গেইলের দুরুহ তান্ডবে ঢাকাকে হারিয়ে বিপিএলের শিরোপা জিতলো মাশরাফির রংপুর
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) টুয়েন্টি টুয়েন্টি ক্রিকেটের পঞ্চম আসরে চ্যাম্পিয়ন হলো রংপুর রাইডার্স। আজ টুর্নামেন্টের ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিস গেইলের বিধ্বংসী ৬৯ বলে অপরাজিত ১৪৬ রানের সুবাদে গতবারের চ্যাম্পিয়ন ঢাকা ডায়নামাইটসকে ৫৭ রানে হারালো মাশরাফির বিন মর্তুজার রংপুর। এবারই প্রথম বিপিএলের শিরোপা জিতলো রংপুর। তবে অধিনায়ক হিসেবে এই নিয়ে চারবার বিপিএলের শিরোপা জিতলেন মাশরাফি। পাঁচ আসরের মধ্যে মাশরাফির নেতৃত্বে চারবার বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি ফাইনালে উঠে। চারবারই বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজিদের শিরোপা জয়ের স্বাদ দিয়েছেন মাশরাফি। প্রথম দুই আসরে ঢাকা গ্লাডিয়েটর্সকে এবং তৃতীয় আসরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সকে শিরোপার স্বাদ দেন বাংলাদেশের ওয়ানডে দলের অধিনায়ক মাশরাফি।
মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে শিরোপা নির্ধারনী ম্যাচে টস ভাগ্যে জয় পান ঢাকার সাকিব। রান চেজের আশায় ও দ্বিতীয় ইনিংসে বল গ্রিপে সমস্যা বোধ করাতেই এমন সিদ্বান্ত সদ্য টেস্ট দলের অধিনায়কত্ব পাওয়া সাকিবের। রংপুরের ইনিংস গোড়াপত্তন করতে আসেন এবারের বিপিএলের দুই সেঞ্চুরিয়ান ওয়েস্ট ইন্ডিজের গেইল ও জনসন চার্লস। তবে মারমুখী মেজাজে শুরু করেননি তারা।
প্রথম ওভার থেকে পাঁচটি সিঙ্গেল নেন গেইল-চার্লস। দ্বিতীয় ওভারে স্ট্রাইকে থেকে সাকিবের প্রথম চার বল থেকে কোন রানই নিতে পারেননি চার্লস। পঞ্চম বলে সাকিবকেই ক্যাচ দিয়ে নিজের ইনিংসের সমাপ্তি ঘটান দ্বিতীয় কোয়ালিফাইয়ারে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের বিপক্ষে অপরাজিত ১০৫ রান করা চার্লস। এবার ৮ বলে মাত্র ৩ রান করেন তিনি।
চার্লসের বিদায়ে ক্রিজে গেইলের সঙ্গী হন নিউজিল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। পুরো টুর্নামেন্টে ব্যাট হাতে ব্যর্থ ম্যাক, দ্বিতীয় কোয়ালিফাইয়ারে পেয়েছিলেন প্রথম হাফ-সেঞ্চুরির স্বাদ। ঐ ম্যাচে ৭৮ রান করা ম্যাককালাম এবারও দেখেশুনে শুরু করেন। তবে অন্যপ্রান্তে গেইল ছিলেন মারমুখী। পাওয়ার-প্লের শেষ ওভারে ঢাকার মোসাদ্দেক হোসেনকে তিন ছক্কা মারার আগের ওভারগুলোতে তিনটি বাউন্ডারি মেরেছেন গেইল। প্রথম ৬ ওভারে ১ উইকেটে ৪১ রান পায় রংপুর।
এরপর আরও ধীরগতির হয়ে পড়েন গেইল ও ম্যাককালাম। পাওয়া-প্লে’র পর পরের ৪ ওভারে মাত্র ২২ রান তুলেন তারা। ফলে ১০ ওভার শেষে রংপুরের রান দাড়ায় ১ উইকেটে ৬৩। এরপর জ্বলে উঠেন গেইল ও ম্যাককালাম। ১১তম ওভারে ঢাকার খালেদকে পরপর দু’টি ছক্কা ও ১টি বাউন্ডারিতে ৩৩ বলে নিজের হাফ-সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন গেইল।
হাফ-সেঞ্চুরির পর আরও বিধ্বংসী রুপ নেন গেইল। পরের ২৪ বলে আরও ৫০ রান তুলে নিয়ে এবারের আসরে নিজের দ্বিতীয়, বিপিএলে নিজের পঞ্চম ও টি-২০ ক্যারিয়ারে ২০তম সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন গেইল। ৫৭তম বলে সেঞ্চুরি পূর্ণ করা ইনিংসে ৪টি চার ও ১১টি ছক্কার মার ছিলো। এই ৫৭ বলের মধ্যে ২৪টি বলই ছিলো ডট।
তিন অংকে পা দিয়েও ক্ষান্ত হননি গেইল। ঢাকার বোলারদের উপর ছড়ি ঘুড়িয়েছেন তিনি। ১৬তম ওভারের প্রথম বলে সেঞ্চুরির পর শেষ ২৩ বলের মধ্যে ১২ বল মোকাবেলা করে আরও ৭টি ছক্কা ও ১টি চার মারেন গেইল। ইনিংস শেষে তার ছক্কার সংখ্যা গিয়ে দাড়ায় ১৮টিতে। এখানেও টি-২০ ক্রিকেট ইতিহাসে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ছক্কায় নিজের রেকর্ড ভাঙ্গেন গেইল। এর আগে এক ইনিংসে ১৭টি ছক্কা মেরেছিলেন তিনি। ২০১৩ সালে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে পুনে ওয়ারিয়র্সের বিপক্ষে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর হয়ে ৬৬ বলে ১৩টি চার ও ১৭টি ছক্কায় অপরাজিত ১৭৫ রান করেছিলেন গেইল।
ছক্কায় বিশ্বরেকর্ড গড়া ইনিংসে শেষ পর্যন্ত ৬৯ বলে ১৪৬ রান করেন গেইল। ১৮টি ছক্কার পাশাপাশি ৫টি চারও মারেন তিনি। গেইলের বিধ্বংসী রুপের মাঝে ভয়ংকর হতে যাননি ম্যাককালাম। স্ট্রাইক রোটেট করে গেইলকে বেশি বল খেলার সুযোগ করে দিতে গিয়ে নিজের স্ট্রাইক রেট খুব বেশি বাড়াতে পারেননি ম্যাক। তাই শেষ পর্যন্ত ৪টি চার ও ৩টি ছক্কায় ৪৩ বলে অপরাজিত ৫১ রান করেন ম্যাককালাম।
গেইলের বিধ্বংসী সেঞ্চুরি ও ম্যাককালামের বুদ্ধিদীপ্ত হাফ-সেঞ্চুরির ইনিংসে দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে রংপুরের স্কোরবোর্ডে ১০৯ বলে ২০১ রান যোগ হয়। শেষ ১০ ওভারে ১৪৩ রান যোগ করেন তারা। এরমধ্যে গেইলের ছিলো ১১২ রান। ফলে ২০ ওভার শেষে ১ উইকেটে ২০৬ রানের বড় সংগ্রহ পায় রংপুর। রংপুরের পুরো ইনিংসে পতন হওয়া ১টি উইকেট নেন ঢাকার সাকিব।
টানা দ্বিতীয়বার শিরোপা জয়ের জন্য ঢাকাকে করতে হবে ২০৭ রান। লক্ষ্যটা বিশাল, তাই শুরুটা দুর্দান্ত করা প্রয়োজন পড়ে তাদের। কিন্তু বল হাতে রংপুরকে দারুন সূচনা এনে দেন দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। ইনিংসের তৃতীয় বলেই ঢাকার ওপেনার মেহেদি মারুফকে শুন্য হাতে ফিরিয়ে দেন তিনি। লেগ বিফোর ফাঁেদ ফেলে মারুফকে শিকার করেন ম্যাশ।
মাশরাফির দেখানো পথে হেটে রংপুরকে পরের ওভারেই দ্বিতীয় সাফল্য এনে দেন অফ-স্পিনার সোহাগ গাজী। নিজের দ্বিতীয় ডেলিভারিতেই ইংল্যান্ডের জো ডেনলিকে ফেরত দেন গাজী। ডোনলিও রানের খাতা খুলতে পারেননি। তাই ২ওভার শেষে ১ রানেই ২ উইকেট হারিয়ে বসে ঢাকা।
এরপর পরিস্থিতি সামাল দিয়ে তৃতীয় উইকেটে ১৮ রান যোগ করেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের এভিন লুইস ও অধিনায়ক সাকিব। কিন্তু এসময় লুইসকে ১৫ রানে গাজী ও কাইরন পোলার্ডকে ৫ রানে রংপুরের পেসার রুবেল হোসেন শিকার করলে দলীয় ২৯ রানে চতুর্থ উইকেট হারায় ঢাকা।
দ্রুত ৪ উইকেট হারানোর পর দলকে সামনের দিকে টেনেছেন সাকিব ও জহিরুল। তবে খুব বেশি দূর যেতে পারেননি তারা। জুটিতে ৪২ রান যোগ করেছেন সাকিব ও জহিরুল। সাকিব ২৬ রান করে ফিরলেও, অন্যপ্রান্তে লড়াই চালিয়ে গেছেন জহিরুল। কিন্তু অন্যপ্রান্তে কেউই জহিরুলকে সঙ্গ দিতে পারেননি। ৪টি চার ও ২টি ছক্কায় ৩৮ বলে দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৫০ রানে ফিরেন জহিরুল। শেষ পর্যন্ত ২০ ওভারে ৯ উইকেটে ১৪৯ রান করতে পারে ঢাকা। রংপুরের পক্ষে ২টি করে উইকেট নেন গাজী, শ্রীলংকার ইসুরু উদানা ও নাজমুল ইসলাম। ম্যাচের সেরা হয়েছেন রংপুরের গেইল।
সংক্ষিপ্ত স্কোর :
রংপুর রাইডার্স : ২০৬/১, ২০ ওভার (গেইল ১৪৬*, ম্যাককালাম ৫১*, সাকিব ১/২৬)।
ঢাকা ডায়নামাইটস : ১৪৯/৯, ২০ ওভার (জহিরুল ৫০, সাকিব ২৬, নাজমুল ২/৮)।
ফল : রংপুর রাইডার্স ৫৭ রানে জয়ী।
ম্যাচ সেরা : ক্রিস গেইল (রংপুর রাইডার্স)।