এলাকাভিত্তিক লকডাউনের প্রস্তুতি সম্পন্ন
করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে বিভিন্ন এলাকাকে রেড, ইয়েলো ও গ্রিন – এই তিন ভাগে ভাগ করে জোনভিত্তিক লকডাউন করার পরিকল্পনা করেছে সরকার।
ইতিমধ্যে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব ও কর্মপরিকল্পনা প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে (পিএমও)। তার সম্মতি পেলেই জোনভিত্তিক লকডাউন কার্যক্রম শুরু করবেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ওই প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি মেলেনি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সূত্র।
তবে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের আগে এ বিষয়ে নাম প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তি কথা বলতে চাননি। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন রোববার রাতে যুগান্তরকে বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কমিটির করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে জোনভিত্তিক লকডাউন করার প্রস্তাব ও কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে। সেটি রোববার অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সায় পাওয়া গেলে তা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করবেন সংশ্লিষ্টরা।’
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ও মৃত্যু বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ জুন সচিবালয়ে তিন মন্ত্রী এবং ঢাকার দুই সিটি, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের চার মেয়র বিশেষ বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে জোনভিত্তিক লকডাউনের সিদ্ধান্ত হয়।
বৈঠকে সারা দেশকে রেড, ইয়েলো ও গ্রিন জোনে ভাগ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরই মধ্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ থেকে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সফটওয়্যার তৈরি করে দেয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটি এবং স্বাস্থ্যবিদদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকের পর জোনভিত্তিক লকডাউনের প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করা হয়। এই লকডাউন বাস্তবায়নে কারা কারা কাজ করবেন, কিভাবে তা বাস্তবায়ন করা হবে-সে বিষয়ে তৈরি করা হয় চূড়ান্ত কর্মপরিকল্পনা। যা বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। কীভাবে লকডাউন বাস্তবায়ন করা হবে তার গাইডলাইন ঠিক করে দেবেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি পাওয়া সাপেক্ষে ওই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করবেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে গত শনিবার(৬ জুন) রাতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়, ঢাকা মহানগরসহ সারা দেশের লকডাউন এলাকার তালিকা। ‘গ্রিন, ইয়েলো ও রেড জোন’ এই তিন ভাগে ভাগ করে তালিকা প্রকাশ করা হলেও এসব জোনের নাগরিকদের জন্য নতুন কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা পুলিশের ভূমিকা কী হবে, এ বিষয়েও কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি।
করোনা প্রতিরোধ সহায়ক এই ওয়েবসাইটটি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর), সরকারের এটুআই প্রকল্প, মন্ত্রিপরিষদ ও আইসিটি বিভাগের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে।
জোনভিত্তিক মানচিত্র প্রকাশের পর থেকেই দেশব্যাপী বিভিন্ন এলাকায় অস্থিরতা দেখা দেয়। ওই ম্যাপ দেখে সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজন স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের কাছে যোগাযোগ শুরু করে। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয় তোলপাড়। আলোচনায় আসে, দেশের ৫০টির মতো জেলায় লকডাউন শুরু হয়েছে।
ফলে স্থানীয়ভাবে প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ ব্যক্তিরা বিপাকে পড়েন। তারা একবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেন। এ নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি দেখা দেয়। কেউই এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেন নাই।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ওই ওয়েবসাইটে শনিবার দেশের তিনটি বিভাগ, ৫০টি জেলা ও ৪০০টি উপজেলাকে পুরোপুরি লকডাউন (রেড জোন বিবেচিত) দেখানো হয়।
আংশিক লকডাউন (ইয়েলো জোন বিবেচিত) দেখানো হয়েছে দেশের ৫টি বিভাগ, ১৩টি জেলা ও ১৯টি উপজেলাকে। আর লকডাউন নয় (গ্রিন জোন বিবেচিত) এমন জেলা দেখানো হচ্ছে একটি এবং উপজেলা দেখানো হয় ৭৫টি। ঢাকা মহানগরীর ৩৮টি এলাকাকে আংশিক লকডাউন (ইয়েলো জোন বিবেচিত) হিসেবে দেখানো হয়েছে। তবে লকডাউন নয় (গ্রিন জোন বিবেচিত) বলে দেখানো হচ্ছে ১১টি এলাকাকে।
ঢাকায় কোনো এলাকাকে পুরোপুরি লকডাউন (রেড জোন বিবেচিত) হিসেবে দেখানো হয়নি। ওই তালিকা অনুযায়ী বরিশাল বিভাগের মধ্যে পুরোপুরি লকডাউন বরগুনা, বরিশাল, পটুয়াখালী ও পিরোজপুর। এই বিভাগে আংশিক লকডাউন ভোলা ও ঝালকাঠি। চট্টগ্রাম বিভাগে পুরোপুরি লকডাউন ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, কুমিল্লা, কক্সবাজার, ফেনী, খাগড়াছড়ি, লক্ষীপুর ও নোয়াখালী। এই বিভাগে আংশিক লকডাউন বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটি।
ঢাকা বিভাগের মধ্যে পুরোপুরি লকডাউন গাজীপুর, গোপালগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর ও টাঙ্গাইল। এই বিভাগে শুধু ঢাকা ও ফরিদপুর আংশিক লকডাউন। খুলনা বিভাগের মধ্যে চুয়াডাঙ্গা, যশোর, খুলনা, মেহেরপুর, নড়াইল ও সাতক্ষীরা পুরোপুরি লকডাউন। এই বিভাগে আংশিক লকডাউন বাগেরহাট, কুষ্টিয়া ও মাগুরা। খুলনা বিভাগেই দেশের একমাত্র গ্রিন জোন চিহ্নিত জেলা ঝিনাইদহ, অর্থাৎ এটি লকডাউন নয়।
রাজশাহী বিভাগের মধ্যে পুরোপুরি লকডাউন বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর ও রাজশাহী। এই বিভাগে আংশিক লকডাউন চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ। রংপুর বিভাগের আটটি জেলাই পুরোপুরি লকডাউন। জেলাগুলো হলো দিনাজপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, পঞ্চগড়, রংপুর ও ঠাকুরগাঁও।
সিলেট বিভাগের সব কটি জেলা পুরোপুরি লকডাউন। জেলাগুলো হলো হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও সিলেট। ময়মনসিংহ বিভাগের সব কটি জেলা পুরোপুরি লকডাউন। এ চারটি জেলা হলো জামালপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও শেরপুর।
অন্যদিকে ওয়েবসাইটের তালিকায় ঢাকা মহানগরীর আংশিক লকডাউন বলে চিহ্নিত ৩৮টি এলাকা হলো আদাবর থানা, উত্তরা পূর্ব, উত্তরা পশ্চিম, ওয়ারী, কদমতলী, কলাবাগান, কাফরুল, কামরাঙ্গীরচর, কোতোয়ালি, খিলক্ষেত, গুলশান, গেন্ডারিয়া, চকবাজার, ডেমরা, তেজগাঁও, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, দক্ষিণখান, দারুসসালাম, ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, পল্টন মডেল, পল্লবী, বংশাল, বাড্ডা, বিমানবন্দর, ভাটারা, মিরপুর মডেল, মুগদা, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, রমনা মডেল, লালবাগ, শাহআলী, শাহজাহানপুর, শেরেবাংলা নগর, সবুজবাগ, সূত্রাপুর ও হাজারীবাগ থানা এলাকা। আর লকডাউন নয় বলে চিহ্নিত ১১টি এলাকা হলো উত্তরখান থানা, ক্যান্টনমেন্ট থানা, খিলগাঁও, তুরাগ, বনানী, ভাসানটেক, মতিঝিল, রামপুরা, রূপনগর, শাহবাগ ও শ্যামপুর থানা এলাকা।
প্রস্তাবিত কর্মপরিকল্পনায় যা আছে: করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে জোনভিত্তিক লকডাউন কিভাবে কার্যকর করা হবে তার খসড়া কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। এর একটি হলো সিটি করপোরেশনের উপযোগী। আর অন্যটি সিটি করপোরেশনের বাইরের এলাকার জন্য। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জন অফিস, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, পুলিশ, সেনাবাহিনী, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সম্পৃক্ততার সুপারিশ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, রেড জোনে দিনের বেলা কোনো পরিবহন চলতে পারবে না। তবে রাতের বেলা মালামাল পরিবহন করা যাবে। শপিং মল বন্ধ থাকলেও হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা থাকবে। ইয়েলো জোনে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চলতে পারবে। রিকশায় চলতে হবে একজন করে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান খোলা রাখা যাবে। রেস্তোরাঁ খোলা থাকলেও সেখানে ভিড় না জমিয়ে খাবার কিনে বাসায় নিয়ে যাওয়া যাবে। গ্রিন জোনে বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞা থাকবে না। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করতে হবে।
প্রস্তাব অনুযায়ী, রেড জোনে শুধু ফার্মেসি, হাসপাতাল, নিত্যপণ্যের দোকান খোলা থাকবে। কাঁচাবাজার, রেস্টুরেন্ট, চায়ের দোকান, শপিং মলসহ সব ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে স্বেচ্ছাসেবক টিমের মাধ্যমে নিয়মিত মনিটরিং করা হবে। আক্রান্ত রোগীদের বাড়িতে খাদ্যসামগ্রী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা থাকবে। আক্রান্ত রোগীকে আইসোলেশনে রাখা এবং আক্রান্ত রোগীর পরিবারকে কোয়ারেন্টিনে রাখাও নিশ্চিত করা হবে। রেড জোনে জনসমাগম রুখতে কাঁচাবাজার বন্ধ রেখে ভ্রাম্যমাণ ভ্যান ও মাথায় ঢুলি নিয়ে চলা ফেরিওয়ালাদের পণ্য বিক্রি করতে দেয়া হবে। ১৪-২১ দিনের জন্য লকডাউন করা হবে।
লকডাউন নিশ্চিত হচ্ছে কি না তা দেখভাল করবে পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডভিত্তিক মনিটরিং কমিটি। রেড জোনে থাকা কেউ যাতে ওই এলাকার বাইরে যেতে না পারে এবং বাইরের লোকজন যাতে সেখানে ঢুকতে না পারে তার জন্য সংশ্লিষ্ট পয়েন্টগুলোতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবস্থান নেবে। বাসিন্দাদের মধ্যে যাদের করোনা উপসর্গ দেখা দেবে তাদের নমুনা সংগ্রহের জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকায় থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবহার করা হবে। রোগী বেশি হলে একাধিক বুথ স্থাপন করা হবে। নমুনা সংগ্রহ কেন্দ্র বা পাশে থাকা আবাসিক হোটেলে টেকনোলজিস্টদের থাকার ব্যবস্থা করা হবে। প্রয়োজনে নির্দিষ্ট সময় কোয়ারেন্টিনে থাকার পর টেকনোলজিস্টদের রেড জোন থেকে বের হতে হবে। ইয়েলো জোনে কিছু ক্ষেত্রে ছাড় পাওয়া যাবে।
এখানে পুরো এলাকা লকডাউন না করে করোনা আক্রান্ত রোগীদের বাড়িতে লকডাউন নিশ্চিত করা হবে। তবে নির্ধারিত নিয়ম-কানুন কড়াভাবে পালন করতে হবে বাসিন্দাদের। যেমন একসঙ্গে দু-তিনজনের বেশি হাঁটা যাবে না। বাসার বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। যেকোনো ধরনের জনসমাগম রোধে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী বা ওয়ার্ড কমিটি পর্যায়ক্রমে টহল দেবে। কোনো বিষয় তাদের আয়ত্তের বাইরে থাকলে জেলা প্রশাসনকে অবহিত করবে। প্রয়োজনীয় জায়গায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। এখানে ফার্মেসি, হাসপাতাল ও কাঁচাবাজার খোলা থাকলেও অন্য সব বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।
কুইক রেসপন্স টিমের মাধ্যমে আক্রান্ত রোগীর বাড়ি লকডাউন নিশ্চিত করা হবে। এছাড়া গ্রিন জোনেও কিছু বিষয়ে কঠোরতা বজায় রাখা হবে, যাতে করোনা আক্রান্ত কোনো রোগী এই এলাকায় ঢুকতে না পারে তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হবে। গ্রিন জোনের কেউ আক্রান্ত হলে তাকে প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে রাখা হবে। যাতে এই এলাকার কেউ আক্রান্ত না হয়।