কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর
নিজস্ব প্রতিবেদক : জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির দন্ডাদেশ কার্যকর করা হয়েছে।
আজ শনিবার রাত ১০টা ৩০ মিনিটে এ ফাঁসি কার্যকর করার মধ্য দিয়ে দেশের বিচার ব্যবস্থার জন্য আরও একটি ইতিহাস রচিত হলো। আইজি (প্রিজন) সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন ও ঢাকার অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার শেখ মোহাম্মদ মারুফ হাসান বাসস’কে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যা-গণহত্যা, ব্যাপক নিধনযজ্ঞ, দেশান্তর, নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্মগত ও রাজনৈতিক কারণে নির্যাতন করে হত্যা ও ষড়যন্ত্রের মতো বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এর মধ্যে শেরপুরের সোহাগপুরে গণহত্যা ও ধর্ষণের দায়ে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।
শেরপুর সদর উপজেলার বাজিতখিলা ইউনিয়নের মুদীপাড়া গ্রামের বাড়িতে তার নামাজে জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হবে। কারাগারের অ্যাম্বুলেন্সে করে প্রশাসনের কড়া নিরাপত্তায় সেখানে পাঠানো হবে তার মরদেহ।
স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর এটি হচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার দ্বিতীয় ফাঁসির রায় কার্যকর, যার মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি নিশ্চিত করা হলো। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।
দন্ড কার্যকরের সময় আইজিপি (প্রিজন) সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন, অতিরিক্ত আইজি (প্রিজন) কর্নেল মুহাম্মদ ফজলুল কবির, ডিআইজি (প্রিজন) গোলাম হায়দার, ঢাকার সিভিল সার্জন আবদুল মালেক মৃধা, ঢাকার জেলা প্রশাসক (ডিসি) তোফাজ্জল হোসেন, কারা হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আহসান হাবিব, ম্যাজিস্ট্রেট, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, পুলিশ কমিশনারের প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। একটি লাশবাহী এম্বুলেন্সও কারাগারে রাখা হয়।
কারাগার সূত্র জানায়, রাত ১০টার কিছু আগে কামারুজ্জামানকে কনডেম সেল থেকে ফাঁসির মঞ্চের কাছে নিয়ে আসা হয়। এরপর দু’জন কারারক্ষী তাকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যায়। পরে ম্যাজিস্ট্রেটের সংকেত পেয়ে জল্লাদ রাজু ফাঁসির মঞ্চের লিভারে টান দেন। সাথে সাথে কামারুজ্জামানের দেহ ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে থাকে। এর আগে কারাগারে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও তাকে শেষ গোসল করানো হয়। অতঃপর কারা মসজিদের ইমাম তাকে তওবা পাঠ করান বলেও কারা সূত্র জানায়।
কামারুজ্জামানের লাশ সরকারি ব্যবস্থাপনায় শেরপুরে তার গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হবে এবং সেখানেই তার স্বজনদের উপস্থিতিতে লাশ দাফন করা হবে বলে তার পারিবারিক সূত্র জানায়।
কামারুজ্জামানের সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যসহ বিভিন্ন স্বজনরা কারাগারে আজ বিকালে শেষ সাক্ষাত করেন। এক ঘণ্টার বেশী সময় সাক্ষাৎ শেষে ৫টা ২০ মিনিটের দিকে কারাগার থেকে বেরিয়ে যান কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যসহ বিভিন্ন স্বজনরা। বের হয়ে চলে যাওয়ার সময় কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের মধ্যে কেউ কেউ ভি চিহ্ন দেখান। আবার কারো চোখে পানিও দেখা যায়।
কামারুজ্জামানের সঙ্গে তার স্বজনদের আজ কারাগারে দেখা করতে কারা কর্তৃপক্ষ শেষবারের মতো অনুমতি দেয় বলে জানান তার ছেলে হাসান ইকবাল। কামারুজ্জামানের ফাঁসির দন্ড কার্যকরে সরকারের আদেশ দুপুরে কারা কর্তৃপক্ষের হাতে পৌঁছে। পরে তা কামারুজ্জামানকে অবহিত করা হয়।
দন্ড কার্যকরকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় কারাগার ও এর আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। এ সময় বিভিন্ন আইন শৃংখলা বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন। কারাগারে প্রবেশ পথে সাধারণের চলাচলে কঠোরতা আরোপ করা হয়। তবে গণমাধ্যমের কর্মিরা কারা ফটকসহ কারাগার এলাকায় নির্বিঘেœ দায়িত্ব পালন করে।
মানবতাবিরোধী অপরাধে ট্রাইব্যুনালে দন্ডিতদের মধ্যে কামারুজ্জামান হলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি, যার রায় কার্যকর করা হলো। এর আগে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের ৪২ বছর পর যুদ্ধাপরাধী দায়মুক্তির পথ উন্মোচন করলো।
কারা সূত্র জানায়, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দন্ড পাওয়া কামারুজ্জামান প্রাণভিক্ষা চাননি। তার সঙ্গে কারাগারে তার আইনজীবীরা ৯ এপ্রিল সাক্ষাৎ করেন। প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি-না সে বিষয়ে ভেবে-চিন্তে কর্তৃপক্ষকে জানাবেন বলে আইনজীবীদের জানিয়েছিলেন কামারুজ্জামান। তার প্রাণভিক্ষা চাওয়া বিষয়ে জানতে কেন্দ্রীয় কারাগারে ৯ এপ্রিল দু’জন ম্যাজিস্ট্রেট তানভীর মোহাম্মদ আজিম ও মাহবুব জামিল কারাগারে যান। তাদের সঙ্গে ছিলেন আইজি (প্রিজন), ডিআইজি (প্রিজন) ও সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী।
কামারুজ্জামানের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ (পুর্নবিবেচনা) আবেদন খারিজ করে ৬ এপ্রিল রায় দেয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ।
গত ৮ এপ্রিল ওই রায়ে স্বাক্ষর করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও বেঞ্চের তিন বিচারপতি। অন্য তিন বিচারপতি হলেন-বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। রিভিউ খারিজ করে দেয়া রায়ের কপি ওইদিনই ট্রাইব্যুনালে প্রেরণ করে সুপ্রিমকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখা। পরে ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত রেজিষ্টার আফতাব-উজ-জামান রায়ের কপি কেন্দ্রিয় কারাগার কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট জায়গায় ওইদিন বিকেলেই পৌছেঁ দেন। কারা কর্তৃপক্ষ রায়ের কপি আসামি কামারুজ্জামানকে পড়ে শোনায় বলেও কারা সূত্র জানায়।
গত ৫ মার্চ কামারুজ্জামানের পক্ষে রিভিউ আবেদনটি দাখিল করা হয়েছিল। গত বছরের ৩ নভেম্বর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি (বর্তমানে প্রধান বিচারপতি) সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের বেঞ্চ কামারুজ্জামানকে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদন্ডের রায় বহাল রেখে রায় দেয়। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ৫৭৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি প্রকাশ করে আপিল বিভাগ। রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে আসামিপক্ষের রিভিউ আবেদনের সুযোগ থাকায় সে অনুযায়ী তারা আবেদন দাখিল করেছিল।
একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার আবেদনের প্রেক্ষিতে ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়। সে থেকে তিনি কারাগারে ছিলেন।