বন্যা পরিস্থিতি সিলেট-মৌলভীবাজারে পানি কমছে, উত্তরে উল্টো চিত্র
বৃষ্টিপাত কমে আসায় সিলেট ও মৌলভীবাজারে গত বৃহস্পতি ও গতকাল শুক্রবার সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে পানি কিছুটা কমেছে। তবে দেশের উত্তরাঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনায় পানি অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকায় পাঁচ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে।
বন্যার পানিতে ডুবে বৃহস্পতিবার সিরাজগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের জুড়ীতে দুই শিশু মারা গেছে। মৌলভীবাজারে বন্যাকবলিত এলাকায় রোগব্যাধির প্রকোপ বাড়ছে। জেলার রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও ইউনিয়নের কাউয়াদীঘি হাওরপারের আমিরপুর গ্রামে চার দিনের ব্যবধানে জ্বরে আক্রান্ত দুটি শিশু মারা গেছে। তারা হলো আমিরপুর গ্রামের রুকু উদ্দিনের মেয়ে তামান্না বেগম (১০) এবং কুটি মিয়ার মেয়ে রুমা বেগম (১৪)। তারা দুজনই চার-পাঁচ দিন ধরে জ্বরে ভুগছিল। তামান্নাকে গত সোমবার রাতে হাসপাতালে নেওয়ার পথে সে মারা যায়। রুমাকে গত বুধবার রাতে মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা তাকে বাড়ি নিয়ে আসার পথে সে মারা গেছে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, গতকাল বেলা পাঁচটায় সুরমার পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৩ দশমিক ৬৯ সেন্টিমিটার এবং সিলেট পয়েন্টে ১১ দশমিক ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। অন্যদিকে কুশিয়ারার পানি অমলশিদ পয়েন্টে ১৬ দশমিক ৪৯ সেন্টিমিটার, শেওলা পয়েন্টে ১৪ দশমিক ১৪ সেন্টিমিটার ও শেরপুর পয়েন্টে ৯ দশমিক ০১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
আগামী কয়েক দিনে পরিস্থিতির আরও উন্নতির আশা করছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. রাহাত আনোয়ার। তিনি বলেন, আবহাওয়া ভালো থাকায় পানি কমতে শুরু করেছে। তবে এ সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, পানি কমতে থাকলে স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ মানুষের ভোগান্তি বাড়ে। জেলা প্রশাসন এটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে।
এদিকে সিলেটে বন্যাকবলিত এলাকায় সরকারি ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম হচ্ছে—বিএনপির এমন অভিযোগকে ‘অবাস্তব কথা’ বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। গতকাল বিকেলে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুরে ত্রাণসামগ্রী বিতরণকালে তিনি এ কথা বলেন। এর আগে অনুষ্ঠিত সংক্ষিপ্ত সভায় অন্যান্যের মধ্যে স্থানীয় সাংসদ মাহমুদ-উস সামাদ চৌধুরী, সাংসদ আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদরউদ্দিন আহমদ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী বক্তব্য দেন।
মৌলভীবাজারেও বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। জেলার হাকালুকি হাওরপারের সুজানগর ইউপির চেয়ারম্যান মো. নছিব আলী গতকাল বলেন, গত তিন দিনে এ এলাকায় অন্তত ছয় ইঞ্চি পানি কমছে।
মৌলভীবাজার পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী বিজয় ইন্দ্র শংকর চক্রবর্তী গতকাল বলেন, কুশিয়ারায় এখন বিপৎসীমার মাত্র দুই সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারার পানি কমায় হাকালুকির পানিও কমতে শুরু করেছে।
মৌলভীবাজারের জুড়ীতে বন্যার পানিতে ডুবে গত বৃহস্পতিবার সামী আহমদ (৬) নামের এক শিশু মারা গেছে। সে উপজেলার পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়নের পশ্চিম আমতৈল গ্রামের সালাউদ্দিনের ছেলে। সামী বিকেলের দিকে বাড়ির পাশে বন্যার পানিতে ডুবে যায়। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে কুলাউড়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থল যান। তাঁরা প্রায় এক ঘণ্টার চেষ্টায় লাশ উদ্ধার করেন।
উত্তরাঞ্চলে পানি বাড়ছে
বন্যা পরিস্থিতির উল্টো চিত্র দেশের উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলা কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর ও সিরাজগঞ্জে। যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার এসব জেলার নতুন নতুন এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে। এর কারণ, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রে অব্যাহতভাবে পানি বৃদ্ধি। এ দুই নদ-নদীর কয়েকটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে।
কুড়িগ্রাম পাউবোর সূত্র বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের চিলমারী পয়েন্টে ১৬ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার দশমিক ১৪ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধরলার পানি ধরলাব্রিজ পয়েন্টে ৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া দুধকুমার নদের নুনখাওয়া পয়েন্ট ও কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি অব্যাহতভাবে বাড়ছে।
জেলার নাগেশ্বরী, উলিপুর, রৌমারী, চিলমারী ও ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় বন্যায় প্রায় ছয় হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়েছে। তবে জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মো. ফেরদৌস খান বলেন, এলাকার মানুষ বন্যা পরিস্থিতির সঙ্গে বহুকাল ধরে খাপ খাইয়ে চলছে। এখনো আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু হয়নি।
গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার সুন্দরগঞ্জ, সদর, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলায় নদীতীরবর্তী চরাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
গাইবান্ধা পাউবোর সূত্র জানায়, গতকাল বিকেলে যমুনার পানি ফুলছড়ি পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। জেলায় ব্রহ্মপুত্র নদ ও তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেও তা বিপৎসীমার নিচে ছিল।
গতকাল দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, ফুলছড়ি উপজেলার উদাখালি, উড়িয়া ও কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের নদীতীরবর্তী চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। উড়িয়া ইউপির চেয়ারম্যান মাহাতাব উদ্দিন মুঠোফোনে বলেন, চরাঞ্চলের অনেক ঘরেই পানি উঠেছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বগুড়ার সারিয়াকান্দি পয়েন্টে যমুনা নদীতে গতকাল সকাল ছয়টায় ১৬ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার পানিপ্রবাহ রেকর্ড করেছে পাউবো। সে হিসেবে ২৪ ঘণ্টায় ১৫ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে সেখানে পানি বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
জেলায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে নদীতীরবর্তী ও চরাঞ্চলের অন্তত ২০ হাজার মানুষ। বাড়িঘর ছেড়ে মানুষজনের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে এসে আশ্রয় নেওয়া অব্যাহত রয়েছে।
চর কাজলা ইউপির চেয়ারম্যান রাশেদ মোশারফ বলেন, কাজলার চরের বেড়া পাঁচবাড়িয়া, উত্তর ও দক্ষিণ বেনীপুর, উত্তর টেংরাকুরা, কাজলা, পাকুরিয়া, কুড়িপাড়াসহ বেশ কিছু নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
ধুনট উপজেলার ভান্ডারবাড়ি ইউপির চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন বলেন, এই এলাকার মাধবডাঙ্গা, ভূতবাড়ি, পুকুরিয়া, কৈয়াগাড়ি, বানিয়াজান, শিমুলবাড়ি, রাধানগর, বৈশাখী, শহড়াবাড়িসহ কয়েকটি গ্রামে পানি ঢুকতে শুরু করছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে কয়েকটি গ্রামের প্রায় দুই হাজার পরিবার।
রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির বগুড়া ইউনিট দুর্গত এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। গতকাল তারা সারিয়াকান্দির ৩৬৭ পরিবারের মধ্যে ১৮ লাখ ৩৫ হাজার টাকা বিতরণ করে।
জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে পানি বেড়ে গতকাল বেলা সাড়ে তিনটার দিকে বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। জেলার ইসলামপুর উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ইউনিয়নগুলো হলে চিনাডুলী, কুলকান্দি, বেলগাছা, সাপধরী ও নোয়ারপাড়া। গুঠাইল এলাকার বাসিন্দা দেলুয়ার হোসেন বলেন, যমুনার পানি হু হু করে বাড়তে শুরু করেছে। এই এলাকার প্রায় তিন হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। অনেকে ঘরে থাকা ধান-চাল সরানোর সময়ও পায়নি।
সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি বৃদ্ধি পেয়ে গতকাল বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। জেলার কাজীপুর, সিরাজগঞ্জ সদর, বেলকুচি, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলার চরাঞ্চলের ২৭টি এবং নদীতীরবর্তী আরও ১০ ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে।
বন্যার পানিতে ডুবে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শাহজাদপুরের চর কৈজুরী গ্রামের শান্তনা (৬) নামের এক শিশু মারা যায়।