পিডিএফ’র ঋণ ও প্রশিক্ষণ নিয়ে ফাতেমা এখন স্বাবলম্বী
জীবন যুদ্ধে হার না মেনে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন চলনবিল এলাকার গৃহবধূ ফাতেমা। নানামুখী অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে ফাতেমার শূন্য হাতে এখন পূর্ণতার হাতছানি। চরম অনিশ্চয়তা অতিক্রম করে পড়াশোনা করাচ্ছেন পাঁচ ছেলে-মেয়েকে, স্বামীকে বিজয়ী করে এনেছেন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মেম্বার পদে। এই সাফল্যগাঁথায় ফাতেমার সহায়ক শক্তি পিডিবিএফ’র ঋণ এবং প্রশিক্ষণ।
চলনবিল অধ্যুষিত সিংড়া উপজেলার কলম ইউনিয়নের জগৎপুরে ফাতেমার সংসার। গুড়নই নদীর পাশে ৭৩ শতাংশ জমির এক কোণে বসতবাড়িতে কোন জৌলুস না থাকলেও গরু, ছাগল, মুরগী পালনের শেড, নার্সারীর অবস্থান আর্থিক স্বচ্ছলতার জানান দিচ্ছে। নতুন করে শুরু করেছেন মাছ চাষ। সাম্প্রতিক বন্যায় নদী প্লাবিত হয়ে নার্সারী তলিয়ে, মুরগীর বাজার দর কমে আর পুকুরের মাছ ভেসে কয়েক লাখ টাকা লোকসান গুণতে হয়েছে ফাতেমাকে। তবে হার মানতে অনিচ্ছুক ফাতেমা।
ফাতেমা বলেন, সাড়ে সাত বিঘা আয়তনের পুকুর ইজারা নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন ১৫ লাখ টাকা। পুকুরকে ঘিরে স্বপ্নের জাল বুনছেন ফাতেমা। বড় আঙ্গিকে গাভী পালনের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে ফাতেমা জানান, প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান কাজে লাগাতে চাই। পাশাপাশি পাকা পাকাবাড়ী তৈরি করবেন সামনের বছর।
এক সময়ের রিকশা চালক স্বামী হাতেম আলী এখন আর রিকশা চালান না। ফাতেমার খামারে উৎপাদিত মুরগী বিক্রি করেন বাজারে, কখনো পুকুরে নেমে মৎস্য চাষে পরিচর্যা, আবার কখনোবা ছাগল পালনে সহযোগিতা। ২০১৬-এর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কলম ইউনিয়ন পরিষদে মেম্বার নির্বাচিত হয়েছেন হাতেম আলী। তিনি বলেন, ফাতেমা সংসার পরিচালনার পুরো দায়িত্ব নেয়াতে আমি জনপ্রতিনিধি হয়ে মানুষের কল্যাণে কাজ করার চেষ্টা করছি।
ফাতেমার এ রকমারী অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সহায়ক শক্তি তার তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। সকলেই কোন না কোনভাবে তাকে সাহায্য করে। কক্সবাজার পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে কম্পিউটারে ডিপ্লোমা অধ্যয়নরত মেজ ছেলে ফরহাদ পুকুরে কাজ করতে করতে জানায়, পূজার ছুটিতে এসে মায়ের কাজে সাহায্য করছি। বড় ছেলে ফরহাদ রাজশাহী কলেজ থেকে একাউন্টিং-এ মাস্টার্স পাস করে চাকরির চেষ্টা করছে। বড় মেয়ে হিরা কলম কলেজে এইচএসসি এবং ছোট মেয়ে মিরা কলম হাইস্কুলে এসএসসি’র ছাত্রী। আর সবার ছোট জসিম কেজির ছাত্র।
সব সন্তানকে লেখাপড়া শেখানো এবং স্বামীকে জনপ্রতিনিধি দেখতে পেরে আত্মতৃপ্ত ফাতেমা বলেন, সংসারের চাকা ঘোরাতে আমার হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম সার্থক হবে একদিন। পরিশ্রমী এবং অধ্যবসায়ী ছেলে-মেয়েরা মানুষের মতো মানুষ হবে বলে আমি আশাবাদী।
ফাতেমা বলেন, বিয়ের পর পর প্রায় ৩৬ বছর আগে শূন্য হাতে সংসারের হাল ধরলেও আতœীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর সহযোগিতায় বিছিন্নভাবে গরু-ছাগল ও মুরগী পালনের কাজ করেছি ওই সময়। ২০১৩ সালে পল্লী দারিদ্র বিমোচন ফাঊন্ডেশনের সাথে পরিচিতির সূত্রে ১৫ সদস্যের সমিতি গঠন করে সভানেত্রী নির্বাচিত হই। ঋণ পাই দশ হাজার টাকা। একসাথে এই প্রথম এতো টাকা, সাথে প্রশিক্ষণ। এরপর আর থেমে থাকিনি, সবকিছু পরিকল্পনামাফিক। ক্রমশ ঋণের পরিধি বেড়ে এখন এক লাখ ষাট হাজার টাকা।
বিগত পাঁচ বছর যাবৎ সমিতির সভানেত্রীর দায়িত্ব পালনকারী ফাতেমা বলেন, পিডিবিএফ শুধু ঋণ সুবিধাই দেয়নি, পেশাগত দক্ষতা প্রশিক্ষণ প্রদানের ফলে আমরা কর্মক্ষেত্রে সুফল পাচ্ছি। আর সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে আমি সচেতন হয়ে সন্তানদের পড়ালেখা শেখাতে উদ্বুদ্ধ হয়েছি।
পিডিবিএফ, সিংড়ার সিনিয়র উপজেলা দারিদ্র্য বিমোচন কর্মকর্তা মো. নিহারুল আলম জানান, ফাতেমার কার্যক্রমে সন্তুষ্ট হয়ে পিডিবিএফ ক্ষুদ্র ঋণকে বর্ধিত করে উদ্যোক্তা শ্রেণীভুক্ত করেছে।
পিডিবিএফ নাটোর জেলার উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. আব্দুল মালেক বলেন, সিংড়া উপজেলার ফাতেমার মতো সারা জেলার গ্রামীণ জনপদে অসংখ্য সফল মানুষ তৈরিতে নিরলসভাবে কাজ করছি আমরা।
পল্লী দারিদ্র বিমোচন ফাঊন্ডেশন (পিডিবিএফ) স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনে সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠির দারিদ্র্য বিমোচন, আত্ম-কর্মস্থান সৃষ্টি, আয়বর্ধনমূলক কর্মকান্ড ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে কাজ করছে। ঋণ সহায়তা ও পুঁজি গঠন ছাড়াও নারী উন্নয়ন এবং সুফলভোগী সদস্যদের দক্ষতা উন্নয়ন ও আয় বৃদ্ধিমূলক এবং সামাজিক উন্নয়ন ও সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করে আসছে।
পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাঊন্ডেশন (পিডিবিএফ) সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. মো. মনারুল ইসলাম বলেন, ২০১৮ সালের মধ্যে দেশের ২০টি জেলার ১০০ উপজেলার ২ লাখ ৫ হাজার ২৫২টি গ্রামীণ পরিবারের প্রায় দশ লাখ গ্রামীণ জনগোষ্ঠির দারিদ্র্য বিমোচন, আত্ম-কর্মস্থান সৃষ্টি, আয়বর্ধনমূলক কর্মকান্ড ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে কাজ করছে পিডিবিএফ। দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরের লক্ষ্যে ফাতেমার মতো সারাদেশে সফলতা তৈরিতে কাজ করছি আমরা।