ছাত্রলীগ এখন বিষফোঁড়া
নিজস্ব প্রতিবেদক : শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে জনমনে স্বস্তি আনার যে চেষ্টা করছে, সে ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ছাত্রলীগ। ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্রসংগঠনটি এখন রীতিমতো বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং মহাজোট সরকারের জন্য।
কারণ, নতুন সরকারের বয়স এখন এক মাসেরও কম। এরই মধ্যে ছাত্রলীগ যতগুলো কেলেঙ্কারি করেছে তাতে নতুন সরকারের ভাবমূর্তি এখন ভূলুণ্ঠিত বলা যায়। ইতিমধ্যে সরকারের মুখে কালিমা লেপন করেছেন ছাত্রলীগসহ সরকারের দু-একজন মন্ত্রীও।
রোববার সকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের সশস্ত্র হামলায় সাংবাদিকসহ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন কমপক্ষে ২৫ জন। ছাত্রলীগ নেতারা সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের যেভাবে নাজেহাল করেছেন, তা বিরল।
অন্যদিকে গত শনিবার কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির নেতাদের হাতে মিষ্টি খেয়ে বিপাকে পড়েছেন ছাত্রলীগের নেতারা। শিবিরের ক্যাম্পাস কমিটি ঘোষণা উপলক্ষে ছাত্রলীগের টেন্টে গিয়ে সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের মিষ্টি খাওয়ান ঘোষিত কমিটির নতুন নেতারা।
এরপর সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দফতর সম্পাদক শেখ রাসেল স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক শামীম খান ও যুগ্ম আহ্বায়ক আবুজর গিফারী গাফফারকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, শিবির সভাপতি আসাদুল্লাহ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক শামীমের মুখে মিষ্টি তুলে দিচ্ছেন। এরপর ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আবুজর গিফারী গাফফার, সাজন মৃধাসহ উপস্থিত অনেক নেতাকে মিষ্টিমুখ করান শিবির নেতারা।
গত ২৫ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জসীমউদ্দীন হল শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি মেহেদী হাসানের এক ‘আপত্তিকর’ স্ট্যাটাসের জের ধরে সংগঠনের কর্মীদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সংগঠন থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয় একজনকে।
গত ২৫ জানুয়ারি শনিবার কবি জসীমউদ্দীন হল ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান রনি ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় গিয়ে প্যাকেটজাত দুধ হাতে একটি ছবি তুলে ফেসবুকে দেন। ছবিতে একজন নারী বিক্রেতাকেও দেখা যাচ্ছিল পেছন দিকে।
ফেসবুকে এ নিয়ে মন্তব্য করা হলে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি আফরিন নুসরাত প্রতিবাদ জানান। এরপর মেহেদীর অনুসারীরা নুসরাতকে নিয়ে নানা অশ্লীল মন্তব্য করে। ওই ঘটনার বিচার চেয়ে শামসুন নাহার হলের ছাত্রীরা রাজু ভাস্কর্যে মানববন্ধন করেন।
এদিকে ঘটনার পরদিন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় উপ-আপ্যায়নবিষয়ক সম্পাদক লিটন মাহমুদ আরেকটি স্ট্যাটাস দেন ফেসবুকে। এর জের ধরে তর্কবিতর্ক, ধাক্কাধাক্কি ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
গত বুধবার রাজধানীর শাহবাগের একটি বারে বিল পরিশোধ করাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ ও বার কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলের সভাপতি মেহেদী হাসান আহত হন।
এ খবর শুনে হলের সাধারণ সম্পাদক নিজামুল ইসলাম দিদার এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় স্কুলবিষয়ক সম্পাদক হাসানুল হক বান্নার নেতৃত্বে শতাধিক ছাত্রলীগ কর্মী ওই বারে হামলা চালান। এ সময় ছাত্রলীগ ইটপাটকেল ও বার কর্মীরা মদের খালি বোতল নিয়ে মারামারি করেন। এতে দুই পক্ষের ১০ জন আহত হন।
এ ঘটনায় ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার এক সভায় এসএম হলের সভাপতি মেহেদী হাসানকে সাময়িক বহিষ্কার, সাধারণ সম্পাদক নিজামুল হক দিদার ও জিয়া হল সভাপতি আবু সালমান প্রধান শাওনকে সতর্ক করা হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ২৩ জানুয়ারি নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গোলাম মঈনুদ্দীনকে সমাজবিজ্ঞান ভবনের নিচতলায় লাঞ্ছিত করেন ছাত্রলীগ নেতা মামুন। বিশ্ববিদ্যালয় শাখার প্রকাশনা সম্পাদক মামুন পরীক্ষার ন্যূনতম যোগ্যতা না থাকায় মাস্টার্সের দ্বিতীয় সেমিস্টারের পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। এ কারণে ওই শিক্ষককে মারধর করা হয়। এ ঘটনায় মামুনকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
গত শুক্রবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শরিফুল ইসলাম ও উপ-পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম নাভিদের মধ্যে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে পাল্টাপাল্টি চপেটাঘাতের ঘটনা ঘটে। সভাপতির অনুসারীরা এ সময় নাভিদকে বেধড়ক মারধর করলে তাকে গুরুতর অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। এ ঘটনায় নাভিদসহ চার কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকায় পাঁচজনকে আটকও করেছে পুলিশ।
২০০৯ সালে সরকার দায়িত্ব নেওয়ার তিন মাসের মাথায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিজেদের মধ্যে মারামারিতে নিহত হন কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ ওরফে রাজীব। প্রায় শেষ দিকে এসে ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে নির্মমভাবে বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। গত ১৮ ডিসেম্বর দরজি দোকানি বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলার রায়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আট কর্মীর ফাঁসি ও ১৩ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে।
এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলের শিক্ষার্থী আবুবকর সিদ্দিক হত্যা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ হত্যার বিচার হয়নি এখনো। নিজেদের মধ্যে অসংখ্য মারামারির ঘটনা, প্রতিপক্ষের ওপর হামলার সময় অস্ত্র প্রদর্শন, টেন্ডারবাজি, শিক্ষকদের ওপর হামলার অসংখ্য ঘটনার বিচার কেউ চাইছেই না।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম ও সিলেট সার্কিট হাউসেও মন্ত্রী-সাংসদদের চোখের সামনেই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। সিলেটের বিশ্বনাথে পুলিশের থানা ভাঙচুর করতেও ছাড় দেয়নি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের একজন সিনিয়র সহসভাপতি বলেন, ছাত্রলীগ আর ছাত্রলীগের নেই। সংগঠনটি দিন দিন ইতিহাস-ঐতিহ্য ভুলে গিয়ে বেসামাল হয়ে পড়েছে। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও এলাকায় স্থানীয় নেতাদের তাঁবেদারি সংগঠনে পরিণত হয়েছে।