বাংলা নববর্ষকে বরণ করতে নগর জুড়ে চলছে শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতি
বাংলা নববর্ষ ১৪২২ বঙ্গাব্দকে বরণ করে নিতে নগর জুড়ে চলছে শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতি। কাল বাদে পরশু মঙ্গলবার বাঙালী স্বাগত জানাবে নতুন বছরকে। সেই সঙ্গে কালের গহবরে হারিয়ে যাবে আরো একটি বাংলা বছর।
বর্ষ বরণ ও বিদায় উপলক্ষে তাই রাজধানী ঢাকা এখন উৎসবমুখর। বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান শেকড়ের সন্ধানে লোকায়ত সংস্কৃতির নানা উৎসব দিয়ে পয়লা বৈশাখকে বর্ণিল আয়োজনে বরণ করতে ব্যস্ত সময় পার করছে।
জাত-পাত ও ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো সকলে যার যার মত ব্যস্ত। ঘরে ঘরে চলছে উৎসব উদযাপনের প্রস্তুতি। নগরীর বুটিক হাউস ও শপিংমলগুলো ঘুরে দেখা গেছে, নগরবাসীর কেনাকাঁটার ধুম। বর্ষবরণের পোশাকে কয়েক বছর যাবতই লাল-সাদা রঙের পাশাপাশি অন্যান্য রঙের ট্রেন্ডও চালু হয়েছে। এতে পোশাকের ডিজাইনে বৈচিত্র এসেছে বলেও জানান ডিজাইনাররা।
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী বাঙালীর এটি এখন সবচেয়ে বড় এবং বর্ণিল উৎসব। আর বহুকাল ধরে ভোরের প্রথম প্রভাতে বর্ষবরণের এ উৎসবকে স্বাগত জানিয়ে আসছে ছায়ানট । তারা এবারও তাদের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। এটি তাদের বর্ষবরণের ৪৭তম আয়োজন। সাম্প্রতিক সময় বিবেচনায় ছায়ানট উৎসবের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে-‘শান্তি, মানবতা ও মানুষের অধিকার।
আগামী মঙ্গলবার, পয়লা বৈশাখ রমনার বটমূলে ভোর সোয়া ছ’টায় রবির কিরণ পূর্বাকাশে উঁকি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোরের সুর ‘রাগ পরমেশ্বরী’ পরিবেশনের মাধ্যমে নববর্ষকে স্বাগত জানাবে ছায়ানট। শিল্পী এবাদুল হক এ সময় প্রায় ১৫ মিনিট সেতারে এ সুর তুলবেন।
ছায়ানটের মিডিয়া সমন্বয়ক হেলাল আহমেদ জানান, এবারও রমনা বটমূলে বিশাল মঞ্চ প্রস্তুত করা হয়েছে। এ মঞ্চে পাঁচ সারিতে বসবেন ১৩০ জনের মতো কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পী। সম্মেলক পরিবেশনায় অংশ নেবেন ৯৫ জন গায়ক-গায়িকা। ছায়ানটের চতুর্থ ও পঞ্চম সমাপনী বর্ষের বাছাইকৃত শিক্ষার্থীরা গাইবে। থাকবে প্রারম্ভিক শিশু প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা। একক সঙ্গীত পরিবেশন করবেন খায়রুল আনাম শাকিল, মিতা হক, লাইসা আহমদ লিসা, চন্দনা মজুমদার, বিজন চন্দ্র মিস্ত্রী, নাসিমা শাহীন ফ্যান্সি, সুকান্ত চক্রবর্তী, সিফায়েতউল্লাহ মুকুল, বিমান চন্দ্র বিশ্বাসসহ ১৩ জন শিল্পী।
তিনি বলেন, দুই ঘণ্টাব্যাপী আয়োজনে ২৬টি গান পরিবেশিত হবে। এর মধ্যে সম্মেলক পরিবেশনা ১২টি। ১৩টি একক। আর থাকবে জাতীয়সঙ্গীত। প্রথমেই সম্মেলক কণ্ঠে শিল্পীরা গাইবেন-‘ও আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রী, এখানে থেমো না…’। বাকি গানগুলোতেও পাওয়া যাবে বর্ষ আবাহণের ইমেজ। রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়াও, নজরুল, লালন, সলিল চৌধুরী ও রশিদউদ্দীনের গান গেয়ে নববর্ষকে বরণ করে নেয়া হবে।
হেলাল বলেন, ছায়ানট এবার অনেক বছর পর ‘এসো হে বৈশাখ…’ গানটি গাইবে উৎসবে। এছাড়া অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করবেন আবদুস সবুর খান চৌধুরী ও লিয়াকত খান। সমকালীন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেবেন ছায়ানট সভাপতি সন্্জীদা খাতুন।
ছায়ানটের বর্ষ বরণ উৎসব শেষ হওয়ার পর পরই শুরু হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের এ আয়োজন এখন বর্ষবরণ উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। প্রস্তুতিও ব্যাপক। তবে এখন শেষ পর্যায়ে। রবিবার চরুকলা অনুষদে গিয়ে দেখা গেছে, পুরো চত্বর জুড়ে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা একত্রে কাজ করছেন। জয়নুল গ্যালারির সামনের খোলা জায়গায় টেবিল সাজিয়ে বসেছে শিক্ষার্থীরা। অনেকেই ব্যস্ত ছবি আঁকায়। শিক্ষকরাও তেল রং, জল রঙে ছবি আঁকছেন। বাকিরা মাটির সরায় আঁকছেন লোকজ জীবনের ছবি। পাশেই চলছে মুখোশ বানানোর কাজ। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ সব শিল্পকর্ম বিক্রি করে যে অর্থ পাওয়া যাবে তা দিয়েই আয়োজন করা হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এবারও শোভাযাত্রার অগ্রভাগে থাকবে বিশালাকৃতির ভাস্কর্য। চারুকলার লিচুতলায় বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে কাঠামো। ইতোমধ্যে আপন চেহারা পেয়েছে ছাগল ও ছাগল ছানা, মাছ, পাখি, হাতিসহ ৮টি ফোক মোটিভ।
মঙ্গল শোভাযাত্রার খুঁটিনাটি তুলে ধরে অনুষদের ডিন শিল্পী নেসার আহমদ বাসসকে বলেন, বর্তমান পারিপার্শিকতা বিবেচনা করে এবার আমরা প্রতিপাদ্য নির্বাচন করেছি-‘অনেক আলো জ্বালতে হবে মনের অন্ধকারে’।
তিনি বলেন, ধর্মান্ধরা বর্তমানে যা করছে, তার স্বরূপ তুলে ধরতে ২৫ ফুট উচু ‘হাতের পাঞ্জা’র একটি ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে। মৌলবাদী শক্তি যেভাবে অসাম্প্রদায়িক নিরীহ সাধারণ মানুষের গলা টিপে ধরছে, তা তুলে ধরা হবে এবারের এ ভাস্কর্যের মাধ্যমে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় ২৮ ফুট উচু টেপা পুতুল থাকবে, যার এক কোলে কলসি ও অন্য কোলে দেখা যাবে এক শিশু। এছাড়া দু’টি ছানাসহ মা ছাগলসহ অন্যান্য লোকজ মোটিভও দেখা যাবে শোভাযাত্রায়।
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র প্রাঙ্গণে চতুর্থবারের মতো চ্যানেল আই ও সুরের ধারা চৈত্র সংক্রান্তি ও বর্ষবরণেল আয়োজন করছে। বর্ষ বিদায়ের মাধ্যমে মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে ১৩ এপ্রিল বিকেলে সূর্যাস্তের সাথে পঞ্চকবির গানের মধ্য দিয়ে। চৈত্রসংক্রান্তি অনুষ্ঠান শেষ হবে রাত বারটায়। আর হাজারও কণ্ঠে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান শুরু হবে সূর্যোদয়ের সাথে।
চ্যানেল আই অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করবে। সারাদেশ ও প্রবাসী বাংলাভাষী এক হাজারেরও বেশি নির্বাচিত শিল্পী পরিবেশন করবেন এসো এসো হে বৈশাখ… গানটি। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার সার্বিক তত্ত্বাবধানে আয়োজন করা হয়েছে বর্ষবরণের এ আয়োজন। এবার উৎসব দুটির স্থিরচিত্র ধারণ করে রাখবে দৃক এর প্রায় ১০০ জন আলোকচিত্রী।
এদিকে মেলায় থাকবে বাঙালির হাজার বছরের বিভিন্ন ঐতিহ্যের উপাদান দিয়ে সাজানো স্টল। পিঠা-পুলি, মাটির তৈরি তৈজস, বেত, কাঁথা, পিতল, পাট-পাটজাত দ্রব্যের নানা জিনিসপত্রসহ রকমারি ও ঐতিহ্যসমৃদ্ধ নানা পণ্যে সুসজ্জিত থাকবে স্টলগুলো। বর্ষবরণ এ উৎসব চলবে পহেলা বৈশাখ দুপুর ১২টা পর্যন্ত। চ্যানেল আই’র পাশাপাশি ৭১ টেলিভিশন, পশ্চিম বঙ্গের রূপসী বাংলা টেলিভিশন ও রেডিও ভূমি এফএম ৯২.৮ সরাসরি সম্প্রচার করবে এ অনুষ্ঠান।