বন্যায় ৩৭ জনের মৃত্যু, ২ হাজার স্কুল বন্ধ
*কুড়িগ্রামে বন্যায় এ পর্যন্ত ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। রোববার পর্যন্ত এ জেলায় মৃতের সংখ্যা ছিল তিনজন
* বিভিন্ন জায়গায় লাইনের ওপর দিয়ে পানির স্রোত থাকায় জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে
বন্যায় গতকাল মঙ্গলবার আরও তিন জেলায় ১১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ নিয়ে গত তিন দিনে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ৩৭। কুড়িগ্রামের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কলমাকান্দা ও দুর্গাপুরের সঙ্গে নেত্রকোনা জেলা শহরসহ সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। শুধু রংপুর বিভাগেই এক হাজারের বেশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ আছে।
২০ জেলার আশ্রয়কেন্দ্র, সড়কে ও উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে মানুষ। তবে খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও শৌচাগারের সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে জ্বর, সর্দি, কাশিসহ পানিবাহিত রোগ।
কুড়িগ্রামে বন্যায় এ পর্যন্ত ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। রোববার পর্যন্ত এ জেলায় মৃতের সংখ্যা ছিল তিনজন। গত সোমবার মারা গেছেন ফুলবাড়ীর ঘোগারকুটি এলাকার রইচ উদ্দিনের স্ত্রী হালিমা বেগম (৩৫) ও ভাঙ্গামোড় ইউনিয়নের নজরমামুদ গ্রামের আজাহার আলী (৭০), নাগেশ্বরীর রায়গঞ্জে মিজানুরের প্রতিবন্ধী ছেলে আবদুল করিম ওরফে মনসুর (১৪) ও ফান্দের চর জামাল গ্রামের প্রতিবন্ধী ফুলবানু (৩১), ভূরুঙ্গামারীর দেওয়ানের খামার এলাকার মজিবর রহমান (১৮) ও উলিপুরের ফকিরপাড়া এলাকার অজ্ঞাত এক ব্যক্তি (৬৫)। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এ খবর নিশ্চিত করেছেন।
এ ছাড়া কুড়িগ্রাম সদরের খামার হলোখানা এলাকার অলিউর রহমানের স্ত্রী জ্যোৎস্না বেগম (২৫) সাপের কামড়ে, পৌরসভার ভেলাকোপা এলাকার দুলু মিয়ার ছেলে বাবু (দেড় বছর) পানিতে ডুবে, ফুলবাড়ী সদর ইউনিয়নের প্রাণকৃষ্ণ গ্রামের লুৎফর রহমান (৩৫) মাছ মারতে গিয়ে পানিতে ডুবে এবং গোড়কমণ্ডল বস্তি গ্রামের হযরত আলী (৫৫) ঘরে আকস্মিক পানি ঢোকায় আতঙ্কে মারা গেছেন। রাজারহাটের ছিনাই ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান সাদেকুল হক জানান, কালুয়ারচর ওয়াপদা বাঁধ রাতে ভেঙে যাওয়ার সময় রিফাত (১০) ও লোকমানের স্ত্রী ফাতেমা (৩২) পানির তোড়ে ভেসে গেছেন। তবে জেলা প্রশাসনের ত্রাণ দপ্তর ১০ জন মারা যাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে।
এদিকে গতকাল সকালে ঠাকুরগাঁওয়ে ডিসিপাড়া থেকে পানি নেমে যাওয়ায় পর লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া ঘরের চালা সরাতে গিয়ে রিয়াদ (২০) নামে এক তরুণের মরদেহ নজরে পড়ে। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা রিয়াদের মরদেহটি উদ্ধার করেন। বন্যার পানির তোড়ে গত শনিবার দুপুরে বাড়িটি ধসে পড়ে। সিরাজগঞ্জের চৌহালীর কান্দা ঘোরজান গ্রামের আবদুর রশিদের স্ত্রী কদবানু (৫২) গতকাল সাপের কামড়ে মারা গেছেন।
কুড়িগ্রাম-তিস্তা রেলপথে টগরাইহাট নামক এলাকার বড়পুল সেতুর গার্ডার দেবে গিয়ে কুড়িগ্রামের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ধরলার স্রোতে কুড়িগ্রাম-ভূরুঙ্গামারী ও কুড়িগ্রাম-ফুলবাড়ী এই দুই সড়কের চারটি স্থান ভেঙে গেছে। তিন উপজেলার সঙ্গে জেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। তবে কুড়িগ্রাম-রংপুর মহাসড়কের ওপর পানিপ্রবাহ বন্ধ হওয়ায় এই সড়কে স্বল্প পরিসরে বাস চলাচল শুরু হয়েছে।
জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার দুরমুঠ এলাকা ও দেওয়ানগঞ্জ রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন জায়গায় লাইনের ওপর দিয়ে পানির স্রোত থাকায় জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
এদিকে ঠাকুরগাঁও রেলস্টেশন সূত্রে জানা গেছে, টানা বর্ষণ আর উজানের ঢলে প্লাবিত হয়েছে পঞ্চগড়-দিনাজপুর-পার্বতীপুর রুটের রেললাইন। প্রবল স্রোতের তোড়ে নয়নিবুরুজ স্টেশন থেকে কিসমত স্টেশন পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার রেলপথের পাথর ও মাটি সরে গেছে। এতে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ের সঙ্গে দিনাজপুরের রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
বিদ্যালয় বন্ধ
রংপুর বিভাগের আট জেলায় ১ হাজার ৩১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে ৭০০ মেডিকেল টিম বন্যাদুর্গত এলাকায় কাজ করছে। রংপুর স্বাস্থ্য বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মোজাম্মেল হোসেন ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মাহবুব এলাহী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। জামালপুরে ৮৭৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বগুড়ার তিন উপজেলার ৮২টি বিদ্যালয়ে পানি ওঠায় কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর পাঠদান বন্ধ রয়েছে।
পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ
কুড়িগ্রামে বন্যায় দুর্ভোগে পড়েছে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মানুষ। সিরাজগঞ্জে সাড়ে ৩ লাখ মানুষ পানিবন্দী। গাইবান্ধার পাঁচ উপজেলায় ২ লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। তারা বাঁধ ও উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। রংপুরের আট উপজেলায় সোয়া ২ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
রংপুর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ফরিদুল হক গতকাল বলেন, জেলার আট উপজেলায় প্রায় ২ লাখ ২২ হাজার ৫২৫ মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নওগাঁর আত্রাই ও ছোট যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং নতুন করে আরও তিনটি স্থানে নদীর তীর রক্ষা বাঁধ ভেঙে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা।
বন্যায় জামালপুরে কয়েক লাখ মানুষ ঘরছাড়া হলেও পুরো জেলায় পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়নি। আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় অনেক দুর্গত মানুষ রাস্তায় ও বাঁধের ওপর বসবাস করছে। দুর্গত এলাকায় শুকনো জায়গা না থাকায় আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে মানুষ।
ক্ষোভ প্রকাশ করে বন্যাদুর্গত এলাকার মমেনা বেগম বলেন, ‘দুই দিন হলো পাকশাক নাই। গেদা-গেদি নিয়ে কেমনে চলব! কয়েটা টাকার চিড়া-মুড়ি নিয়ে কি চলে। এত বড় বন্যা কেউ খুঁজ লয়ল না!’ সরকারি হিসাবে সোমবার পর্যন্ত বগুড়ায় ১৪টি ইউনিয়নের ১৯৫টি গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় প্রায় ২৬ হাজার পরিবারের সোয়া লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে