চুল পড়ার কারণ ও সমাধান
চুল পড়া যেকোনো বয়সের মানুষের কাছেই অস্বস্তিকর, তবে তরুণদের কাছে এটা এক বিরাট আতংকের নাম। চুল পড়া নিয়ে বেশিরভাগ মানুষই অনেক বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েন। চুল পড়া একটা স্বাভাবিক বিষয়। তবে অতিরিক্ত হারে চুল পড়ার সমস্যা দেখা দিলে এর কারণ খুঁজে বের করা প্রয়োজন।
চুল পড়ার কারণ : বিভিন্ন কারনে অতিরিক্ত পরিমাণে চুল পড়তে পারে। এর মধ্যে প্রধান কারণ গুলো হল
* শারীরিক পরিবর্তন: বয়ঃসন্ধি, গর্ভনিরোধক পরিবর্তন, গর্ভাবস্থা, স্তন্যদানকারী মা, মেনোপোজ ও পুষ্টিহীনতা চুল বৃদ্ধির চক্রকে আক্রান্ত করে। যা এটা চুল পড়ার অন্যতম কারণ। সন্তান জন্মদান শরীরের ওপরে অনেক চাপ সৃষ্টি করে। যা চুলের ফলিকলকেও আক্রান্ত করে। এই চাপ চুলের ফলিকলকে আলগা করে দেয় যা ‘টেলোজেন এফ্লুভিয়ামৎ’ নামে পরিচিত।
* বংশগত: ‘অ্যান্ড্রোজেনেটিক অ্যালোপেসিয়া’ বা টাক পড়ার সমস্যা অধিকাংশ পুরুষের মাঝেই দেখা দেয়। এটি মূলত বংশগত। দেখা যায় বাবা/চাচাদের টাক মাথার ইতিহাস থাকলে পরবর্তী প্রজন্মেরও বয়স বাড়লে টাক হয়ে থাকে।
* মানসিক চাপ: মানসিক চাপ প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের স্বল্পতার সৃষ্টি করে চুল দুর্বল করে ফেলে। দীর্ঘ মেয়াদি মানসিক চাপ ও ভীতি ‘অ্যালোপেসিয়া’ বা নির্দিষ্ট স্থানে চুল পড়ার সমস্যা দেখা দেয়।
* রেডিয়েশন থেরাপি ও ওষুধ: ক্যান্সারের কারণে রেডিয়েশন থেরাপি দিতে হয়। এছাড়া ওষুধ যেমন- অ্যান্টিডিপ্রেশন, উচ্চ রক্তচাপ ও আর্থ্রাইটিসের ওষুধ এবং কেমোথেরাপির ওষুধ চুল পড়ার সমস্যা সৃষ্টি করে।
* চুল পরিচর্যার উপাদান: চুল পরিচর্যার জন্য প্রসাধনী যেমন- শ্যাম্পু, কন্ডিশনার ইত্যাদিতে থাকা রাসায়নিক উপাদান চুল পড়ার অন্যতম কারণ। যেহেতু এসব পণ্য ব্যবহার করা আবশ্যক, তাই চুলের ধরন ও প্রয়োজন বুঝে প্রসাধনী ব্যবহার করতে হবে।
* ভিটামিনের স্বল্পতা: অপুষ্টি বা দেহে বিভিন্ন ভিটামিন ও মিনারেলস এর অভাবে মূলত চুল পড়ার প্রধান কারণ। খাদ্য গ্রহনের সময় যদি আমাদের শরীরের চাহিদা অনুযায়ী সব ধরনের পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করা না হয়, তবে তা শরীরের ঘাটতি পূরণ করতে পারবেনা, ফলে অন্য সব কিছুর মতো চুলের গোড়াও দুর্বল হয়ে যাবে।
* সংক্রমণ: ত্বকে ব্যাক্টেরিয়া ও ফাঙ্গাসের সংক্রমণের কারণে চুল পড়া ও টাক হওয়ার সমস্যা দেখা দেয়।
* দূষণ: ধুলা ও ক্ষতিকারক উপাদান মাথার ত্বককে আক্রান্ত করে এবং চুলের প্রোটিনে ক্ষতি সাধন করে। তাছাড়া, বায়ু দূষণ চুল পড়া, অকাল্পক্কতা ও অকালে চুল ঝড়ে যাওয়ার সমস্যা সৃষ্টি করে।
* জীবনযাত্রা: অপর্যাপ্ত ঘুম, ধূমপান, ওষুধ খাওয়া, বাইরে রোদে কাজ করা ইত্যাদি চুল পড়ার অন্যতম কারণ।
চুল পড়া প্রতিরোধে করনীয়: যোগ ব্যায়াম, ধ্যান, শরীরচর্চা মন ও শরীর ভালো রাখার অন্যতম উপায়। এগুলো চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখতেও সহায়তা করে। এরপরেও চুল পড়ার সমস্যা না কমলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
১. ভিটামিন বি৭ বা বায়োটিন: এটি চুলের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে, চুল পড়া কমায়, চুলের পুরুত্ব বাড়ায় এবং নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে। যদি রেগুলার খাবারে ভিটামিন বি৭ এর ঘাটতি হয় তবে চুল পড়া বেড়ে যায়। কারো শরীরে বায়োটিন এর অভাব বুঝা যায় তার চুল পড়ার পরিমাণ দেখে। শরীরে বায়োটিনের অভাব দূর করতে হলে আহারে বায়োটিনযুক্ত খাবার দিতে হবে যেমন – সবুজ শাক, বিভিন্ন ধরণের বীচি জাতীয় খাবার, বিভিন্ন ধরণের ডাল, কলা ইত্যাদি।
২. ভিটামিন-এ: দেহে ভিটামিন-এ এর অভাবে অনেক গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি হয়। শরীরে ভিটামিন-এ এর অভাব বুঝা যায় যখন চুলের আদ্রতা হারায়, চুল শুকিয়ে প্রাণহীন হয়ে যায়। তাই আহারে ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ খাবার যুক্ত করতে হবে। কলিজা, মাছের তেল, ডিম, দুধ, সবুজ শাকসবজি, বিভিন্ন রঙিন ফলমূল ও সবজি যেমন – মিষ্টিকুমড়া, টমেটো, গাজর, মিষ্টি আলু ইত্যাদি খাদ্য হল ভিটামিন-এ এর প্রধান উৎস।
৩. ভিটামিন-ডি: চুলপড়া কমাতে ভিটামিন-ডি অনেক গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে মেয়েদের জন্য। গবেষণায় দেখা যায় যে সকল মেয়েদের চুলপড়ার প্রবণতা অনেক বেশি তারা ভিটামিন ডি এর অভাবে ভুগে থাকে। সূর্যরশ্মি আমাদের ত্বকে ভিটামিন-ডি উৎপাদনে সাহায্য করে। এছাড়া সামুদ্রিক মাছ, মাছের তেল, ডিমের কুসুম ইত্যাদি ভিটামিন-ডি এর ভালো উৎস।
৪. ভিটামিন-সি: এটি একটি ভালো মানের এন্টিঅক্সিডেন্ট। অর্থাৎ এটি দেহ কোষে ফ্রি রেডিক্যাল ক্ষতির পরিমাণ সীমিত করে। কোষের জারণের ফলে উৎপন্ন অতিরিক্ত ফ্রি রেডিক্যাল সমূহ দেহের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন কাজে সমস্যা সৃষ্টি করার সাথে আমাদের ত্বক ও চুলের অনেক ক্ষতি করে। একারণে চুলের ফলিকল ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে চুলের ক্ষতি আরো বাড়তে থাকে। ভিটামিন-সি এর মতো এন্টিঅক্সিডেন্ট সমূহ এই জারণ এর ক্ষতি কমিয়ে দেয়। ভিটামিন-সি অকালে চুল পাকার হাত থেকে রক্ষা করে, চুল পড়া রোধ করে। পেয়ারা, আমলকী, কমলালেবু, লেবু, জাম্বুরা, কামরাঙা, বিভিন্ন ধরণের বেরি জাতীয় ফল, সীমের বীচির অংকুর ইত্যাদি হল ভিটামিন-সি এর সবচেয়ে ভালো উৎস।
৫. ভিটামিন-ই: এটি চুলপড়া রোধে একটি অন্যতম ভিটামিন যা একটি ভালো এন্টিঅক্সিডেন্ট ও। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় যাদের চুলপড়ার সমস্যা অতিরিক্ত তাদের মাথার ত্বকে এন্টিঅক্সিডেন্টের পরিমাণ খুব কম এবং চুলের গোড়ায় অক্সিডেটিভ ড্যামেজ বা কোষের জারণের ফলে হওয়া ক্ষতি বেশি দেখা যায়। খাদ্যের সাথে ভিটামিন-ই যুক্ত খাবার গ্রহণ করলে এবং চুলপড়া খুব বেশি হলে ভিটামিন ই ক্যাপসুল সাপ্লিমেন্টারী হিসেবে খাওয়া যায়। ভিটামিন ই যুক্ত খাবার হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের বাদাম, বিশেষ করে আমন্ড বা কাঠবাদাম, পুইশাক, পালংশাক, সরিষা শাক, ধনেপাতা, ব্রকোলী, এভোকাডো, বিভিন্ন বাদামের তেল, জলপাইয়ের তেল, পেপে ইত্যাদি। আমাদের দেশে বর্তমানে একটা বিষয় অনেক প্রচলিত আছে, কারো চুল পড়া শুরু হলেই বা চুলের কোন সমস্যা দেখা দিলেই বাজার থেকে ভিটামিন-ই ক্যাপসুল কিনে খাওয়া শুরু করেন। কিন্তু আসলে কি পরিমাণ ভিটামিন-ই গ্রহণ করতে হবে সেদিকে কারো খেয়ালই থাকে না। কোন ভিটামিন বা মিনারেল সাপ্লিমেন্ট ব্যবহারের আগে অবশ্যই ডাক্তার বা ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ নিতে হবে। ভিটামিন-ই ক্যাপসুল খাওয়ার আগে ভিটামিন ই যুক্ত খাবার খেয়ে দেখতে হবে, যদি তাও ভিটামিন ই এর অভাব না কমে তবেই ক্যাপসুল গ্রহণ করা উচিত।
৬. আয়রন বা লৌহ : গবেষণায় দেখা যায় আয়রনের অভাবে এনিমিয়া হলে চুল পড়া অনেক বেড়ে যায়। আয়রনের অভাবে বেশিরভাগ সময় চুল পড়ে থাকে। আয়রনের ভাল উৎস গুলো হল সীমের বীচি, ডার্ক চকলেট, মসুর ডাল, মাংস, কলিজা, ডিম, বাদাম, শুকনো ফল, ঢেঁকিছাটা লাল চাল ইত্যাদি।
৭. জিংক – জিংকের অভাবেও চুল পড়ে থাকে। মাথায় টাক হওয়ার রোগীদের রক্তে জিংকের অভাব লক্ষ্য করা যায়। সাধারণত টাক মাথার রোগীদের দেহে জিংকের বিপাক ঠিক মত হয়না যার ফলে রক্তে জিংকের পরিমাণ কমে যায়। তাই জিংক যুক্ত খাবার দেওয়ার সাথে সাথে জিংক ঠিকমত বিপাক হওয়ার জন্য চিকিৎসা করতে হবে। জিংকের সবচেয়ে ভালো উৎস হল মটরশুঁটি, রসুন, মিষ্টিকুমড়ার বীচি। এছাড়া মুরগি, গরুর মাংস, গম বা লাল আটা, পালংশাক, বাদাম, ডার্ক চকলেট ইত্যাদি জিংকযুক্ত খাবার।
. আয়োডিন – দেহের থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যক্রমে সমস্যা হলে চুল পড়তে পারে। আয়োডিন এই থাইরয়েড হরমোন নিঃসরণে কাজ করে থাকে। ২৮% থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যায় ভোগা মানুষদের চুল পড়া ও টাক মাথার সমস্যা হয়ে থাকে। সঠিক পরিমাণ থাইরয়েড হরমোন নিঃসরণ না হলে চুলের বৃদ্ধি হয় না, যার ফলে চুলের ঘনত্ব পাতলা হতে থাকে। এক্ষেত্রে আয়োডিন গ্রহণের মাত্রা বাড়াতে হবে। আয়োডিন যুক্ত খাদ্য গুলো হল সামুদ্রিক খাবার, ক্রেনবেরি, স্ট্রবেরি, পনির, দই, দুধ, চিংড়ি, বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ, কলা, আনারস ইত্যাদি।
আমাদের প্রতিদিনের খাবার তালিকাকে একটু ভালো মত তৈরি করে নিলে, তাতে প্রতিদিন প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেল যুক্ত খাবার যোগ করলে দেহে এগুলোর অভাব হবেনা। চুল পড়তে দেখলে বাজারে পাওয়া প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহার না করে আগে নিজের নিত্যদিনের খাবারের দিকে নজর দেওয়া উচিত। সঠিক খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে চুলপড়া কমিয়ে আনা যায়।