চালের দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে, আরও বাড়বে
চালের দাম সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে দাম। চালের মজুত এখন নাজুক পর্যায়ে আছে। সরকার চাল সংগ্রহে নানা উদ্যোগ নিলেও তা কাজে আসছে না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম আরও বাড়বে।
খাদ্য অধিদপ্তরের গুদামে যেখানে ন্যূনতম ছয় লাখ টন চাল থাকার কথা, সেখানে আছে মাত্র সোয়া তিন লাখ টন। দেশের চালকলমালিক ও কয়েকটি দেশের সঙ্গে একের পর এক চুক্তি করেও খাদ্য মন্ত্রণালয় মজুত বাড়াতে পারেনি। বেসরকারি চালকলমালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছে কত চাল আছে, তা জানার জন্য ২০১৩ সালে খাদ্য মজুত নিয়ে একটি আইন করেছিল সরকার। ওই আইন অনুযায়ী প্রতি মাসে বেসরকারি খাতের মজুতের হিসাব খাদ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে থাকার কথা। কিন্তু চার বছরেও ওই হিসাব নিতে পারেনি তারা। খাদ্যমন্ত্রী ও খাদ্যসচিব প্রথম আলোকে বলেছেন, মজুতের পরিমাণ তাঁরা জানেন না।
এই পরিস্থিতিতে যখন চালের দাম প্রতি সপ্তাহে বাড়ছে, তখন খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নিজেরাই বিস্মিত। দায় এড়িয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয় এ জন্য সরাসরি দুষছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে। তাদের দাবি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তদারকির অভাবেই চালের দাম এভাবে বেড়েছে।
তবে দেশের অর্থনীতিবিদ ও নাগরিক সংগঠনগুলো চালের মূল্যবৃদ্ধির জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়কে দায়ী করছে। তারা বলছে, সরকারের চালের মজুত কমে গেলে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেবেন, এটাই সাধারণত ঘটে থাকে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সরকারি মজুত বাড়ানো সবচেয়ে জরুরি।
চালের দাম ৪০ টাকার ওপরে উঠলেই দেশের প্রায় আড়াই কোটি অতি দরিদ্র মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্বল্পমূল্যে খোলাবাজারে চাল বিক্রি কার্যক্রম চালু করা হয়। কিন্তু সরকারি মজুত পাঁচ মাস ধরে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকার কারণে খাদ্য মন্ত্রণালয় এখনো ওএমএস চালু করতে পারেনি। নিয়মিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো চালাতেই তারা হিমশিম খাচ্ছে। ১০ টাকায় চাল বিক্রির জন্য দরিদ্রবান্ধব কর্মসূচি চালু হওয়ার কথা থাকলেও তা এক মাস পিছিয়ে দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের অক্ষমতাকে ব্যবসায়ীরা কাজে লাগিয়েছেন। তাঁরা লাভের জন্য যেকোনো সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারের গুদামে চাল কমে যাওয়ার খবরে ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়িয়েছেন। সরকার চালের জন্য কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে সরকারের সরবরাহ বৃদ্ধি করার ক্ষমতা নেই। যত দিন সরকারের চালের
মজুদ ১০ থেকে ১২ লাখ টন না হবে, তত দিন পর্যন্ত অধিক মুনাফার লোভে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াতেই থাকবেন।
খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এভাবে দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। বাজারে চালের অভাব নেই, যথেষ্ট মজুত আছে। এ ছাড়া আমাদের আমদানি খরচ মাত্র ২৪-২৫ টাকা। তাহলে চালের দাম কেন এত বাড়বে?’ তিনি বলেন, বাজার তদারকির দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। এখন আমি ব্যক্তিগতভাবে বিভাগীয় কমিশনারদের টেলিফোন করে তাঁদের তদারকি বাড়াতে এবং সক্রিয় হতে বলছি।’
নানা উদ্যোগ, তবু প্রভাব নেই
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, গত ২৬ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় দুই মাসে ৩ লাখ ৬৩ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে। চালের সংকট মোকাবিলায় ঈদের আগে সরকার দুই দফায় আমদানির শুল্ক কমিয়ে ২৮ থেকে ২ শতাংশে নিয়ে এসেছে। এ ছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির জন্য বাকিতে ঋণপত্র খোলার সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর প্রভাব চালের বাজারে পড়ার কথা। কিন্তু ইতিবাচক কোনো প্রভাব দেশের চালের বাজারে দেখা যাচ্ছে না।
গত সোমবার দেশের বড় চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালানোর বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, প্রয়োজনে এভাবে অভিযান চালাতে হবে।
অবশ্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডের বর্তমান দাম অনুযায়ী আমদানি করলে বাংলাদেশে প্রতি কেজির খরচ পড়বে ৪০ থেকে ৪৪ টাকা। রাজধানীর বাজারে আমদানি করা চাল আসছে মূলত ভারত থেকে। গতকাল বেনাপোল বন্দরে প্রতি কেজি মোটা চালের দামও ছিল ৪৪ টাকা, যা দুই সপ্তাহ আগের তুলনায় ৫ থেকে ৬ টাকা বেশি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক কে এ এস মুর্শিদ প্রথমআলোকে বলেন, খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একে অপরকে দোষারোপ সংকট মোকাবিলায় ভূমিকা রাখবে না। তাঁর মতে, বিভিন্ন চালকলে অভিযান চালিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা হিতে বিপরীত হতে পারে। এতে বাজার আরও অস্থির হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তিনি বলেন, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত বাজারে বড় আকারে ওএমএস চালু করা, নিজেদের মজুত বাড়ানো এবং বেসরকারি খাতে চাল আনতে সহায়তা করা।
জেলা প্রশাসকদের চিঠি
চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে গতকাল জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। জানতে চাইলে বরিশালের জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান ও রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক মো. শওকত আলী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠি পেয়েছেন বলে প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেন। বরিশালের ডিসি বলেন, চাল ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠকে করে অনুরোধ জানাব, চালের দাম তাঁরা যেন না বাড়ান। তারপরও কারসাজি হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রাজবাড়ীর ডিসি বলেন, এলাকায় ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে চালের দাম বাড়াচ্ছেন, এমন অভিযোগ তাঁদের কাছে এসেছে। তাঁরা তদারকি কার্যক্রম চালাচ্ছেন।
চালের দাম ও মজুত
দেশের মিনিকেট চালের প্রধান জোগান যায় কুষ্টিয়া সদর উপজেলার খাজানগর মোকাম থেকে। ওইখানে অন্তত ৩১টি অটো রাইস মিল আছে। সেখান থেকে প্রতিদিন প্রায় এক শ ট্রাক (প্রতি ট্রাকে ১৫ টন) চাল ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়। যার সিংহভাগ (প্রায় ৩০ ট্রাক) মিনিকেট চাল শুধু রশিদ অ্যাগ্রো ফুড প্রডাক্ট সরবরাহ করে। এ মিলেই অভিযান চালায় জেলা প্রশাসন।
এ বিষয়ে জানতে চাই রশিদ অ্যাগ্রো ফুডের মালিক আবদুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘জরিমানার পরে চালকলমালিকেরা জেলা প্রশাসকের কাছে গিয়েছিলেন। আমরা বলেছি, দাম কমাতে প্রচুর চাল আমদানি প্রয়োজন। দরকার হলে আমরা লোকসান দেব। কিন্তু ঘাটতি পূরণে পর্যাপ্ত চাল আমদানির জন্য সরকারকে আমরা আগেই তাগিদ দিয়েছি।’
দফায় দফায় চালের দাম বাড়ার ব্যাপারে মিলমালিকেরা বরাবরই দেশে ধানের চরম সংকট চলছে বলে দাবি করে আসছেন। দেশে বছরে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টন চাল উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে ৫৫ শতাংশ আসে বোরো মৌসুমে। গত বোরোতে হাওরে ফসলহানি ও বন্যায় উৎপাদন ২০ লাখ টন কম হয়েছে বলে মনে করছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
গত এক মাসে সরু চালের দাম কেজিপ্রতি ৬ টাকা, মাঝারি ও মোটা চালের দাম ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়েছে। বাজারে সরু চালের দাম কেজিপ্রতি ৬০ টাকার ওপরে উঠেছে, যা বছরের এ সময়ে সাধারণত ৫০ টাকার নিচে থাকে। অন্যদিকে মাঝারি মানের চালের মধ্যে বিআর-২৮ প্রতি কেজি ৫২ থেকে ৫৪ টাকা এবং মোটা চাল মানভেদে ৪৬ থেকে ৪৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছরের এ সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, মাঝারি চালের দাম এবার কেজিতে ১০ টাকা ও মোটা চালের দাম ১৩ টাকা বেশি।
চালের দাম বাড়ার বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে বাণিজ্যসচিব শুভাশীষ বসু গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন চালের দাম বাড়ার প্রশ্নই ওঠে না। মন্ত্রণালয়ের বাজার তদারকি দল নিয়মিত তদারক করছে। জেলা পর্যায়ে চালের বাজার এবং সরবরাহ পরিস্থিতি সহনীয় রাখতে আমরা ডিসিদের চিঠি দিয়েছি। তাঁদের জবাবের অপেক্ষায় আছি।’ সচিব বলেন, সম্ভবত ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে এই অবস্থা তৈরি হয়েছে।