জেলে জীবন থেকে বুদ্ধের ভাস্কর্য, অলংকার, পুতুল, অস্ত্র-শস্ত্র ইত্যাদি। নানান দেশের দর্শক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন শ্রীলঙ্কানদের জীবন ও ঐতিহ্য। জাদুঘরের দুইজন নারী অফিসার আমাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন আর বর্ণনা করলেন মিউজিয়ামে রাখা নিদর্শনের ইতিহাস।
কলম্বো সমুদ্রসৈকত
রাজধানী কলম্বো থেকে প্রায় ৫ ঘণ্টার পথ পেরিয়ে যেতে হয় শ্রীলঙ্কার নান্দনিক শহর কেন্ডিতে। এ যাত্রায় যাওয়া হয়নি। যাওয়া হয়নি রত্নাপুরা, নিগাম্বু, ডাম্বুলা কিংবা মৃত নগরী অনরাধাপুর। তবে একদিন দেখতে গেলাম সবচেয়ে দর্শনীয় স্থান সিগিরিয়া। সেদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় মাইক্রোবাসে কলম্বো থেকে যাত্রা করলাম সিগিরিয়ার উদ্দেশে। বাংলাদেশের মতই রাস্তার দু’পাশের গ্রামীণ পরিবেশ। ধানক্ষেত, নারিকেল বাগান আবার কখনও সমতল, কখনও পাহাড়ি উঁচু ভূমি চোখে পড়ছে। যেতে যেতে নাস্তার জন্য নেমে গেলাম এক জায়গায়। রাস্তার পাশে বিশাল একটি দিঘি। দিঘির কিনারে চমৎকার রেস্টুরেন্ট। বিভিন্ন পদের খাবার রয়েছে। খাবারের সঙ্গে ওরা সব সময় বিভিন্ন ফল রাখে। শ্রীলঙ্কান নিজস্ব কিছু খাবারও রয়েছে; কেউ কেউ তা খেলো। নাস্তা শেষে আবার আমরা যেতে শুরু করলাম। সেদিন ছিল বৃষ্টিভেজা দিন। থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। রোদও উঠছে।
সিগিরিয়া পৌঁছুতে প্রায় ৬ ঘণ্টা সময় লাগল। চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশ। টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যেই অসংখ্য দেশি-বিদেশি দর্শক বাংলাদেশের পাহাড়পুরের মত এক পুরনো নৈসর্গিক সৌন্দর্যমণ্ডিত দর্শনীয় স্থান উপভোগ করছে। সিগিরিয়ার মূল আকর্ষণ ছয়শ ফুট উঁচু পাথরের পাহাড় বা রক। অনেক দূর থেকে দেখা যায় দৃষ্টিনন্দন রকটি। পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার আগে দর্শক চারদিকের মনোরম দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন। পাদদেশে এক সময় একটি সভ্যতা ছিল। তারই চিহ্ন রয়েছে। এর রূপ দর্শন করে বিশিষ্ট লেখক হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, ‘সিগিরিয়া রক একসময় বনেজঙ্গলে ঢাকা পড়ে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়। দুজন ব্রিটিশ পর্যটক ১৮৫৩ সালে এর অস্তিত্ব খুঁজে পান। এরপর থেকে প্রতিবছর শত শত পর্যটক এখানে আসেন। মুগ্ধ হয়ে দেখেন যিশুখ্রিস্টের জন্মের ১৬০০ বছর আগের অপূর্ব স্থাপত্য।’ আমাদের গাড়ি যেখানে থামল সেখানে লাল সুরকি বিছানো চমৎকার রাস্তা। রাস্তার পাশেই টিকিটঘর। আমরা টিকিট কাটলাম। ওখানে টাকার বিনিময়ে গাইড পাওয়া যায়। আমরা একজন গাইড নিলাম। তিনি এক এক করে পৃথিবীখ্যাত ‘সিগিরিয়া রক’ বা ‘লায়ন রক’ সম্পর্কে আমাদের জানালেন। রাজা কাশ্যপ নামে খ্রিস্টের জন্মের আগে শ্রীলঙ্কার এক নৃপতি ছিলেন। ভারতীয় জলদস্যু এবং সৎভাই ম্যাগনোলার ভয়ে তিনি এই পাথরের প্রাসাদ নির্মাণ করেন। প্রাসাদে একটি সুইমিংপুল, পাঁচশ রক্ষিতা ছিল। এখনও পাহাড়ের গায়ে এদের অর্ধ-নগ্ন ও নগ্ন চিত্র আঁকা আছে। ভীতু রাজা সব সময় দূর্গের ভিতর অবস্থান করতেন। একদিন ম্যাগনোলা বিশাল হাতির বহর নিয়ে আক্রমণ করে সেই দূর্গ। সুসজ্জিত সেনাবাহিনীসহ রাজা কাশ্যপ পরাজিত হয়ে আত্মহত্যা করেন। দর্শনীয় এই রকটি দখলে আসে বীর ম্যাগনোলার। তারপর এতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বাস করতে শুরু করে।
সমুদ্র সৈকতে লেখক
টিপটিপ বৃষ্টির ভেতর অসংখ্য দর্শক ও পর্যটক ছবি তুলছেন আর সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছেন। এভাবে ওঠা অত্যন্ত কঠিন বৈকি! ঝুঁকিপূর্ণও বটে। তবু শত শত পর্যটক উঠছেন, দেখছেন, আনন্দ পাচ্ছেন। এঁকে বেঁকে কখনও লোহার সিঁড়ি, কখনও কাঠের, কখনও বা পাকা সিঁড়ি বেয়ে আমরাও উপরে উঠছি। নিচের দিকে তাকালে ভয় লাগে। চারশ ফুট ওঠার পর একটু সমতল জায়গা রয়েছে। এখানে বসে বিশ্রাম করা যায়। দাঁড়িয়ে দূর পাহাড়ের দৃশ্য দেখা যায়। গল্প শোনা যায়। এই স্থানে এসে মনে পড়ল, সিলেটের তামাবিল দিয়ে ডাউকি হয়ে শিলং ও চেরাপুঞ্জি যাওয়ার কথা। ৩ হাজার, ৪ হাজার, ৫ হাজার ফুট ভিজিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতি। এ যেন এমন নিবিড় এক অনুভব, এক অন্যরকম আনন্দ-অনুভূতি, এক নান্দনিক ভালোলাগা জীবনের গল্প। অঝর বৃষ্টির ধারা, যে কারণে সবুজ পাহাড় শাদা হয়ে গেছে। মেঘগুলো এসে বার বার খাবি খাচ্ছে পাহাড়ের গায়ে, সেই সাথে আমাদের গায়েও। সম্পূর্ণ পাথরের পাহাড়। একদম চূড়ায় শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই তর তর করে উঠে যাচ্ছে। তারপর পাহাড় বিজয় শেষে এক এক করে নেমে আসছে সকলেই। আমরাও নেমে এলাম এক সময়। পৃথিবীর যে প্রান্ত থেকেই পর্যটক আসুক না কেন এই পাহাড়-চূড়া ছুঁয়ে যাবেনই।কলম্বোর প্রাণ কেন্দ্রে গলফেইস। আমরা যারা কক্সবাজারের বিশাল সমুদ্র সৈকত দেখেছি, তারা কেউ কেউ হয়ত আহত হবেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হাউসের পাশে স্বল্প দৈর্ঘে্যর সমুদ্র সৈকতের রয়েছে আলাদা আনন্দ। শহরবাসী ও পর্যটকরা সেখানেই আনন্দ কুড়াচ্ছেন। বিচ বা সৈকত বেশি বড় নয়। পড়ন্ত বিকালের মিষ্টি রোদে আমরা হাঁটছি। ভারতীয় গবেষক বন্ধুরা, নানা এঙ্গেলে ছবি তুলছেন। সৈকতের সোনালি বালিতে সাগরের নীল জলের মৃদু ঢেউ আছড়ে পড়ছে। সমুদ্রে নামার জন্য সৈকতের মাঝমাঝি স্থানে একটি কাঠের অস্থায়ী সেতু এবং সিঁড়ি স্থাপন করা হয়েছে, যা দিয়ে সমুদ্রবিলাসী পর্যটক, দর্শকরা নামছে ও উঠছে। সমুদ্র মানেই ভাললাগা, সমুদ্র মানেই অজানা সুরে ভেসে যাওয়া। কিন্তু এই ভাললাগার ক্ষণটি বেশি সময় টিকল না। হঠাৎ করেই এক পশলা বৃষ্টি এলো। ভিজিয়ে দিতে চাইলো আমাদের সকল আনন্দ। গাইড রেশমির ডাকে আমরা সবাই মাইক্রোবাসে উঠে এলাম। আমাদের সমুদ্রের পাড় ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমরা দেখছি, একদিকে সমুদ্রের সৌন্দর্য অন্যদিকে কলম্বো শহরের সৌন্দর্য। আমাদের গাড়ি থামল একটি কারুশিল্প বিক্রয় কেন্দ্রের সামনে। এতে শ্রীলঙ্কার ঐতিহ্যবাহী লোক ও কারুশিল্পের নানান পশরা রয়েছে। ক্রেতা অধিকাংশই বিভিন্ন দেশ থেকে আগত ভ্রমণপিয়াসী মানুষ। শ্রীলঙ্কার পাথর জগৎ বিখ্যাত। নীলা বা পদ্মরাগ মণি, রুবি, গার্নেট, ক্যাটস আই, এমেথিস্ট, টোপাজ ইত্যাদির রত্নভাণ্ডার। আমার ব্যক্তিগতভাবে পাথরের প্রতি তেমন আগ্রহ নেই, তবু দেখার জন্যই দেখলাম দামি দামি কিছু পাথরের কাজ। দেখার আরও একটা কারণ দেশের অনেক পরিচিতজন শ্রীলঙ্কা থেকে পাথর আনার জন্য বলেছেন। যাহোক ব্যাটে-বলে মিলল না, পাথরও কেনা হলো না।
শ্রীলঙ্কা থেকে ফিরবার আগের সন্ধ্যায় কলম্বোর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে ডিনারের আমন্ত্রণ পেলাম আমরা। সেখানে খাবারের বাহারি আয়োজন। ডিনারের আগে আমাদের নেওয়া হলো হোটেলের পাশেই একটি গ্রামীণ পরিবেশে। গ্রামীণ পরিবেশ বলতে, একটি বিশাল পুরনো বটগাছের তলায় শ্রীলঙ্কার প্রাচীন গ্রামের মডেল তৈরি করা হয়েছে। যেখানে গ্রামের ঘর-বাড়ি, গাছ-গাছরা, খাবার-দাবার, গান-বাজনা সবকিছুই রয়েছে। টিম টিম করে হ্যারিকেন বাতি জ্বলছে, সেই আলোয় রান্না করছেন গ্রামীণ নারীরা। নারকেলের তৈরি নানান রকমের খাবারসহ বিভিন্ন উপাদানের খাবার পরিবেশিত হচ্ছে অতিথিদের জন্য। আমাদেরকেও দেওয়া হলো সেইসব খাবারের কিছু কিছু অংশ। সেইসাথে শ্রীলঙ্কার ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে সেদেশের প্রাচীন জীবনের ইতিহাস বললেন একজন ভদ্রলোক। এরপর আমরা মূল ডিনারে অংশ নিলাম। অনেক ধরনের খাবার। খাওয়ার সঙ্গে চলল গান। ভাষা না বুঝলেও সেদেশের ফোক গানের সুর আমাদের কিছুক্ষণ টানল। নীল জলের দ্বীপভূমি সিগিরিয়ার দেশ ছেড়ে আমরা ফিরে এলাম পরদিন আপন আলয়ে। দ্বীপ দেশের ভালবাসা আমাদের সত্যি মুগ্ধ করেছে। হয়ত আবার কখনও যাবো, হয়ত কখনও আর যাওয়া হবে না কিন্তু শ্রীলঙ্কা ভ্রমণস্মৃতি মনে থাকবে বহুদিন, বহুদিন, বহুদিন।