বাংলাদেশে প্রথম ট্যুরিজম ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল|Sunday, December 22, 2024
সাইটে আপনার অবস্থানঃ Home » জাতীয় » প্রকৃতিবান্ধব পানি ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্বারোপ প্রধানমন্ত্রীর

প্রকৃতিবান্ধব পানি ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্বারোপ প্রধানমন্ত্রীর 

2018-03-27_8_512403

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুষ্ক মৌসুমের নিজস্ব পদ্ধতিতে পানি সংকট মোকাবেলাসহ প্রকৃতিবান্ধব পানি ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রাপ্ত পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পানি বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কারো ওপর নির্ভরশীল নয়, নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদেরকেই করতে হবে। বর্ষকালে যে বিশাল জলরাশি আসে সেটা আমরা কিভাবে ধরে রাখতে পারি। আমাদের সেই পরিকল্পনা আগে নিয়ে নিজেদেরটা দেখতে হবে।’
তিনি বলেন, এখনো আমাদের দেশে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়Ñ নদী ড্রেজিংয়ে নয়, বরং নদীর পাড় বাধাই এবং রাস্তা নির্মাণ বা সেখানকার লোকজনের জন্য পুনর্বাসন সংক্রান্ত প্রকল্পে। যেটি মূলত তাদের কাজ নয়। তিনি বলেন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাজ নদী ড্রেজিং এবং পলি ব্যবস্থাপনা।
রাস্তা সরকারের অন্য মন্ত্রণালয় করে দেবে এবং সেভাবেই প্রধানমন্ত্রী পরিকল্পনা প্রণয়ণ এবং প্রকল্প গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশনা প্রদান করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিশ্ব পানি দিবস-২০১৮ উপলক্ষে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
গঙ্গার পানি চুক্তির পরই তাঁর সরকার নদী খননের দিকে সব থেকে বেশি দৃষ্টি দিয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার পর পর কয়েকটি ড্রেজার কিনে জাতির পিতা এই ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু করেছিলেন। এরপর ’৭৫-এ জাতির পিতাকে হত্যার পর যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা কখনো নদীগুলো খননের কোন উদ্যাগই নেয়নি।
তিনি এ সময় মঞ্চে উপস্থিত পানিসম্পদ মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী এবং সচিবকে উদ্দেশ্য করে বলেন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মূল দায়িত্বটা কি। নদীকে কিভাবে রক্ষা করা যায়, নদীর নাব্যতা বাড়ানো যায়, নদীর ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো যায় এবং এই নদী আমাদের জন্য অভিশাপ নয়Ñ আশির্বাদ হিসেবে যেনো নিজের অস্তিত্ব ঠিক রাখতে পারে সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া। নদী ভাঙ্গন রোধ করা। এটাও কিন্তু সব থেকে বড় কাজ।
পানিসম্পদ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও প্রতিমন্ত্রী মো. নজরুল ইসলাম বীর প্রতীক, অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব কবির বিন আনোয়ার অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক ড. মো. মাহফুজুর রহমান অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন।
অনুষ্ঠানে দেশের পানি ব্যবস্থপনার ওপর একটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শিত হয়।
অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যগণ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যগণ, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ এবং কূটনৈতিক ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রাতনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
আন্তর্জাতিক নদীর পানি বন্টন নিয়ে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সমস্যা থাকার প্রসঙ্গ স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৭শ’ নদী এবং ভারতের সঙ্গে অভিন্ন ৫৪টি নদী রয়েছে, এই নদীগুলো হিমালয় থেকে এসেছে ভারত হয়ে। এই নদীগুলো নিয়ে আমাদের ভারতের সঙ্গে আলোচনা চলছে। যেটার মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করা।
’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ভারতের কাছ থেকে এই গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে সক্ষম হয়েছে এবং ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক পানি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। যদিও ভারতের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে পানির হিস্যা নিয়ে এখনো ঝামেলা চলছে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিস্তা ব্যারেজ করলেও তাঁর ভবিষ্যত পরিবেশের ওপর এর প্রভাব নিয়ে চিন্তা করা হয়নি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই ব্যারেজটা করার আগেই চিন্তা করা উচিত ছিল যে, আমরা ভাটির দেশে বসবাস করি। এখন সেই তিস্তার পানি নিয়ে আমাদের সমস্যা চলছে।
ভারতের সঙ্গে নদী সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে তাঁর সরকার ইতোমধ্যেই অনেক কাজ করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) গঠন করা হয়েছে অন্যান্য নদী নিয়েও আলোচনা চলছে এবং তিস্তা নিয়েও আলোচনা চলছে।
তিনি বলেন, আমি সবসময় মনে করি, ড্রেজিং করে নব্যতা বাড়িয়ে বর্ষাকালে যে পানিটা হিমালয় থেকে নেমে আসে সেটা যতটা বেশি আমরা সংরক্ষণ করতে পারবো ততবেশি আমাদের দেশের জন্য উপকার হবে।
এ-বছরের বিশ্ব পানি দিবসের জাতিসংঘ ঘোষিত প্রতিপাদ্য ‘নেচার ফর ওয়াটার’ বা ‘পানির জন্য প্রকৃতি’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পানি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কারণ, পানি ছাড়া জীব জগতের কোন অস্তিত্বই টিকবে না।
তিনি বলেন, যত বেশি নগরায়ন হচ্ছে, মানুষের জীনযাত্রা বাড়ছে, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে ততবেশি সুপেয় পানির উৎস সংকুচিত হয়ে পড়ছে।
সকল ধরনের উন্নয়নেই পরিবেশের ওপর কিছুটা হলেও বিরূপ প্রভাব পড়ে। এজন্য প্রকৃতি ও পরিবেশকে যথাসম্ভব সংরক্ষণ করে পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।
সমগ্র বিশ্বে ৩ ভাগ জল হলেও সুপেয় পানির পরিমাণ একেবারেই কম উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বে পানের জন্য নিরাপদ পানি শতকরা ১ ভাগেরও কম বিবেচনা করা হয়। ফলে এখন পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় ১শ’ কোটি মানুষের সুপেয় পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা যায়নি। এসময় তিনি ইংরেজি কবি এস টি কোলরিজের বিখ্যাত ‘অ্যানসেইন্ট মেরিনার’ কবিতা থেকে উদ্ধৃত করেন- ‘ওয়াটার ওয়াটার এভরি হয়্যার/নর এনি ড্রপ টু ড্রিংক।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের কর্মপরিকল্পনায় পানি আরো বেশি করে কিভাবে ধরে রাখা যায় তার পরিকল্পনা নিতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদেরকে বন্যার সঙ্গে বসবাস করাটা শিখতে হবে। বন্যার ক্ষতিটা যেন না হয় সেদিকে যেমন দৃষ্টি দেওয়া তেমনি বন্যার সুফলটা যেন আমরা ভোগ করতে পারি সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। শুধু উঁচু উঁচু বাঁধ করে দিলেই কিন্তু আমাদের নদী টিকেবে না। ঐ নদী আরো ভরাট হয়ে যাবে। আর নদী যেমন তার গতি হারায় তেমনি কিন্তু আবার প্রতিশোধও নেয়, তখন ঐ নদী অন্যদিক থেকে ভাঙ্গন শুরু করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আর বর্ষাকালে নদীর যে গতি থাকে। পানির যে জোরটা থাকে সেটা বন্যা কবলিত এলাকার বাসিন্দা বা যারা নিজ চোখে না দেখেছেন তারা বুঝবেন না।
তিনি এ সময় নিজেকে দক্ষিণের নদী অঞ্চলের বাসিন্দা উল্লেখ করে ছোটবেলা থেকেই এসব দেখে এসেছেন বলেও উল্লেখ করেন।
শেখ হাসিনা দেশের জলাধারগুলো সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, জলাধারের সঙ্গে যে খালগুলো রয়েছে সেগুলো যেন কোনভাবে বন্ধ না হয় সেইদিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। আর বর্ষায় যে অতিরিক্ত পানিটা নদীতে আসবে সেটা সংরক্ষণের জন্য একটা বাফার জোন সবসময় নদীর পারে রাখতে হবে। সেখানে কিন্তু নদীর সাথে মিশিয়ে কোন বাঁধ দিলে তা যথার্থ হবে না এবং টিকবে না।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় নদীর ভাঙ্গণ রোধে নদীর পারে শুধু ব্লক বা বোল্ডার না ফেলে কেন নদী ভাঙ্গছে সেই কারণ খুঁজে বের করার এবং অপরদিকে যদি কোন ডুবোচর থাকে তাহলে তা কেটে ফেলে পানির গতিটা যদি সরিয়ে আনা যায় তাহলে ভাঙ্গনটা থেমে যেতে পারে।
এ সময় কিছুটা নদী শাসনের আমাদের করা দরকার বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী সাথে সাথে নদীর স্বাভাবিক গতি যেন কোনভাবেই বাধাপ্রাপ্ত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখার এবং নিয়মিত ড্রেজিং করারও আহবান জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের নদীগুলো প্রয়োজনের অতিরিক্ত চওড়া হয়ে গেছে।
গাইবান্ধা থেকে কুড়িগ্রাম পর্যন্ত যমুনা নদীর গতিপথের উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্ষকালে নদী ৪০/৪৫ কিলোমিটার চওড়া হয়ে যায়। যার কোন প্রয়োজন নেই। এক্ষেত্রে ৬ থেকে ৭ কি.মি. চওড়া থাকলেই যথেষ্ট। এখানে বন্যার জন্য বাফার জোন রেখে বাকী জায়গায় বাঁধ দিয়ে দেয়া হলে প্রচুর ভূমি উত্তোলন করা সম্ভব হবে।
ইতোমধ্যে তাঁর সরকার প্রায় দেড় হাজার কি.মি. ভূমি উত্তোলন করতে সক্ষম হওয়ায় সেখানে শিল্প কারখানা এবং পাওয়ার প্লান্ট গড়ে উঠছে। মংলা বন্দরের পাশে ইপিজেড গড়ে উঠেছে, এখন আমরা যে পাটুরিয়া ফেরি ঘাট দেখতে পাচ্ছি তাও নদী ডেজিংয়ের মাধ্যমে উত্তোলিত ভূমিতে করা হয়েছে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা এ সময় নদীর একপাশের ড্রেজিংয়ের মাটি অপর পাশে না ফেলে ডুবো জায়গাগুলো ভরাটের কাজে লাগানোর ওপরও গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি বলেন, তাঁর সরকারের উদ্যোগে ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্লান-২১০০’ শীর্ষক একটি শতবর্ষী ও সামগ্রিক কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের উদ্যোগে পানি ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, আইন ও নীতিমালা প্রণয়নের তথ্য তুলে ধরে বর্তমান সরকারের সময়ে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরেন।
দেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নও ভূমিকা রেখেছে, বলেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সাফল্যের সঙ্গে এমডিজি’র লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমাকে এসডিজি বিষয়ক জাতিসংঘের ‘হাই লেভেল প্যানেল অন ওয়াটার-এর অন্যতম সদস্য ও এশিয়ার অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। এতে আমাদের দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে বলে আমি মনে করি।’
তিনি বলেন, টেকসই সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য সামগ্রিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং পানির জন্য প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান ও পানির সুষম ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমরা নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই ‘এসডিজি-২০৩০’ এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হব।’

শেয়ার করুন !!Share on FacebookTweet about this on TwitterShare on Google+Share on LinkedInShare on RedditBuffer this pageDigg thisShare on TumblrPin on PinterestShare on StumbleUponFlattr the authorEmail this to someone