প্রাকৃতিক সম্পদের আধার সুন্দরবন
এইদেশ এইসময়, ডেস্ক : অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য ও জীব-বৈচিত্র্যে ভরপুর বিস্ময়কর সুন্দরবন দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে বরাবরই প্রিয় ‘ট্যুর স্পট’। ‘বার্ড ওয়াচিং’, ‘এ্যাডভেঞ্চার ট্রেকিং’, ‘ক্যানেল ক্রুজিং’সহ জীবজন্তু দেখা- একসাথে এতকিছু উপভোগের সুযোগ বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনেই পাওয়া যায়। তাই প্রায় সারা বছর জুড়েই পর্যটকরা ভীড় করে থাকেন সেখানে, মিশে যান প্রকৃতির এই অনবদ্য সৃষ্টির মাঝে।
প্রায় ৪৫০টি নদ-নদী ও খাল বিধৌত সুন্দরবনে রয়েছে সুন্দরী, গেওয়া, পশুর, গরান, কাকড়া, বাইন, হেতাল, টাইগার ফার্ন, ছন, গোলপাতাসহ ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা-গুল্ম-লতা-অর্কিড-শৈবাল। বন্যপ্রাণীর বৃহত্তম আবাসস্থল সুন্দরবনে আছে অন্তত ২৬৯ প্রজাতির বন্যপ্রাণী।
আছে বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল ও মায়া হরিণ, শুকর, লোনা পানির কুমির, অজগর, রাজগোখরা, কচ্ছপ, উদবিড়াল, বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতী ডলফিনসহ নানা রকম প্রাণী। আছে ১৮৬ প্রজাতির পাখি। ২০০৪ সালের প্রাণী জরিপ অনুযায়ী সে সময়ে সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছিল ৪৪০টি, হরিণ দেড় লাখ, বানর ৫০ হাজার, বন্যশূকর ২৫ হাজার, কুমির ২০০, উদবিড়াল ২৫ হাজার, ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৬ প্রজাতির চিংড়ি, ১৩ প্রজাতির কাঁকড়া, এক প্রজাতির লবস্টার ও ৪২ প্রজাতির মালাস্কা।
এ বন থেকে প্রতিবছর মধু আহরিত হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার মণ। ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ইউনেস্কো কমিশন সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে। মৌয়াল, জেলে ও বাওয়ালি মিলে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ তাদের জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল।
সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের টাইগার পয়েন্ট খ্যাত কটকা ও কচিখালী অভয়ারণ্য কেন্দ্র, মংলা বন্দরের অদূরে করমজল বন্যপ্রাণী ও কুমির প্রজনন কেন্দ্র, হারবাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র, এবং পশ্চিম বিভাগের হিরণপয়েন্ট খ্যাত নীলকমল অভয়ারণ্য, শেখেরটেক প্রাচীন মন্দির, সাতক্ষীরা-বুড়িগোয়ালিনীর কলাগাছিয়া ইকোট্যুরিজম সেন্টার, মান্দারবাড়িয়া অভয়ারণ্য- পর্যটকদের জন্য নির্ধারিত এসব স্পটে কুমির প্রজনন, অসুস্থ হরিণের পরিচর্যা, হাজার বছরের পুরোনো স্থাপনার ধ্বংসাবশেষসহ প্রকৃতির অপরূপ সব দৃশ্য উপভোগ করা যাবে।
এসব স্পটে এক থেকে পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত কাঠের তৈরি ওয়াকওয়ে ধরে বনের মাঝে হাঁটতে হাঁটতে বানর, হরিণ, গোসাপ, কাঁকড়া অথবা কুমিরের ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্যও দেখতে পারেন। টাইগার পয়েন্ট, হিরনপয়েন্ট বা বুড়িগোয়ালিনী, হারবাড়িয়া প্রভৃতি এলাকায় ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দেখাও মিলে যেতে পারে। এসব স্থানে রয়েছে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার।
বন বিভাগের নির্ধারিত ট্যুর স্পটের বাইরে জেলেদের মৌসুমী বসতি দুবলার চরেও যান অনেক পর্যটক। শীতকালে বঙ্গোপসাগর থেকে আহরিত মাছ শুঁটকী করার দৃশ্য আর বর্ষাকালে ইলিশ মাছ ধরার মহোত্সব দেখতে পাবেন সেখানে। দেখা যাবে হাজার হাজার জেলের কঠোর জীবন সংগ্রামের চিত্রও। প্রতিবছর এখানে রাস পূর্ণিমায় বসে রাসমেলা, যা পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ। হাজার হাজার তীর্থযাত্রীর পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বিপুলসংখ্যক পর্যটকও ভিড় করেন সেখানে। রাসমেলা পরিণত হয় লাখো মানুষের মিলনমেলায়।
কিভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন:
বছরে সুন্দরবনে গড়ে দুই লাখ পর্যটক ভ্রমণ করেন। এর মধ্যে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা ৩/৪ হাজার। এ খাত থেকে বছরে রাজস্ব আদায় হয় কোটি টাকার উপরে। বর্তমানে ছোট-বড় শতাধিক ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান সুন্দরবনে পর্যটন ব্যবসায় নিয়োজিত। তবে এগুলোর মধ্যে ২০ থেকে ২২টি মাত্র উন্নত সেবা প্রদান করে থাকে।
মংলা ও সাতক্ষীরার নীলডুমুর থেকে সীমিত পরিসরে দিনের বেলায় কয়েক ঘন্টার জন্য ছোট ছোট জলযানে সাফারি পার্ক, করমজল ও হারবাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র এবং ইকো পার্ক কলাগাছিয়ায় ভ্রমণে যাওয়া যায়। তবে সুন্দরবনে ইকো ট্যুর উপভোগ করতে যেতে হয় যথেষ্ট সময় হাতে নিয়ে গভীর জঙ্গলে। ভ্রমণে নৌযান হচ্ছে অপরিহার্য বাহন।
সুন্দরবনে প্রবেশাধিকার অবারিত নয়। সংরক্ষিত বনাঞ্চল বলে বনবিভাগের অনুমতি গ্রহণ বাধ্যতামূলক। বিনা অনুমতিতে সুন্দরবনে ঢোকা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পর্যটক, গবেষক, তীর্থযাত্রী, বনজীবী- সবাইকেই নির্দিষ্ট ভ্রমণ ফি, গাইড ফি, নৌযান ফি (বিএলসি), নিরাপত্তা গার্ড ফি, টেলিকমিউনিকেশন ফি, ভিডিও ক্যামেরা ফি ইত্যাদি দিতে হয় প্রতিদিনের জন্য।
নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় যারা সুন্দরবনে যাবেন তারা ঢাকা, খুলনা বা মংলা থেকে কিংবা অন্য কোথাও থেকে নৌযান ভাড়া নিয়ে যেতে পারেন। তাদের প্রথমে সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগীয় সদর দপ্তর বাগেরহাট বা পশ্চিম বিভাগীয় সদর দপ্তর খুলনা থেকে অনুমতি নিতে হবে সংশ্লিষ্ট ডিএফও’র কাছ থেকে। এরপর পূর্ব বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের সদর দপ্তর, বগি ও সুপতি, চাঁদপাই রেঞ্জের সদর দপ্তর ও ঢ্যাংমারি এবং পশ্চিম বিভাগের সাতক্ষীরা-বুড়িগোয়ালিনী স্টেশনের যে কোন একটিতে নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে প্রবেশপত্র সংগ্রহ করতে হবে।
বেসরকারি বিভিন্ন পর্যটন সংস্থার রয়েছে নিজস্ব সুপরিসর ও আধুনিক ‘ট্যুরিস্ট ভেসেল’, ভাড়া করা নৌযান, ক্যাটারিং সার্ভিস, গাইড সার্ভিস, বন বিভাগ থেকে অনুমতি গ্রহণ ব্যবস্থা, বিনোদন ব্যবস্থা ইত্যাদি। ট্যুর অপারেটরের মাধ্যমে যারা সুন্দরবনে যেতে চান তাদের যোগাযোগ করতে হবে অবসর, ছুটি ও বনবিবি ট্যুরিসস্ট ভেসেল পরিচালনাকারী ঢাকার দি গাইড ট্যুরস লিঃ , ডিঙি ও ভেলা ভেসেলের বেঙ্গল ট্যুরস লিঃ, হলিডেস ট্যুর , সিলভার ওয়েভ, খুলনার বাদাবন ও ওটি আলী ভেসেল পরিচালক রূপান্তর ইকো ট্যুরিজম লিঃ, রয়েল গন্ডোলা ভেসেলের রয়াল ট্যুর, সুন্দরবন ওয়ার্ন্ডার্স এন্ড এডভেঞ্চার্স লিঃ, এমভি বাওয়ালীর পার্গমার্ক ট্যুর, ডিসকোভারি ও ফ্লোটিংহোমের পরিচালনাকারী ডিসকভারি, সাতক্ষীরার তিনটি ভেসেল পরিচালনাকারী বরসা ট্যুরিজম।
ট্যুর অপারেটররা ঢাকা, খুলনা, সাতক্ষীরা ও মংলা থেকে পর্যটকদের সুন্দরবনে নিয়ে যান। ঢাকা থেকে পর্যটকদের বাস, মাইক্রোবাস, ট্রেন, বিমান, স্টিমারযোগে এনে ট্যুরিস্ট ভেসেলে তোলা হয়। এসব ট্যুরিস্ট ভেসেলে তিন রাত দুই দিনের জন্য জনপ্রতি ফি নেয়া হয় ঢাকা-সুন্দরবন-ঢাকা নয় হাজার টাকা থেকে ২১ হাজার টাকা পর্যন্ত।
সুন্দরবনে মংলা সমুদ্র বন্দর এবং সাতক্ষীরার বুড়িগোয়ালিনীর নীলডুমুর থেকে ছোট ছোট ট্রলারে করে স্বল্প ভাড়ায় বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে করমজল ও হারবাড়িয়া এবং কলাগাছিয়া ট্যুর স্পটে দিনের বেলায় ভ্রমণের সুযোগ রয়েছে।
ট্যুরিস্ট ভেসেল বা নৌযান ছাড়াও সুন্দরবনের অভয়ারণ্যে হিরণপয়েন্টের নীলকমল এবং টাইগার পয়েন্টের কচিখালী ও কটকায় বন বিভাগের রেস্টহাউজে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। যার ফি নীলকমলে দেশি পর্যটকদের জন্য প্রতি কক্ষ তিন হাজার টাকা, চার কক্ষ ১২ হাজার টাকা।
কচিখালী প্রতি কক্ষ তিন হাজার টাকা, চার কক্ষ ১০ হাজার টাকা। কটকা প্রতি কক্ষ দুই হাজার টাকা, দুই কক্ষ চার হাজার টাকা। বিদেশিদের ক্ষেত্রে নীলকমলে পাঁচ হাজার ও ২০ হাজার টাকা, কচিখালীতে পাঁচ হাজার ও ১৫ হাজার টাকা এবং কটকায় পাঁচ হাজার ও ১০ হাজার টাকা। সুন্দরবনের পাশে সাতক্ষীরা শহরে সাধারণ মানের হোটেল ও শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জে এনজিও সুশীলনের রেস্টহাউস ও ডরমেটরিতে একক, পরিবার ও গ্রুপ নিয়ে থাকার সুবিধা রয়েছে।
মংলায় আছে পর্যটন কর্পোরেশনের হোটেল, পশুর বন্দরে সাধারণ হোটেল আছে পর্যটকদের থাকার জন্য।
খুলনা মহানগরে হোটেল রয়েল, ক্যাসেল সালাম, হোটেল টাইগার গার্ডেন, হোটেল ওয়েস্ট ইন্, হোটেল সিটি ইন, হোটেল মিলিনিয়াম ইত্যাদি মানসম্পন্ন হোটেল ছাড়াও সাধারণ মানের হোটেলে সুন্দরবনে ভ্রমণেচ্ছুরা অবস্থান করে থাকেন।
সুন্দরবন ভ্রমণ ফি:
অভয়ারণ্য এলাকায় প্রত্যেক দেশি পর্যটকের প্রতিদিনের ফি- ১৫০ টাকা, ছাত্র-ছাত্রী-৩০ টাকা, বিদেশি পর্যটক- ১৫০০ টাকা। অভয়ারণ্যের বাইরে দেশি পর্যটক-৭০ টাকা ও বিদেশি- ১০০০ টাকা, ছাত্র-ছাত্রী- ২০টাকা, গবেষক ৪০ টাকা। করমজল দেশি ২০ টাকা, বিদেশি ৩০০ টাকা।
যানবাহনের ভাড়া:
১. হেলিকপ্টার/সী প্লেন- এককালীন ৩০ হাজার টাকা, নবায়ন ফি ১০ হাজার টাকা।
২. ১০০ ফুটের ঊর্ধ্বে লঞ্চ ১৫ হাজার টাকা, নবায়ন ফি চার হাজার টাকা, লঞ্চ ৫০ ফুট থেকে ১০০ ফুট এককালীন ১০ হাজার টাকা, নবায়ন ফি তিন হাজার টাকা।
৩. ৫০ ফুটের নিচে সাড়ে সাত হাজার টাকা ও নবায়ন ফি আড়াই হাজার টাকা, ট্রলার তিন হাজার টাকা ও নবায়ন- ১৫০০ টাকা।
৪. স্পিডবোট পাঁচ হাজার টাকা ও দুই হাজার টাকা।
৫. জালিবোট (ট্যুরিস্ট বোট) দুই হাজার টাকা ও এক হাজার টাকা।
বন বিভাগের নির্দিষ্ট ভ্রমণ ফি ছাড়াও প্রতিদিন গাইড ফি ৫০০ টাকা, লঞ্চ ক্রু ফি ৭০ টাকা, নিরাপত্তা গার্ড ফি ৩০০ টাকা, টেলিকমিউনিকেশন ফি ২০০ টাকা, ভিডিও ক্যামেরা ফি দেশি পর্যটক ২০০ টাকা এবং বিদেশি পর্যটক ৩০০ টাকা।
সুন্দরবনে রাস পূর্ণিমা উপলক্ষে তীর্থ যাত্রীদের ফি তিন দিনের জন্য জনপ্রতি ৫০ টাকা, অনিবন্ধনকৃত ট্রলার ৮০০ টাকা, নিবন্ধনকৃত ট্রলার ২০০ টাকা এবং ট্রলারের অবস্থান ফি প্রতিদিন ২০০ টাকা।