বাংলাদেশে প্রথম ট্যুরিজম ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল|Friday, January 10, 2025
সাইটে আপনার অবস্থানঃ Home » জাতীয় » নতুন দিগন্তের সূচনা করবে মাতারবাড়ী বন্দর, সুবিধা পাবে কলকাতা-হলদিয়াও

নতুন দিগন্তের সূচনা করবে মাতারবাড়ী বন্দর, সুবিধা পাবে কলকাতা-হলদিয়াও 

115713_bangladesh_pratidin_Matarbari

কক্সবাজারের মাতারবাড়ী বন্দর চালু হবে ২০২৬ সালে। সেখানে ভিড়বে মাদারভেসেল বা বড় জাহাজ।

তারপর ফিডার ভেসেল বা ছোট ছোট জাহাজে পণ্য, কনটেইনার চলে আসবে চট্টগ্রাম, মোংলা, পায়রা বন্দরে।
ট্রানজিট সুবিধায় ভারতের ‘ল্যান্ডলক’ এরিয়া বা সেভেন সিস্টার্স এবং নেপাল, ভুটানে চলে যাবে কনটেইনার বা আমদানি পণ্য। এখানেই শেষ নয়, সিঙ্গাপুরের চেয়ে কম দূরত্বের মধ্যে মাতারবাড়ী বন্দরের অবস্থান হওয়ায় এর সুবিধা পাবে কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরও।

সব মিলিয়ে ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণ, সুনীল অর্থনীতির (ব্লু ইকোনমি) হাতছানি কাজে লাগানোর দূরদর্শিতার কারণে মাতারবাড়ী বন্দর হবে মেরিটাইম ওয়ার্ডের নতুন গন্তব্য।

অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ১৪ মিটারের বেশি ড্রাফটের (জাহাজের পানির নিচের অংশ) জাহাজ ভিড়লেই গভীর সমুদ্রবন্দর বলা হয়। আমাদের সোনাদিয়াতে সত্যিকারের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সুযোগ ছিল। ২০১৪ সালে এটি নির্মাণে চীনের সঙ্গে এমওইউ হওয়ার কথা ছিল। কিছুটা দেরিতে হলেও জাইকার অর্থায়নে মাতারবাড়ীতে মাদার ভেসেল ভিড়ানোর উপযোগী বন্দর নির্মাণ প্রকল্পের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। কনসালটেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যদিও শুরুতে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাঁচামালের জাহাজ ভেড়ানোর জন্য বন্দরটির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল।

যদি এ বন্দরটি পাঁচ-ছয় বছর পর অপারেশনে যায় তবে শুধু বাংলাদেশের তিনটি বন্দর নয়, উপকৃত হবে ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্য খ্যাত ল্যান্ডলক এরিয়া আসাম, অরুণাচল, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, মনিপুর, মিজোরাম ও ত্রিপুরা এমনকি নেপাল, ভুটানও। সবচেয়ে বড় কথা, সিঙ্গাপুরের চেয়ে কম দূরত্বে থাকায় প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতা ও হলদিয়া বন্দর কেন্দ্রিক ফিডার জাহাজগুলো মাতারবাড়ী বন্দর ব্যবহার করলে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মাতারবাড়ী থেকে সমুদ্র ও নদীপথে চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি, সিসিটি, পিসিটি, বে টার্মিনাল এবং মোংলা ও পায়রা বন্দরে ফিডার ভেসেল চলাচলের অবকাঠামো তৈরিই বলা যায়। চার-পাঁচ বছরের মধ্যে মাতারবাড়ী বন্দরের সঙ্গে সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথে কনটেইনার-কার্গো পরিবহনের নেটওয়ার্কও হয়ে যাবে নিঃসন্দেহে।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আহসানুল হক চৌধুরী বলেন, ফিজিবিলিটি স্টাডি, প্রকল্প গ্রহণ আর বাস্তবায়ন এক কথা নয়। দীর্ঘদিন ধরে আমরা আশার বাণী শুনে আসছি। যদি মাতারবাড়ী বন্দর চালু হয় এবং মাদারভেসেল ভিড়ে তাহলে এটি হবে ‘মেরিটাইম হাব’। যার সুফল শুধু বাংলাদেশের আমদানি, রফতানিকারক, সরকারই পাবে না একই সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোও লাভবান হবে। ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্টের আওতায় ভারত, নেপাল, ভুটানের কনটেইনার বা কার্গোই শুধু আসবে না মাতারবাড়ী থেকেই কলকাতা, হলদিয়াসহ কাছের বন্দরগুলোতে ফিডার সার্ভিস চালু হয়ে যাবে। প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে বাংলাদেশ।

তবে এর জন্য মাতারবাড়ীতে বন্দরকেন্দ্রিক ফ্যাসিলিটিগুলো নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে লিংক রোড, রেলপথ, অবকাঠামো, ব্যাকআপ ইয়ার্ড, ডেলিভারি ইয়ার্ড, অফডক, কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের জন্য কি গ্যান্ট্রি ক্রেন ইত্যাদি।

চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়ন ও গবেষণা পরিষদের সভাপতি কমোডর (অব.) জোবায়ের আহমদ বলেন, মাতারবাড়ী বন্দর চালু হলে প্রচুর ট্রানজিট কার্গো বা কনটেইনার পরিবহনের সুযোগ পাবে বাংলাদেশ। বিশেষ করে ভারতের ৭টি ল্যান্ডলক রাজ্যের পণ্য পরিবহনে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। বাংলাদেশের ট্রানজিট সুবিধায় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে সড়কপথে ‘৭০০-৮০০ কিলোমিটার’ পরিবহন ব্যয় সাশ্রয় হবে। বাংলাদেশ পাবে ট্রানজিট ফিসহ বিভিন্ন খাতে রাজস্ব।

২০১৮ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত ‘অ্যাগ্রিমেন্ট অন দ্য ইউজ অব চট্টগ্রাম অ্যান্ড মোংলা পোর্ট ফর মুভমেন্ট অব গুডস টু অ্যান্ড ফরম ইন্ডিয়া’ চুক্তি এবং উক্ত চুক্তির আওতায় প্রণীত এসওপি অনুযায়ী গত ১৬-২১ জুলাই ট্রানজিট পণ্যবাহী চারটি কনটেইনারের প্রথম ট্রায়াল রান সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মো. জাফর আলম বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে এগোচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে অনেক বেশি প্রবৃদ্ধি আশা করা যায় না। তাই পিসিটি, বে টার্মিনাল ও মাতারবাড়ী প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ডিমান্ড ফোর কাস্ট অ্যানালাইসিস করে মাতারবাড়ীতে বন্দর করা হচ্ছে। ৪৬০ মিটার দীর্ঘ কনটেইনার টার্মিনাল করা হচ্ছে। যেখানে ৮-১০ হাজার টিইইউ’স নিয়ে একেকটি জাহাজ ভিড়বে। এখন চট্টগ্রাম বন্দরে দুই-আড়াই হাজার টিইইউ’স নিয়ে জাহাজ ভিড়তে পারে। আরেকটি মাল্টিপারপাস জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে যেখানে কার্গো ও কনটেইনার দুই ধরনের জাহাজই আসবে।

মাতারবাড়ীকে গ্রিন পোর্ট উল্লেখ করে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর কনটেইনার পোর্ট ছিল না। এটি ছিল গ্রে পোর্ট। আমরা যাকে কনটেইনার পোর্টে রূপান্তর করেছি। মাতারবাড়ী বন্দর একটি নতুন জায়গায় নির্মিত হচ্ছে। পরিকল্পনা করেই কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের জন্য তৈরি করছি। এটি আধুনিক হবে। ব্যবসায়ীরা আকৃষ্ট হবে কারণ বড় জাহাজে খরচ কম লাগবে। চীন থেকে আমাদের বেশিরভাগ আমদানি পণ্য আসে। মাতারবাড়ী চালু হলে শুরুতে চীন থেকে তিন দিন কমে যায় এবং চট্টগ্রাম-মাতারবাড়ী ৭০ কিলোমিটার ৮-১০ ঘণ্টায় পরিবহন করা সম্ভব। ফিডারভেসেল থাকবে। ভবিষ্যতে চাহিদা অনুযায়ী নতুন নতুন জেটি, টার্মিনাল তৈরি হবে।

তিনি জানান, মাতারবাড়ী বন্দরের ফিজিবিলিটি ও ফ্রি ফিজিবিলিটি স্টাডি জাপানের অর্থায়নে হয়েছে। আমাদের সরকারকে কোনো পয়সা ব্যয় করতে হয়নি। এ কনসালটেন্সির জন্য আমাদের ব্যয় করতে হচ্ছে। এর জন্য জাইকা থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে। দশমিক ০১ শতাংশ সুদে, ২০ বছর পর এটি শোধ করতে হবে। খুবই সহজ শর্তে ঋণ। এ কনসালটেন্সিতে মোট ২৩৪ কোটি টাকা খরচ হবে। এখন থেকে শুরু করে ২০২৬ সাল পর্যন্ত এর ব্যাপ্তি। এখানে ডিজাইন, সুপারভিশন, মনিটরিং, টেন্ডারে সহায়তা এবং পরবর্তী ওয়ারেন্টি পিরিয়ডও অন্তর্ভুক্ত।

২৬ কিলোমিটার রাস্তাসহ মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণে খরচ হবে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা ব্যয় হবে। ৮ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা শুধু বন্দরের জন্য। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ দিচ্ছে ২ হাজার ২১৩ কোটি টাকা। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে টাকা দেওয়া হবে জমি কেনার জন্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রথম ধাপের জন্য ২৮৮ একর জমি অনুমোদন করেছেন।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম আবুল কালাম আজাদ বলেন, মাতারবাড়ী বন্দর চালু হলে কলকাতা, হলদিয়া বন্দরেও ফিডার সার্ভিস চালু হয়ে যাবে। কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস বিবেচনায় এটি যুক্তিযুক্ত। পাশাপাশি ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্টের পণ্য, কনটেইনারও পরিবহন হবে মাতারবাড়ী বন্দর দিয়ে।

গত ১৬ নভেম্বর মাতারবাড়ী পোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের জাপানি কনসালটেন্ট নিপ্পন কোয়েইর সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওইদিন থেকেই মূলত মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের মূল কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে বন্দর নির্মাণের কার্যক্রম সম্পন্নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

শেয়ার করুন !!Share on FacebookTweet about this on TwitterShare on Google+Share on LinkedInShare on RedditBuffer this pageDigg thisShare on TumblrPin on PinterestShare on StumbleUponFlattr the authorEmail this to someone