এখনো থামেনি স্বজনহারাদের কান্না
২৪ এপ্রিল ২০১৩ সালের এই দিনে সকাল পৌনে নয়টায় ধসে পড়ে সাভার বাসস্ট্যান্ডের পূর্বদিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশেই নয়তলা রানা প্লাজা ভবনটি।বহুতল ভবনটির ভূগর্ভস্থ তলায় মালিক যুবলীগ নেতা অফিস ও গাড়ি রাখার জায়গা, দ্বিতীয় তলার বিপণিকেন্দ্রে বহু দোকান ও তৃতীয় থেকে সপ্তম তলা পর্যন্ত ছিলো তিনটি তৈরি পোশাক কারখানা। বাকী দুটি তলা ছিলো খালি। এসব কারখানায় শ্রমিক ছিলো পাঁচ সহস্রাধিক।
২০০৭ সালে রানা প্লাজা নির্মাণ করার আগে জায়গাটি ছিল পরিত্যক্ত ডোবা। ভবন নির্মাণ করার আগে বালু ফেলে এটি ভরাট করা হয়। বিকট শব্দে ভবনের কয়েকটি তলা নিচে দেবে যায় এবং কিছু অংশ দক্ষিণ পশ্চিম দিকের একটি ভবনের ওপর আছড়ে পড়ে। বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ এ শিল্প দুর্ঘটনায় মারা যান ১ হাজার ১শ ৩৪ শ্রমিক। আহত হয় দুই হাজারের বেশি। যাদের অনেকেই এখনো ফিরতে পারেননি স্বাভাবিক জীবনে। অথচ আগের দিন ২৩ এপ্রিল কারখানায় ফাটল নিশ্চিত হবার পরও ভবন মালিক সোহেল রানা ও সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কবির হোসেন সরদারসহ প্রকৌশলী আব্দুর রাজ্জাক ভবনটিকে নিরাপদ ঘোষণা করেন। ভয়ে আতঙ্কে বেরিয়ে যাওয়া তৈরি পোশাক শ্রমিকদের পরের দিন মৃত্যুকূপ এ ভবনটিতে কাজে যোগ দিতে বাধ্য করে রীতিমতো ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়। প্রথম দিন থেকেই সাধারণ মানুষের স্বতস্ফূর্ত সহযোগিতার মধ্যে শুরু হয় উদ্ধার অভিযান। সেনাবাহিনীর নয় পদাতিক ডিভিশনের তত্বাবধানে চলে ব্যাপক পরিসরে উদ্ধার কাজ। চতুর্থ দিনের মাথায় ভারী যন্ত্রের মাধ্যমে গতি পায় উদ্ধারকাজ।
অভিযানের ১শ ঘন্টা পর জীবিত প্রাণের সন্ধান পাওয়া যায় ধ্বংস্তুপে। শাহিনা আক্তার নামের ওই তৈরি পোশাক শ্রমিককে জীবিত উদ্ধারের চেষ্টা নিয়ে নতুন করে আশায় বুক বাধেন উদ্ধারকারীরা। তবে সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে নিথর দেহ উদ্ধার করা হয় শাহিনার। আর শাহিনাকে উদ্ধার করতে গিয়ে মারা যান উদ্ধারকারী স্বেচ্ছাসেবক প্রকৌশলী এজাজ উদ্দিন আহমেদ কায়কোবাদ। শত মানুষের ভীড়ে এ দুটি মৃত্যুতে শোকে স্বব্ধ হয়ে পড়ে গোটা জাতি। অভিযানের ১৭ দিনের মাথায় ধ্বংসস্তুপ থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয় রেশমা নামের এক শ্রমিককে।বিষয়টি নিয়ে দেশে বিদেশে হৈচৈ পড়ে যায়। বিশ্ব তোলপাড় করা এ ঘটনাটিকে দেশের মধ্যে দৈনিক ‘আমার দেশ’ এবং লন্ডনের ‘ডেইলি মিরর’ সাজানো নাটক বলে উল্লেখ করলে শুরু হয়ে দেশে বিদেশে আলোচনা ও সমালোচনা। সংসদে-ও উত্তপ্ত বাদানুবাদে জড়িয়ে যায় সরকার ও বিরোধী দল। তবে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে রেশমাকে নিয়ে মিররের প্রতিবেদনটিকে মিথ্যা বলে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। ১৪ মে মিলাদ মাহফিলের মাধ্যমে শেষ হয় ২০ দিন ধরে চলা উদ্ধার অভিযান।
আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তুপ থেকে ১ হাজার ১১৫টি লাশ ও ২ হাজার ৪ শ’৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করার ঘোষণা করেন উদ্ধারকাজের সমন্বয়কারী সেনাবাহিনীর নয় পদাতিক ডিভিশনের জিওসি চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী বীর বিক্রম। বছরের মাঝামাঝি সময়ে রানা প্লাজা ধসে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে রানা প্লাজার সামনে নির্মান করা হয় বেদি। যেখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান নানা শ্রেনী পেশার মানুষ। এদিকে দুই বছর গড়িয়ে গেলেও শেষ হয়নি বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই শিল্প দুর্ঘটনার তদন্ত। তদন্তের ৯০ ভাগ শেষ করে এনেছে বলে জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি)। ইতোমধ্যে ভবন মালিক যুবলীগ নেতা সোহেল রানাসহ গ্রেপ্তার ২১ জনের মধ্যে সোহেল রানা বাদে সবাই জামিনে বেরিয়ে গেছেন ।
রানা প্লাজা ধসে মোট মামলা হয়েছে পাঁচটি। এর মধ্যে তিনটি ভবন ধসের ঘটনায়। ভবনের অন্যতম মালিক সোহেল রানার বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা হয়েছে অস্ত্র ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে। হত্যার অভিযোগে একমাত্র মামলাটি করেছেন নিহত একজন শ্রমিকের স্ত্রী।