হারিয়ে যাবে আবাহনী–মোহামেডান লড়াই?
এই তো গত রোববারের কথা। বিশাল কলকাতা নগর যেন মিশেছিল এক কেন্দ্রে। কেন? সেদিন কি বলিউডের কোনো ছবি মুক্তি পেয়েছিল? নাকি ছিল গুরুত্বপূর্ণ কোনো রাজনৈতিক সমাবেশ! ঢাকার মানুষ অবাক হতে পারে, কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য, কলকাতার নাগরিকদের সেদিন এক রাস্তায় হাঁটতে বাধ্য করেছিল ফুটবল। শহরের অদূরে যুব ভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান দ্বৈরথ সেদিন উদ্বেলিত করেছিল, রোমাঞ্চিত করেছিল কলকাতাবাসীকে।
স্টেডিয়ামে ৬০ থেকে ৬৫ হাজার দর্শক। গগনবিদারী চিৎকার। প্রিয় দলের জার্সিতে উৎসব—বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে, বিশেষ করে ফুটবলে হালে বিরল এক দৃশ্য। কোনো কিছু দিয়েই দর্শকদের টেনে আনা যাচ্ছে না বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। ইউরোপীয় ফুটবল সম্প্রচারের রমরমা বাজারে ‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’ হতে পারছে না কেউই। কিন্তু কলকাতার ফুটবলপ্রেমীদের আছে ‘ঐতিহ্যের বাঁশি’। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান হচ্ছে সেই বাঁশি। আমাদেরও ‘ঐতিহ্যের বাঁশি’ ছিল—আবাহনী আর মোহামেডান—ঢাকার ফুটবলের দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু আমরা যে সেই ঐতিহ্যকে পায়ে ঠেলেছি।
সপ্তাহ দুয়েক আগে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে ছিল আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথ। কোন ফাঁকে খেলাটা হয়ে গেছে, সেই খবর রাখার প্রয়োজনীয়তাও বোধ করেনি বাংলাদেশের মানুষ। কেন করবে। আবাহনী-মোহামেডান তাদের জন্য কী করেছে? সত্তর-আশি আর নব্বইয়ের দশকে যে দুই ক্লাবের জন্য গোটা বাংলাদেশ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যেত, যে দুই ক্লাবের সমর্থকদের রেষারেষি প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটিয়েছে, সময়ের পরিক্রমেই সেই দুই ক্লাবের আবেদনই এখন বাংলাদেশের মানুষের কাছে মৃত। ভাবতে আসলেই অবাক লাগে। অথচ আবাহনী কিংবা মোহামেডান কোনো ক্লাবের তরফ থেকেই কোনো উদ্যোগ নেই এ দেশের ফুটবলপ্রিয় মানুষের বিপুল বাজারটা কবজা করার। এত অপেশাদারও এই যুগে কেউ হয়?
কেন আবেদন হারাল আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথ? এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। অনেকেই ইউরোপীয় ফুটবলকে ‘ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করতে চান। এই শ্রেণির বক্তব্য হচ্ছে, ইউরোপের সেরা ফুটবল লিগগুলো খেলা যেখানে টেলিভিশনের রিমোট ঘুরালেই দর্শকেরা দেখতে পান, সেখানে কেন তারা আবাহনী-মোহামেডান নিয়ে উৎসাহিত হবেন। কিন্তু এঁদের মুখ বন্ধ হয়ে যায় কলকাতার ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান উন্মাদনায়—কলকাতার ফুটবলপ্রেমীরাও তো ইউরোপীয় ফুটবলের খেলা উপভোগ করে। তারা ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানে আগ্রহী হলে বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের আবাহনী-মোহামেডানে সমস্যা কোথায়?
সমস্যাটা ওই আবাহনী-মোহামেডানেই। এই দুই ক্লাবেরই খুব সম্ভবত নিজেদের দ্বৈরথটা জারি রাখার আর কোনো আগ্রহ নেই। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে একটা জরিপ চালালে আবাহনী-মোহামেডানে ভাগ হয়ে যাবে পুরো দেশ। তারপরও আধুনিক যুগে এই দুই ক্লাবে কর্তাদের নিজেদের বিপণন নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। প্রতিবছর একটা দল বানিয়ে খেলতে হবে বলেই যেন তাদের খেলা—নিজেদের সাজিয়ে-গুছিয়ে দর্শকদের সামনে তুলে ধরার কোনো ইচ্ছাই যে তাদের নেই।
ফুটবল ব্যক্তিত্ব, জাতীয় দলের সাবেক কোচ গোলাম সারোয়ার টিপু মনে করেন, এই অবস্থার জন্য ফুটবল-সংশ্লিষ্টরাই দায়ী, ‘আসলে আমাদের ফুটবলটা তো আমরাই শেষ করে দিয়েছি। পাতানো ম্যাচ, অমুক মাঠে খেলব না, তমুক মাঠে খেলব, অনিয়মিত লিগ—এসবই তো! ইদানীং শুরু হয়েছে লিগের মধ্যই দীর্ঘদিনের বিরতি। এগুলো দেখার জন্য কেন দর্শক আসবে। আবাহনী-মোহামেডানের উদ্যোগ কি! কোনো মার্চেন্ডাইজ সামগ্রী (জার্সি, পতাকা, ব্যাজ, স্কার্ফ ইত্যাদি) কি তারা বিক্রি করার উদ্যোগ নিয়েছে কোনো দিন? সমর্থকদের নিয়ে নিজেদের কোনো হিসাব কি তাদের আছে? নতুন প্রজন্মকে কি তারা চিনিয়েছে নিজেদের ক্লাব? ঐতিহ্যের বড়াই করে এরা। নস্টালজিয়ার নাকি কান্না কাঁদে; একটা পুরোনো খেলার ফুটেজ কী তাদের সংগ্রহে আছে? নতুন খেলোয়াড় তৈরির উদ্যোগের ব্যাপারে এদের অনীহার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। দুটি ক্লাবের আত্মোপলব্ধি খুবই প্রয়োজন।’