বিএনপিতে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার আলোচনা
রাজপথের অন্যতম বিরোধীদল বিএনপি তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সাথে জোটগত সম্পর্ক রাখবে কিনা- সেই প্রশ্নে দলটিতে নতুন করে আবার আলোচনা শুরু হয়েছে বলে দলটির একাধিক সূত্রে জানা গেছে। প্রায় ছয় বছর ধরে জামায়াতের সাথে দূরত্ব রেখে বিএনপি বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়েছে এবং তা পালন করছে। তবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে জামায়াত রয়েছে।
বিএনপি নেতাদের অনেকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপনের নানা কর্মসূচি নিয়ে বিএনপি যখন মাঠে নেমেছে, তখন দলটিতে জামায়াতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার আলোচনা জোরালো হয়েছে। এখন আন্তর্জাতিক এবং দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোন কৌশল না খাটিয়ে জামায়তের সাথে সম্পর্ক নিয়ে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জামায়াতের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে তাদের দলে আলোচনা চলছে। যদিও তারা এখনও কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি।
শেষ পর্যন্ত বিএনপির নেতৃত্ব জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে পারবে কিনা-দলটির ভেতরে সেই প্রশ্নও রয়েছে।
আলোচনা এখন বিএনপির সর্বোচ্চ ফোরামে
জামায়াতে ইসলামীর সাথে জোটগত সম্পর্ক রাখা না রাখার প্রশ্নকে প্রথমবারের মতো আলোচ্যসূচি হিসাবে নিয়ে আলোচনা চালানো হচ্ছে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বলেছেন, তাদের নীতি নির্ধারণী ফোরামে বিষয়টি আলোচনায় আসে গত বছরের শেষ দিকে। মাঝে সেই আলোচনায় কিছুদিন বিরতি ছিল এবং এখন আবার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। স্থায়ী কমিটির বেশির ভাগ সদস্যই জামায়াতের সাথে তাদের দলের জোটগত সম্পর্ক ছিন্ন করার পক্ষে মত দিয়েছেন। শুধু দু’জন সদস্য মত দিয়েছেন জামায়াতের সাথে সম্পর্ক বহাল রাখার পক্ষে। তবে মহাসচিব মির্জা ফকরুল ইসলাম এখনো তার মতামত দেননি।
তারা আরো বলেছেন, স্থায়ী কমিটি সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বিষয়টিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তাদের দলের নেত্রী খালেদা জিয়ার কাছ থেকে তারা এমন ইঙ্গিত পেয়েছেন।
দু’টি মামলায় সাজা হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্ত সাপেক্ষে জেল থেকে মুক্তি নিয়ে ঢাকায় গুলশানের বাসভবনে অবস্থান করছেন খালেদা জিয়া। তিনি দলীয় বা রাজনৈতিক কোন কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন না। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অংশ নিয়ে থাকেন।
দলটির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বলেছেন, স্থায়ী কমিটিতে আলোচনায় এখন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার মতামত দেয়ার পর তারেক রহমান তার সিদ্ধান্ত দেবেন।
তবে শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য শেষ পর্যায়ে তাদের খালেদা জিয়ার কাছেই যেতে হতে পারে বলে তারা মনে করেন।
জামায়াত ২০ দলীয় জোটে থাকলেও অনেক দিন ধরে তাদের সাথে দূরত্ব রেখে বিএনপির কর্মসূচি নেয়ার বিষয় তুলে ধরেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তবে সম্পর্ক রাখা না রাখার প্রশ্নে তারা এখনও সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারেননি জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, “২০১৫ সালের পর থেকেই কিন্তু কর্মসূচির ক্ষেত্রে তাদের (জামায়াতে ইসলামী) সাথে আমাদের (বিএনপি)একটা দূরত্ব থেকে গেছে। সেটা আছেই এখনও, সেটা এখনও যায়নি। যদিও আমাদের ২০ দলীয় জোট এখনও অক্ষুণ্ন আছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে অবশ্যই আলাপ আলোচনা চলছে। কিন্তু কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।”
কিন্তু কর্মসূচি নেয়ার ক্ষেত্রে জামায়াতকে সাথে না রাখা এবং একইসাথে জামায়াতকে জোটে বহাল রাখা- এটা বিএনপির কৌশল কিনা, এই প্রশ্নে কৌশলেই জবাব দিয়েছেন মির্জা ফখরুল। বলেছেন, “কৌশলতো বিভিন্ন রকম থাকে। কিন্তু এ বিষয়টা আমরা এখন আলোচনা করছি। আমাদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। এখনও আমরা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারি নাই।”
বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কে টানাপোড়েন
বিএনপি নেতাদের অনেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া যখন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, সে সময় জামায়াত কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি বা কোন প্রতিবাদ করেনি। সেই বিষয়কে কেন্দ্র করে তখন থেকেই বিএনপির তৃণমূলে জামায়াত নিয়ে একটা বিরূপ মনোভাব তৈরি হতে থাকে।
দলটির নেতারা আরো বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বিএনপি যে বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়েছিল, সেই থেকে লম্বা সময় ধরে দলটির সব পর্যায়ের নেতা কর্মীদের মধ্যে হতাশা ছিল। এমন পরিস্থিতিতে জামায়াতকে বিএনপি সেভাবে পাশে পায়নি। বরং জামায়তের অনেক কর্মকাণ্ডের দায় বিএনপিকে বহন করতে হয়েছে বলে তারা মনে করেন।
বিএনপি নেতাদের অনেকে বলেছেন, ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে তাদের ২০ দলীয় জোট ব্যর্থ হয়। কিন্তু সে সময় এবং পরের বছর ২০১৫ সালের জানুয়ারিতেও সারাদেশে তাদের কর্মসূচি যে সহিংস রূপ নিয়েছিল, দেশে এবং বিদেশে, তার পুরো দায় বিএনপির ওপরই এসেছে। ফলে সেই ২০১৫ সাল থেকেই মাঠ পর্যায়ে জামায়াতের সাথে বিএনপির নেতা কর্মীদের সম্পর্কের টানাপোড়েন চরমে পৌঁছায়। বিএনপির নেতৃত্বও দলের হতাশা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য জামায়াতকে বাদ দিয়ে নিজেরা দলীয়ভাবে কর্মকাণ্ড চালাতে শুরু করে।
দলটির একাধিক নেতা বলেছেন, জেলা- উপজেলা পর্যায়ে বা তৃণমূল স্তরে বিএনপির নেতা কর্মীদের এখনও জামায়াতের সাথে কোন যোগাযোগ বা সম্পর্ক নেই। তবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন পেশাজীবী সংগঠনগুলোতে এখনও জামায়াতের প্রভাব রয়েছে বলে তারা মনে করেন। বিএনপির তৃণমূল থেকেই জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার জন্য দলটির নেতৃত্বের ওপর চাপ তৈরি করা হয়েছে।
দলটির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানিয়েছেন, ২০১৮ সালে ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতৃত্ব সারাদেশের নেতা কর্মীদের মতামত নিয়েছিল। সে সময় সারাদেশ থেকেই তাদের তৃণমূল স্তরের নেতাকর্মীরা জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার সুপারিশ করেছিলেন। সেই প্রেক্ষাপটে ২০ দলীয় জোটের বাইরে বিএনপি ড: কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামের আলাদা একটি জোট গঠন করেছিল। যদিও শেষপর্যন্ত নিবন্ধন না থাকার কারণে জামায়াতের প্রার্থীরা বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়েই সেই নির্বাচনে অংশ নেয়।
সঙ্গ ছাড়ার আলোচনার প্রেক্ষাপট
২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বরের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় দফায় সরকার গঠন করে। সেসময় বিএনপির সেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামের জোটের ব্যর্থতার প্রশ্ন ওঠে। সেই প্রেক্ষাপটে বিএনপিতে হতাশা বেড়ে যায়।
বিএনপি নেতারা বলেছেন, হতাশা এবং বিপর্যস্ত পরিস্থিতি কাটিয়ে তাদের দল সামনে কীভাবে এগুতে পারে, সে ব্যাপারে সুপারিশ বা প্রস্তাব তৈরির জন্য স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তিনি গত বছরের প্রতিবেদন দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে পেশ করেন। সেই প্রতিবেদনে জামায়াতের সাথে জোটগত সম্পর্ক না রাখার প্রস্তাব করে তার স্বপক্ষে কারণ এবং যুক্তিও তুলে ধরা হয়।
এই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই জামায়াত ইস্যুটি আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনায় আসে বিএনপির নীতি নির্ধারণী ফোরামে। এখন সেই আলোচনাই সিদ্ধান্ত নেয়ার পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।