ড্রাইভার জামিরের কেন এই গুরুদণ্ড?
বেপরোয়া গতিতে বাস চালিয়ে নরহত্যার অভিযোগে যাবজ্জীবন রায় দেওয়ার ঘটনা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসেই নয়, সম্ভবত ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে প্রথম ঘটনা হতে পারে। আদালত এ ঘটনাকে ‘সড়ক দুর্ঘটনা’ বলেননি। বরং আসামিপক্ষ এ ঘটনাকে সড়ক দুর্ঘটনা হিসেবে চিত্রিত করতে চেয়েছিল। আদালতের পরিভাষায় এটা হলো ‘কালপাবল হোমিসাইড নট অ্যামাউন্টিং টু মার্ডার।’ এর মানে হলো, ‘দণ্ডনীয় নরহত্যা, কিন্তু খুন নয়।’ এ ঘটনা আমাদের চেনা-জানা অর্থে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নয়। দণ্ডবিধির যে বিধির আওতায় খুনখারাবির বিচার হয়, সেই ধারাটিই এবার প্রয়োগ করা সম্ভব হয়েছে। এর মূল কারণ হলো আদালতে বাদীপক্ষ প্রমাণ করেছে যে কোনো ঘাতক যখন বন্দুক হাতে কাউকে গুলি করে হত্যা করে, সেভাবে ঘাতক বাসটির চালক তাঁর বাসটিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বন্দুক দিয়ে মানুষ মারা যায়। বাস দিয়েও মানুষ মারা যায়। তাই বন্দুক দিয়ে মারলে খুনের সাজা। আবার বাস দিয়ে মারলেও খুনের সাজা। বাসচালক এতটাই বেপরোয়া ছিলেন যে তাঁকে ছুটে যেতেই হবে। সামনে যা-ই পড়ুক, তাতে তাঁর কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। সুতরাং তিনি যা করেছেন, তাতে তাঁর খুনে ‘ইনটেনশন’ পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। মানুষ খুন করাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। উদ্দেশ্য এটাও ছিল যে সামনে মানুষ পড়ুক বা অন্য কোনো জীবজন্তু পড়ুক, কিছুতেই তাঁর কিছু যায়-আসে না, মানুষ পড়লে মরবে, কেউ আহত হলে হবে। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারাটিতে একটি সংশোধনী এনে বিষয়টি আরও বেশি স্পষ্ট করা হয়েছে।
আমাদের দেশে খুনের মামলার আসামিকে অনেক সময় ৩০৪ ধারায় ফেলে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। কারণ, ৩০২ ধারায় কারও অপরাধ প্রমাণিত হলে তাকে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন দিতে হয়। কিন্তু কখনো একই হত্যাকাণ্ডের সহ-অভিযুক্তকে অপেক্ষাকৃত লঘু সাজা দিতে হয়, তখনই ৩০৪ ধারাটি প্রয়োগ করা হয়। হয়তো এই প্রথম সরাসরি খুনের মামলা না হয়েও খুনের দায়েই সাজা হয়েছে। কিন্তু আমাদের সড়কে যে ‘কালপাবল হোমিসাইড’ চলে আসছে, এটা তার লাগাম টানবে কি? এই যুগান্তকারী রায়ের ফলে মালিক ও চালকদের ওপর একটা চিলিং এফেক্ট বা নিস্তেজক প্রভাব আশা করা যায় কি? আমরা এটা ভাবতে পারলে বেশি আশ্বস্ত হতাম যে যাদের বড় কোনো পরিচিতি নেই, যারা অজানা-অচেনা, সেই সব মানুষ, যারা কালপাবল হোমিসাইডের শিকার হয়েছে, তাদের স্বজনেরা নতুন আশায় বুক বাঁধবে। তারা ভাবতে বসবে যে তাদের মামলার বিচারকার্যও বুঝি এবার ত্বরান্বিত হবে। তবে এই রায় যে সড়ক পরিবহন খাতের মুঘলদের এত দিনকার ভাবনাচিন্তায় বিরাট একটা ঝাঁকুনি দেবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এই রায়ের বিরুদ্ধে যে আপিল হবে, তাতে নিম্ন আদালতের রায় টিকবে, সেটাই আশা করবেন বিচারপ্রার্থীরা। আপিলে সাজা বহাল থাকতে পারে, আবার অনধিক ১০ বছরের মধ্যে যেকোনো একটি মেয়াদে সাজা হ্রাস হলেও হতে পারে। তবে এই রায় স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে এ ক্ষেত্রে আমাদের সাজার নীতি কী হবে, সেটি অবিলম্বে পুনর্নির্ধারণ হওয়া আবশ্যক।
২২ ফেব্রুয়ারি ইলিয়াস কাঞ্চন সময় টিভিতে বলছিলেন, কী করে এরশাদের একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলের গাড়ি ছড়াকার বাপি শাহরিয়ারকে চাপা দিয়ে মেরে ফেলার পর সাজার মেয়াদ কমানো হয়েছিল। প্রচলিত আইনে এখন আর ফুটনোটে যত্নের ছাপ মেলে না। তাই বোঝা যায় না কখন কী বিধান ছিল আর কখন তাতে কী পরিবর্তন আনা হয়েছে। ১৯৮৩ সালের মোটর ভেহিক্যালস অ্যাক্টে দেখলাম, রেকলেস বা বেপরোয়া গাড়ি চালানোর জন্য ১৯৯০ সালের আগেও এক বছর সাজার বিধান ছিল। সেই সাজা আদৌ কেউ না পেলে আমরা অবাক হব না। অথচ ১৯৯০ সালের এক সংশোধনীতে (সম্ভবত এরশাদ আমলেই হবে) সেই এক বছরের সাজা কমিয়ে ছয় মাস করা হয়েছে। জরিমানার টাকা কমিয়ে ৫০০ করা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি, যেখানে বেপরোয়া গাড়ি চালানোর দায়ে হরহামেশা ৫০০ টাকার জরিমানা আদায় করা সম্ভব হয়। তবু এটা শুনে ভালো লাগছে যে মিশুক মুনীরদের ঘটনায় উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ চেয়ে দায়ের করা একটি মামলা হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে।
বাংলাদেশ বিশ্বের সড়ক দুর্ঘটনাপ্রবণ দেশগুলোর একটি। এ দেশে প্রায় নিয়মিত বেপরোয়া মোটরযান চলাচল এবং তাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকে, কিন্তু বিচার হয় না। সেই দেশে হঠাৎ করে একজন চালকের যাবজ্জীবন সাজা লাভের ঘটনা সত্যি নজিরবিহীন। সাধারণ মানুষ এবং বিশেষ করে ভুক্তভোগীদের পরিবারগুলো কি আশা করতে শুরু করবে যে দেশে নিয়ম বদলেছে? সড়কে বিচারহীনতার অবসান ঘটেছে?
চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ, সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ পাঁচজনকে হত্যার দায়ে পুলিশ প্রথমে যে এজাহার দায়ের করেছিল, তা ছিল দণ্ডবিধির ৩০৪(খ)-এর অধীনে, যার শাস্তি মাত্র তিন বছর। এই মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার খান খালিদ আদনান আমাকে বলেছেন, ‘অভিযোগপত্র দাখিলকারী কর্মকর্তা বাসচালক জামির হোসেন ওরফে জমিরের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারার আওতায় তাঁকে অভিযুক্ত করেন।’
৩০৪ ধারাটির দুটি ভাগ রয়েছে। প্রথম ভাগে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তার সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন। এবং দ্বিতীয় ভাগে দোষী সাব্যস্ত হলে অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড।
জামিরের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে, তার মধ্যে প্রথমত ঘাতক বাসটির গতিনিয়ন্ত্রক যন্ত্রটি বিকল ছিল। আদালতে বিআরটিএর রিপোর্টে বলা হয়েছে, স্পিড গভর্নর সিল ‘টেম্পার’ করা হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, তাঁর গাড়ি চালনার ছাড়পত্র বা ড্রাইভিং লাইসেন্সের মেয়াদ ২০০৮ সালে শেষ হয়ে গিয়েছিল। এরপর তিনি নবায়নের জন্য কথিতমতে যে দরখাস্ত দাখিল করেছিলেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে বিআরটিএ তাঁকে একটি স্লিপ দিয়েছিল। কিন্তু আদালতে প্রমাণিত হয়েছে, ওই স্লিপটি ভুয়া ছিল। তৃতীয়ত, বাসের ফিটনেস সনদ মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল। চতুর্থত, ঘটনার দিন চালক অতিরিক্ত কাজ করার ঝুঁকি নিয়েছিলেন। ওই দিন ভোর চারটায় চুয়াডাঙ্গা থেকে বাস নিয়ে ঢাকায় পৌঁছান সকাল সোয়া ১০টার দিকে, কিন্তু সকাল সাড়ে ১০টায়ই তিনি পুনরায় চুয়াডাঙ্গার উদ্দেশে যাত্রীবোঝাই গাড়ি নিয়ে রওনা দেন। সুতরাং তাঁর বিশ্রামের ঘাটতি ছিল। পঞ্চমত, ঘটনার দিনটিতে বৃষ্টি হচ্ছিল এবং ঘটনাস্থলের ঠিক আগেই দুটি বাঁক ছিল। শেষের বাঁকটি পেরোনোর সময় চালক তাঁর গাড়িটিকে রীতিমতো একটি আগ্নেয়াস্ত্রে পরিণত করেন। তিনি সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে একটি চলমান মিনিবাসকে বিপজ্জনকভাবে ওভারটেক করেন। আর এই ওভারটেক করতে গিয়েই তিনি তারেক মাসুদদের বহনকারী মাইক্রোবাসটির ডান দিকে সজোরে আঘাত হানেন। তাঁর গাড়ির গতিবেগ এতটাই বেশি ছিল যে আদনানের নিবেদনমতে, ঘাতক বাসটি ১২৬ ফুট দূরে গিয়ে পরপর তিনটি গাছে বাড়ি খেয়ে তবে থেমে যায়। মিশুকদের ১০ জন যাত্রী বহনকারী মাইক্রোবাসটির ডান দিকে থাকা ৫ জন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। তাঁদের কাউকেই হাসপাতালে নেওয়ার সুযোগও পাওয়া যায়নি। ক্যাথরিন মাসুদসহ অন্য ৫ জন অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছেন। অন্যদিকে, আসামিপক্ষের আইনজীবীর ভাষ্য ছিল, মিশুকদের বহনকারী গাড়ির চালকের দোষেই এ ‘দুর্ঘটনা’ ঘটেছে। তিনি রং সাইড দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। এর সপক্ষে দুজন প্রত্যক্ষদর্শীও হাজির করা হয়েছিল।
এখন প্রশ্ন হলো, ঘাতক বাসটি দিয়ে পাঁচজনের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার ঘটনায় চালকের ওপরেই সব দায়দায়িত্ব বর্তায় কি না।
আমি রায় ঘোষণার পর ঘাতক বাসটি যে ব্যানারে (চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স) চলাচল করত, তার মালিক মজিবুল হক খোকনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলি। ১৯৭৩ সাল থেকে তাঁরা গাড়ির ব্যবসায় আছেন। তিনি জানালেন, গাড়িটির মালিক তিনি ছিলেন না। তবে ওই চালককে তিনিই নিয়োগ দিয়েছিলেন। ঘাতক বাসটির মালিক জাহাঙ্গীর কবির তুহিন। তিনি ঝিনাইদহের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গাড়িটি কিনেছিলেন। খোকনের কথায়, দুর্ঘটনার দুই বছর আগে জাপানি হিনো গাড়ির একমাত্র আমদানিকারক নাভানা লিমিটেড থেকে গাড়িটি কেনা হয়েছিল।
এ তথ্য সত্য হলে গাড়ির নির্ধারিত গতিসীমার বাইরে চালানোর জন্য স্পিড গভর্নর বিনষ্ট বা বিকৃত করে ফেলা একটি ভয়ংকর সিদ্ধান্ত বলেই প্রতীয়মান হয়। এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে খোকন দাবি করেছেন, মোটর ভেহিক্যালস আইনের আওতায় যে পরিদর্শক রয়েছেন, তাঁর দেওয়া প্রতিবেদনে (এমভিআই রিপোর্ট) ওই গাড়ির কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল না। ড্রাইভিং লাইসেন্সের বৈধতা না থাকা প্রসঙ্গে খোকন বলেন, ‘বিআরটিএর সিলছাপ্পর মারা কাগজ আমাদের হাতে ছিল। আর তাদের কর্মকর্তাদের নমুনা স্বাক্ষর আমাদের কাছে থাকে না। সুতরাং ঠিক-বেঠিক আমরা যাচাই করতে পারি না।’
এরপর গাড়ির ফিটনেস থাকার দায় কার জানতে চাইলে তিনি বলেন, মালিকের। কিন্তু পরে যখন ফিটনেস না থাকার দায় কেন শুধু চালকের কাঁধে বর্তাবে জানতে চাওয়া হলো, তখন তিনি সুর পাল্টান। তিনি বলেন, ফিটনেস সার্টিফিকেট হালনাগাদ করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন ছিল। কিন্তু দুর্ঘটনার তারিখে এটি হালনাগাদ করা ছিল না।
তখন তাঁকে প্রশ্ন করি, যখন এটা ছিল না, তখন তার দায় কেন চালক একা নেবেন? তখন তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে বিআরটিএর নিয়ম রয়েছে। এ দায়টা কে নেবে, চালক না মালিক, এই মুহূর্তে তা বলতে পারব না।’
তবে তিনি নিশ্চিত করেন যে দুর্ঘটনার তিন মাস পরে গাড়িটি মেরামত করে আবার রাস্তায় চলতে শুরু করেছে। তবে এবার চুয়াডাঙ্গার ডিলাক্স পরিবহনের নয়, ঝিনাইদহের ঝিনুক পরিবহনের ব্যানারে।
এই মামলাটির মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা কিছু প্রশ্নের অন্তত একটা স্থায়ী সুরাহা হোক, সেই আশা করি। রায়টির নির্মোহ পর্যালোচনা অব্যাহত রাখা দরকার। আমরা আপাতত এই মাইলফলক মামলাটির পূর্ণাঙ্গ রায়ের অপেক্ষায় থাকলাম।