ঘুরে আসুন নজরুল পল্লী
এইদেশ এইসময়, ডেস্ক : পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম নেয়া সেই দুখু মিয়া বর্তমান বাংলাদেশের যে অঞ্চলে বেড়ে উঠেছেন তার নাম ত্রিশাল। আমাদের প্রিয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের শৈশব ও কৈশোরের একটি বড় অংশ কেটেছে ময়মনসিংহের এই ত্রিশালে।
কবির স্মৃতিবলয়ে ঘেরা ত্রিশাল এখন নজরুল-পল্লী হিসেবে খ্যাত। ঢাকা থেকে মাত্র একশ কিলোমিটার দূরে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার অবস্থান।
পর্যটক ও নজরুলপ্রেমীরা প্রতিদিনই ছুটে যাচ্ছেন এই নিঃসর্গের কোলে। আপনিও যান্ত্রিক জীবনের বাইরে হারিয়ে যেতে ঘুরে আসতে পারেন নজরুল-পল্লী ত্রিশালে।
এখানে রয়েছে দুই তলা বিশিষ্ট নজরুল পাঠাগার ভবন। নজরুলের বিদ্রোহ ও প্রতিবাদ হচ্ছে অত্যাচারের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে, শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে। অত্যাচারিত, শোষিত, শ্রেণী বৈষম্যপীড়িত মানুষকে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের চেতনায় উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে কবির অনবদ্য সৃষ্টি স্থান পেয়েছে। এছাড়াও এখানে থাকা তার কবিতা-গানের বইগুলো আগত দর্শনার্থীদের মধ্যে মানবতাবাদী চেতনার খোরাক যোগাবে।
দরিরামপুর ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ডের পাশেই নজরুল একাডেমী। কবির স্মৃতিবিজড়িত দরিরামপুর হাই স্কুলই বর্তমানে নজরুল একাডেমী। এই স্কুলে কবি ৭ম ও ৮ম শ্রেণিতে লেখাপড়া করেছেন। স্কুল মাঠের পাশেই রয়েছে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে নজরুল মঞ্চ ও শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত আধুনিক রেস্ট হাউস।
নজরুল স্মৃতি কেন্দ্র দরিরামপুর হাই স্কুলে (বর্তমান নজরুল একাডেমী) যাতায়াতের সুবিধার জন্য পার্শ্ববর্তী গ্রাম ত্রিশাল নামাপাড়ায় বিচ্যুতিয়া বেপারী বাড়িতে কবি জায়গির থাকতেন। এই বিচ্যুতিয়া বেপারী বাড়িতেই এক একর জায়গা জুড়ে নজরুল ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছে নজরুল স্মৃতি কেন্দ্র। নজরুল স্মৃতি কেন্দ্রের মূল ভবনে রয়েছে কবি নজরুল সংগ্রহশালা ও পাঠাগার।
১৯২৯ সালে ১৫ ডিসেম্বর কলকাতা আ্যালবার্ট হলে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে দেওয়া জাতীয় সংবর্ধনা সভায় প্রদত্ত মানপত্রের জবাবে নজরুল বলেছিলেন, সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগানই আমার উপাসনা আমার ধর্ম। যে কুলে যে সমাজে যে ধর্মে যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই আমি কবি। নজরুলের এধরনের বলিষ্ঠ উচ্চারণ নিয়ে গবেষণার সহযোগী ক্ষেত্র এখন এই পাঠাগার। এখানে কবি নজরুল যে ঘরটিতে থাকতেন সেটি পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে।
কবি তার কবিতা গানে যে সকল গাছের নাম উল্লেখ করেছেন সেই গাছগুলো দিয়ে নজরুল স্মৃতি কেন্দ্রে ব্যতিক্রমধর্মী দৃষ্টিনন্দন বৃক্ষ বাগান তৈরি করা হয়েছে। এখানে কবি যে পুকুরে গোসল করতেন সেটিও সংরক্ষণ করা আছে। কবিতা মানুষের কল্পনা ও আবেগের প্রকাশ আর আবৃত্তি শিল্পীকে বলা যায় কবির ভাষ্যকার। এখানে পুকুরের শানবাঁধানো ঘাটে হাসনাহেনা ফুল গাছের নিচে চাঁদের আলোয় কবি-ভাষ্যকারের কাজ করতে কার না ভালো লাগবে!
বটতলা স্কুল পালিয়ে ত্রিশাল নামাপাড়া শুকনি বিলের পাড়ে একটি বট গাছের নিচে কবি নজরুল আপন মনে বাঁশিতে সুর তুলতেন। এটি এখন নজরুল বটবৃক্ষ। দুই বাংলার নজরুল ভক্তদের কাছে এটি তীর্থ স্থানের মর্যাদা পেয়েছে। বটের নিচে প্রায়ই বসে কবিদের আসর। আজ কবি নেই কিন্তু এই বট গাছটি আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে কবির অস্তিত্ব ঘোষণা করছে। এখানকার মনোরম পরিবেশ পর্যটকদের মোহিত করবে।
কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ত্রিশাল উপজেলায় নামাপাড়া গ্রামের শুকনি বিলের পারে নজরুল বটবৃক্ষের পাশেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশের প্রথম ও একমাত্র সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। নিসর্গের কোলে ২০ একর জমিতে ২০০৭ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর বিদ্রোহী কবির স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশাল হয়ে উঠেছে নজরুল চর্চার এক পীঠস্থান। কবি চিরকালের বাঙালি তরুণদের প্রেরণার উৎস।
নতুন প্রজন্মের কাছে কবিকে তুলে ধরতে জাতীয় কবিকে ঘিরে এ বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে শিক্ষা কার্যক্রমসহ সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সফল পদচারণা করছে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগের কল্যাণে প্রতিদিনই রীতিমতো উৎসবের আমেজ তৈরি করছে। আর চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে সাজিয়েছে মনের মাধুরি মিশিয়ে। ফলে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এখন দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর। নজরুলপ্রেমীদের পাশাপাশি প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে শিক্ষাসফরে আসছেন প্রকৃতিপ্রেমীরাও।
ঢাকার মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে ভোর ৫টা থেকে প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে সৌখিন, এনা, নিরাপদ বাস ছেড়ে আসে। টিকেটের মূল্য ১০০-১৫০ টাকা। সময় লাগবে ২ ঘণ্টা। ত্রিশালে আগত দর্শনার্থীদের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সরকারি নজরুল রেস্ট হাউস রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে উপজেলা ডাকবাংলো, ত্রিশাল বাজারে রয়েছে রোদেলা গেস্ট হাউস ও বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেল।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে নজরুলকে তুলে ধরতে ত্রিশালকে এক সাংস্কৃতিক বলয়ে তৈরি করা হয়েছে। নজরুল-পল্লী ত্রিশালে এলে তার জীবন, সাহিত্য-সঙ্গীত ও সামগ্রিক অবদানের এক ঝলক অনুভব করতে পারবেন।