তাবলিগে শহীদ আফ্রিদির বয়ান
অনলাইন ডেস্ক : ওয়ানডে ক্রিকেটের দ্বিতীয় দ্রুততম সেঞ্চুরিয়ান, পাকিস্তান ক্রিকেট টিমের সাবেক অধিনায়ক, বিশ্বের জনপ্রিয় হার্ডহিটার ব্যাটসমান ও তারকা অলরাউন্ডার শহীদ আফ্রিদি সম্প্রতি তাবলিগে গিয়ে বয়ান করেন। পাঠকদের জন্য উর্দু থেকে সেই বয়ানের ভাষান্তর তুলে ধরা হল :
আমার সামনে অনেক মাওলানা আপনাদের দ্বীন বোঝালেন, আমাকে দ্বীন বোঝালেন, আমার সামনে তো তাদের মতো শব্দ নেই। তারা যেভাবে বলেছিলেন, যে অনুভূতি নিয়ে বলেছিলেন, তা তো আমার নেই। তাদের কথা শুনতে আমার অনেক ভালো লেগেছিল। এখানে জামাতে জামশেদ ভাই (প্রখ্যাত পপ গায়ক জুনায়েদ জামশেদ, যিনি বর্তমানে তাবলিগের মাধ্যমে দ্বীনদারির জীবন গ্রহণ করেছেন) এসেছেন, আমি তার সাক্ষাতে এসেছিলাম। তিনি আমার বড় ভাই। তার সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক। তিনি একজন বুজুর্গ।
তিনি আল্লাহর রাস্তায় বের হয়েছেন, আমরা ভাবলাম, আমরা তার সঙ্গে মোলাকাত করি, তার কাছ থেকে নিজের জন্য কিছু দোয়া নেই। ভাই, আমার কাছে তো তাদের মতো রুহানিয়াতপূর্ণ বাকশক্তি নেই। তবে এটা তো ঠিক যে, আল্লাহ আমাকে ক্রিকেটের সুবাদে সারা দুনিয়া ঘুরিয়েছেন। সাদা-কালো, ধনী-গরিব সব ধরনের লোকের সঙ্গে ওঠাবসার সুযোগ হয়েছে। এ সুবাদে কিছু কথা বলি। আমি এমন বহু লোক দেখেছি, যাদের বেতন মাত্র ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা। তাদের সন্তান ৫-৬টি। অথচ বিশ্বাস করুন তারা দিব্যি প্রশান্তির সঙ্গে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন। বর্তমান বাজারে ২ হাজার টাকার বেতন পাওয়া বান্দা, ৫-৬টি সন্তান, নিয়মিত তারা স্কুলে যাচ্ছে, তিনবেলা খাচ্ছে! তাদের কোনো প্রবলেম নেই! এটা কীভাবে সম্ভব! আমি মনে করি এটা সম্ভব কেবল এ কারণে যে, তাদের সম্পর্ক আল্লাহর সঙ্গে। আল্লাহ তায়ালা তাদের ২ হাজার বা ২ হাজার ৫০০ টাকায় এমন বরকত দিয়েছেন যে, তারা এ টাকায় দিব্যি সুখেই তাদের জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে।
তো ভাই, যে জীবনে দ্বীন আছে, পুরোপুরি দ্বীন আছে, সেটিই সবচেয়ে সুন্দর জীবন। সে জিন্দেগির জন্য দুনিয়াতেও কামিয়াবি আবার আখেরাতেও কামিয়াবি অপেক্ষমাণ। পক্ষান্তরে যার জীবনে দ্বীন নেই তার জিন্দেগি তো বড় হীন। পাঠানদের ব্যাপারে প্রসিদ্ধ যে তারা কাজ করে, ব্যস্ত থাকে কিন্তু নামাজ ছাড়ে না। আমিও আগে ৩-৪ ওয়াক্ত নামাজ পড়তাম। আমার কাছে তাবলিগের লোকেরা এলে আমি তাদের ভাগিয়ে দিতাম কিংবা নিরাপত্তাকর্মীদের দিয়ে নিষেধ করে দিতাম। একবার আমি মহল্লায় টেপবল খেলছি এমন সময় সেখানে তাবলিগের লোকেরা এসে হাজির। এবার আর আমি ফাঁকি দিতে পারলাম না।
তাদের কথা শুনে সত্যিই আমার চিন্তার জগতে পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। নিজে নিজে ভাবতে লাগলাম, শহীদ আফ্রিদি, তোমাকে কাল মরতেই হবে, তুমি নিজের সঙ্গে কী নিয়ে যাবে? তুমি তো কবরে ছক্কা/চার নিয়ে যাবে না। এ সম্পর্কে সেখানে প্রশ্নও করা হবে না। সেখানে প্রশ্ন করা হবে কেবল আমল সম্পর্কে। সে ব্যাপারেই তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে সেখানে। ক্রিকেট সেখানে তোমার কোনো কাজেই লাগবে না। সেখানে কাজে লাগবে কেবল আমল। আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন না, তুমি কয়টি ছক্কা মেরেছ আর কয়টি উইকেট নিয়েছ; তিনি জিজ্ঞেস করবেন নামাজ পড়েছ কয় ওয়াক্ত।
এরপর থেকে আমি তাদের কাছে নিয়মিত যেতে লাগলাম। তিন দিনের জন্য, একদিনের জন্য তাবলিগে যেতে লাগলাম। বুজুর্গদের মাহফিলে হাজির হতে লাগলাম। এখন আমি আল্লাহর শোকর আদায় করি, তিনি আমাকে এ মাহফিলের অংশ বানিয়েছেন। এভাবে আমি আল্লাহর রাস্তায় সময় দিতে লাগলাম। তারপর আস্তে আস্তে নিজেই নিজের মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। আমি হেদায়েতের পথে আসতে লাগলাম। এখন চেষ্টা করি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে পড়তে। দ্বীনের ওপর চলার সর্বোচ্চ মেহনত করি। বুজুর্গদের সান্নিধ্যে যেতে সচেষ্ট থাকি। তাদের কাছ দ্বীনের বিষয় শেখার চিন্তায় থাকি। এদের আমি শুধু আল্লাহওয়ালা নয়, ফেরেশতা বলি। যারা আরামের বিছানা ছেড়ে, ফুটফুটে শিশুকে বাড়িতে রেখে দ্বীনের ফিকিরে বেরিয়ে আসেন।
তাবলিগের কথা আমি কী বলব, আপনারা সাঈদ আনোয়ার আর জুনায়েদ জামশেদকে জিজ্ঞেস করে দেখেন, যাদের মাধ্যম ছিল ক্রিকেট আর সঙ্গীত, এ কাজের মাধ্যমে তাদের জীবনে কতটুকু পার্থক্য সূচিত হয়েছে। সেই ভিআইপিদের গিয়ে জিজ্ঞেস করুন দ্বীনের মধ্যে কী মজা আছে যে তারা নিজেদের আরামের শয্যা ত্যাগ করে মসজিদের চাটাইয়ে এসে ঘুমান। ভাই, কেউ যখন আল্লাহর পথে চলে, আল্লাহ তাকে দুনিয়াতেই দেখাতে থাকেন এটা নাও, ওটা নাও। দ্বীন তো একিন-বিশ্বাসের নাম। আমাদের একিন বানাতে হবে। আমাদের একিন তো ভাই পয়সার ওপর; যা হয় পয়সা থেকে হয়। পয়সার তো জরুরত আছেই।
পয়সা হালাল পথে উপার্জন করলে তা অনেক ভালো। কিন্তু পয়সা থাকুক না থাকুক, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হবে। নিজের চেয়ে যাদের অবস্থা খারাপ, তাদের দিকে দেখুন। আল্লাহ তো আপনাকে তার চেয়ে ভালো রেখেছেন। আর ভাই, হেদায়েতের জন্য আল্লাহর ঘর মসজিদে আসতে হবে কেবল আল্লাহকে খুশি করতে। আমি জানি, এখানে আপনারা অনেক লোক এসেছেন আমার জন্য। আমি তো এক গুনাহগার বান্দা। আমার জন্য কেন মসজিদে আসবেন বন্ধুরা? আল্লাহর জন্যই আসুন। আমি আপনাদের কিছুই দিতে পারব না। কেবল হাত মিলিয়ে আমি নিজের কাজে চলে যাব। আর আল্লাহর কাছে চেয়ে দেখুন, তার হুকুম মেনে দেখুন, তিনি উভয় জগতে কামিয়াব করেন।