বাংলা একাডেমী হবে জাতিসত্তার পরিচয়ের প্রতীক : স্বাধীন দেশে প্রথম সাহিত্য সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু
‘দেশ স্বাধীনের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাংলা একাডেমীর দুটি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। স্বাধীনতার পর একুশের এক অনুষ্ঠানে। সেই অনুষ্ঠানে তিনি বাঙালির সাংস্কৃতিক শক্তির পরিচয়টাকে বিশ্লেষণ করেছিলেন জনজীবনের রাজনৈতিক চেতনার সঙ্গে এক করে। লেখক ও সংস্কৃতিসেবীদের সেই জনজীবনের রূপকার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।’
কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন তার ‘বঙ্গবন্ধুর সংস্কৃতি চিন্তা’ প্রবন্ধে একথা উল্লেখ করে বলেন, দ্বিতীয় বার তিনি বাংলা একাডেমীতে আসলেন একটি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে। সেখানে তিনি বললেন, ‘সাহিত্য জাতির জীবন-পরিচর্যার সামগ্রিক চিত্র প্রতিফলিত করে। সাহিত্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিত লাভ করলে দেশের মর্যাদা ও গৌরব বৃদ্ধি পায়। শিল্প-সাহিত্য খেলাধুলা ইত্যাদির মাধ্যমেই দেশের সৃজনশীলতার পরিচয়কে উজ্জ্বল করে তুলতে পারে। বাংলা একাডেমী হবে জাতিসত্তার প্রতীক।’ এভাবে সুদূরপ্রসারী জ্ঞানচিন্তায় বঙ্গবন্ধু বাংলা একাডেমীর ভূমিকা কী হবে তা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন। সামগ্রিকভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বাংলা একাডেমীর কিভাবে জাতিসত্তার পরিচয়ের প্রতীক হবে।’
১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমীর আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে অতিথি করার জন্যে একাডেমীর তৎকালীন মহাপরিচালক অধ্যাপক মযহারুল ইসলাম ও কর্মকতা শামসুজ্জাম খান বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে যান। এ ব্যাপারে শামসুজ্জমান খানের লেখার উদ্ধৃতি দিয়ে সেলিনা হোসেন তার প্রবন্ধে আরও লিখেন ‘বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক অধ্যাপক মযহারুল ইসলামসহ তারা কয়েকজন ১৯৭৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টায় বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘বলুন প্রফেসর সাহেব কি মনে করে এলেন।’ ড. ইসলাম বললেন, বঙ্গবন্ধু আমরা বাংলা একাডেমী থেকে একটি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন করছি, বিভিন্ন দেশ থেকে বিখ্যাত সাহিত্যিকরা আসবেন। আপনাকে সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে পেতে চাই। বঙ্গবন্ধু আকাশ থেকে পড়লেন। তাঁর প্রত্যুত্তর, ‘আমি সাহিত্যের কি বুঝি? আমি কি বলবো। একজন প্রবীণ ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক বা পন্ডিতকে দিয়ে এ কাজ করান, সম্মেলনের মর্যাদা বাড়বে। আগে তো তাই হতো। ছাত্র জীবনে দু’একবার সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিয়েছি। কই, রাজনৈতিক নেতারা তার উদ্বোধন করেছেন বলে মনে পড়ে না।’ এই কথা বলে বঙ্গবন্ধু হাসলেন। পরিস্থিতিকে একটু সহজ করার জন্য বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি রবীন্দ্রনাথ পড়ি, ভালবাসি তাঁকে-সাহিত্যে আমার পুঁজি তো ওইটুকুই। এই পুঁজি নিয়ে দেশ-বিদেশের বড় বড় সাহিত্যিক-শিল্পীদের মধ্যে যেতে আমি সংকোচবোধ করছি।’
মযহারুল ইসলাম বললেন, এটা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন। আপনি সম্মেলন উদ্বোধন করলে তা আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করবে। তা ছাড়া গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের প্রশ্নে আপনার সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রতিফলন ঘটবে। এ কথা শোনে বঙ্গবন্ধু একটু ভাবলেন। বললেন, ‘ঠিক আছে যাব। আমার বন্ধু জসীমউদ্দিন ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকেও বিশেষ মর্যাদায় আমন্ত্রণ জানাবেন।’ এই বক্তব্যের মাধ্যমেও বঙ্গবন্ধু দেশের সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিবর্গকে কতখানি সম্মানের চোখে দেখতেন- তা প্রকাশ পায় বলে সেলিনা হোসেন উল্লেখ করেন। ’
উল্লেখ্য, একাডেমীর এই সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের কথাসাহিত্যিক আনোয়ার আলিমঝানভ ও মরিয়ম সালগানিকসহ কয়েকজন। পূর্বজার্মান থেকে কথাসাহিত্যিক মি.পি হাসপাতার, ভারত থেকে মুলকরাজ আনন্দ, অন্নদাশংকর রায়, ড. নীহাররঞ্জন রায়, ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়সহ কয়েকজন লেখক।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এই সাহিত্য সম্মেলন সম্পর্কে লিখেছেন, ‘মযহারুল ইসলামের সময়ে বাংলা একাডেমীর উদযোগে বড় রকমের এক সাহিত্য সম্মেলন হয়। বঙ্গবন্ধু এটি উদ্বোধন করেন। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের অনেক বিখ্যাত লেখকরা এতে যোগ দেন। আমি একটা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করি। বঙ্গবন্ধু তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে সাহিত্যিকরা যে দেশের শিল্প-সংস্কৃতিকে লালন করে আন্তর্জাতিকভাবে জাতিকে পরিচিতি করেন- সে বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন এবং বাংলা একাডেমীর ভবিষ্যত কর্মপন্থা নিয়েও কথা বলেন।’