বাংলাদেশে প্রথম ট্যুরিজম ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল|Wednesday, December 25, 2024
সাইটে আপনার অবস্থানঃ Home » জাতীয় » বাংলাদেশের অসামান্য অর্জনকে টেকসই করা যায় কী করে

বাংলাদেশের অসামান্য অর্জনকে টেকসই করা যায় কী করে 

041752Atiur_kalerkantho_pic

বাংলাদেশ পঞ্চাশে পা দিয়েছে। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। সুবর্ণ জয়ন্তীর পাশাপাশি জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকীর এই মাহেন্দ্রক্ষণে দেশ-বিদেশের পর্যবেক্ষকরা বাংলাদেশের এগিয়ে চলার ভঙ্গিটির দারুণ প্রশংসা করছেন। মহামারি সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিময় ধারা নিয়ে সবাই উচ্চকিত। বিশ্বব্যাংক আমাদের এ বছরের প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে তাদের প্রক্ষেপণ ২ থেকে ৩.৬ শতাংশে উন্নীত করেছে। সর্বশেষ এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউএনএসক্যাপ। জরিপের ভিত্তিতে তারা বলছে, এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে প্রবৃদ্ধি ৫.৯ শতাংশ হলেও চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৭.২ শতাংশ। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আমরা যে প্রত্যাশা করেছিলাম (৭.৭ শতাংশ) এই জরিপের ফল তার কাছাকাছি। বরাবর রক্ষণশীল পূর্বাভাস দিয়ে আসা বিশ্বব্যাংক তাদের পূর্বাভাসকে উন্নীত করার সংবাদ নিঃসন্দেহে ভালো। তবে হালে করোনা সংকটের দ্বিতীয় ঢেউ যেভাবে আমাদের সমাজে আছড়ে পড়ছে তার প্রভাব অর্থনীতিতে পড়তে বাধ্য। ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত ও কলকারখানায় কর্ম সীমিত করার নেতিবাচক প্রভাব সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর পড়বেই। তা ছাড়া হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন এবং অক্সিজেন নেওয়ার প্রয়োজন যাদের, তারা যদি সে সুযোগ না নিতে পারে, তাহলে পুরো সমাজে তার নেতিবাচক প্রভাব যে পড়বেই সে কথা মানতেই হবে।

সরকারের তরফ থেকে দ্বিতীয় দফা সাধারণ ছুটি বা লকডাউন এরই মধ্যে হয়েছে। আশা করছি, জনগণের মধ্যে যে ঢিলেঢালা অবস্থা বিরাজ করছিল, তা সহজেই কেটে যাবে। এটি সত্য যে এর ফলে বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক খাতে যুক্ত নিম্ন আয়ের মানুষ বিপাকে পড়বে। সে কথা মনে রেখে সরকার একটি হটলাইন চালু করতে পারে, যার মাধ্যমে সংকটে থাকা মানুষকে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিতে পারে স্থানীয় প্রশাসন। যেসব এলাকায় এমন বিপাকে পড়া মানুষের সংখ্যা বেশি, অন্তত সেখানে ১০ টাকা কেজি চালের কর্মসূচিটি ব্যাপক মাত্রায় সম্প্রসারিত করা দরকার। গেলবার এই কর্মসূচি বিশেষ সুফল দিয়েছিল। আগেরবার যে ধরনের বুদ্ধিমত্তা ও সামাজিক সক্রিয়তা দেখিয়ে বাংলাদেশের সরকার ও সরকারের বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছিল, আশা করি এবারও তার ব্যত্যয় হবে না। টিকা নেওয়ার পরও আমাদের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে যেতে হবে। আইসিইউ সংকটের কথা মাথায় রেখে যারা হাসপাতালে না গেলেই নয় এমন রোগী ছাড়া বাকিদের এখন দায়িত্বশীল আচরণ করা উচিত। বেশি করে জোর দেওয়া উচিত কড়াকড়িভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর। এই পরিস্থিতিতে আমাদের ডাক্তার ও সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যকর্মীদের নিঃস্বার্থ অবদানকে আরো সপ্রশংসিত দৃষ্টিতে দেখতেই হবে। তাঁদের নিরাপত্তা, আবাসন, প্রণোদনা এবং দ্রুত টিকাদানের বিষয়ে সংশ্লিষ্টজনদের আরো সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। ব্যক্তি খাতের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলোকেও মানবিকতার স্বার্থে আরো জোরালো ভূমিকা পালনের আহ্বান জানাচ্ছি। এই লকডাউন নিশ্চয়ই একটি বার্তা দেবে। তার পরও সব অংশীজনের সঙ্গে সমন্বয় করেই প্রশাসনকে মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে হবে।

কল্পনা করুন ১৯৭২ সালের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সেই দুর্বিষহ সময়টির কথা। পুরো দেশ ছাইভস্মে পরিণত হয়েছিল। সারা পৃথিবীর মধ্যে আমরা দ্বিতীয় দরিদ্রতম দেশ। আমাদের মোট অর্থনীতির আকার শুরুতে ৬.৩ বিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় ৯৩ ডলার। এক ডলারও নেই রিজার্ভে। প্রকট খাদ্যসংকট। একটি দম্পতির ঘরে ছয়-সাতটি সন্তান। জন্মহার প্রায় ৩ শতাংশের মতো। দারিদ্র্যের হার ৮০ শতাংশের মতো। গড় আয়ু মাত্র ৪৭ বছর। হাড়-জিরজিরে পেটমোটা শিশুদের চরম অপুষ্টির কথা না-ই বা বললাম। রাস্তাঘাট, রেল, সেতু, কালভার্ট, বন্দর ধ্বংসপ্রাপ্ত। এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসনের চ্যালেঞ্জ। এমনই এক সংকটকালে আশার বাণী মুখে নিয়ে দেশে ফিরলেন জাতির পিতা। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ দেশে পা রেখেই তিনি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বলেছিলেন, ‘যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে, পূর্ণ হবে না।’ এই কথাগুলো আরো বিস্তারিতভাবে তিনি বলেছিলেন ৯ মে ১৯৭২ রাজশাহী মাদরাসা প্রাঙ্গণে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কী চাই? আমি চাই আমার বাংলার মানুষ পেটভরে ভাত খাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার বেকার কাজ পাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ হেসে-খেলে বেড়াক।’ ওই ভাষণেই তিনি আরো বলেন, ‘কিন্তু বড় দুঃখ ভাই, জালেমরা কিছুই রেখে যায়নি। সমস্ত নোটগুলি পর্যন্ত পুড়িয়ে দিয়ে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রা, বিশ্বাস করুন, যেদিন আমি এসে সরকার নিলাম এক পয়সার বৈদেশিক মুদ্রাও পাইনি।’ এমন অভাব-অনটনের মধ্যেও তিনি সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখিয়েছেন স্বদেশবাসীকে। সবার মধ্যে লড়াকু একটি মন গেঁথে দিতে পেরেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু তাঁর বাংলাদেশের জন্য একটি গণমুখী, অধিকারভিত্তিক সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন। সেই সংবিধানের মূল খুঁটি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। তাঁর সমাজতন্ত্র ছিল স্বদেশি। এর সঙ্গে গণতন্ত্র অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত ছিল। সংবিধানটি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের এক চমৎকার দলিলও বটে। এতে ছিল গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বিকেন্দ্রায়ন, বিনা মূল্যে বাধ্যতামূলক শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন, পল্লী উন্নয়ন, কৃষি বিপ্লব, শ্রমিকদের মুক্তি, কর্মসংস্থানের সুযোগ, মৌলিক চাহিদা পূরণ, সমবায়, ব্যক্তি খাত এবং রাষ্ট্রীয় খাতে সুসমন্বয়সহ জনগণের মুক্তির নানা অঙ্গীকার। সংবিধানে এসব মৌল আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য তিনি প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা তৈরি করলেন, যাতে কৃষি ও শিল্পের যুগপৎ বিকাশের নীতি গ্রহণ করেন। কৃষির আধুনিকায়নের জন্য সবুজ বিপ্লব শুরু করে দেন। আর শিল্প খাতকে রাষ্ট্রীয় করেছিলেন উদ্যোক্তাবিহীন পরিবেশে দ্রুত উৎপাদন বাড়ানোর জন্য। এর মধ্যেই আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছিল খাদ্য সাহায্যের নাম করে।

দেশের ভেতরে অসহিষ্ণু তরুণ ছাড়াও প্রবীণ রাজনীতিকরাও তাঁকে এতটুকু ফুরসত দেননি। তীব্র সমালোচনা, অন্তর্ঘাত এবং সামাজিক অশান্তি তৈরির নানা আক্রমণ প্রতিরোধ করেই তিনি সবার জন্য কল্যাণকামী একটি রাষ্ট্র তৈরিতে মনোযোগী ছিলেন। তাঁর অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের যে তিনটি নীতি আজও আমাদের জন্য সুফল বয়ে আনছে সেগুলো হলো : ১. সামাজিক সচেতনতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়িয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দ্রুত কমিয়ে আনা; ২. গবেষণা ও উন্নয়নে সমর্থন দিয়ে কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের চেষ্টা নিরন্তর চালিয়ে যাওয়া এবং ৩. সরকারি অর্থে দেশের প্রতিটি কোণে প্রাথমিক শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে দেওয়া। গণমুখী জনপ্রশাসন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন, ইউজিসি গঠন, কৃষি গ্র্যাজুয়েটদের ক্যাডার সার্ভিসে যুক্ত করে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার মর্যাদা দেওয়া, বারি, বিরি ও বার্কের মতো কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরি করাসহ সুদূরপ্রসারী কত নীতিই না গ্রহণ করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন দুর্নীতিমুক্ত সাধারণের কল্যাণমুখী সমাজ ও প্রশাসন গড়ার এক স্বপ্নচারী রাষ্ট্রনায়ক। তাই পুরনো সমাজের খোলনলচে বদলে সাম্যভিত্তিক নয়া সমাজ গড়ার সুদৃঢ় উদ্যোগ নিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিপ্লব শুরু করার মাধ্যমে। কায়েমি স্বার্থান্বেষী মহল এই মানবমুক্তির কাণ্ডারিকে তাঁর স্বপ্ন পূরণের সুযোগ দেয়নি। মাত্র সাড়ে তিন বছর দেশ পরিচালনার পরপরই হঠাৎ তাঁকে তাঁর প্রিয় স্বদেশবাসীর কাছ থেকে শারীরিকভাবে বিচ্ছিন্ন হতে হয়েছিল ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টে। তবে তিনি ছিলেন এবং এখনো আছেন এ দেশের সাধারণ মানুষের নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে। মাত্র সাড়ে তিন বছরে তিনি ৯৩ ডলার মাথাপিছু আয়ের দেশকে ২৭৩ ডলারের মাথাপিছু আয়ের দেশে পরিণত করেছিলেন। আর নেতৃত্বের যে কী গুণ তা আমরা দেখতে পাই ঠিক পরের বছরই, সেই মাথাপিছু আয় কমে যায় ১৩৮ ডলারে। তার পরের বছরে ১২৮ ডলার। দীর্ঘ ১৩ বছর লেগেছিল বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশকে পঁচাত্তরের সমান মাথাপিছু আয় অর্জন করতে। ১৯৮৮ সালে তা ২৭১ ডলার হতে পেরেছিল।

পথহারা সেই বাংলাদেশকে সঠিক পথ খুঁজে পেতে আরো দীর্ঘ সময় লেগেছিল। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা অনেক সংগ্রাম শেষে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পান। সামাজিক নিরাপত্তা, কৃষি, শিল্প এবং নারীর শিক্ষা ও ক্ষমতায়নে মনোযোগী হওয়ার কারণে তাঁর সরকার ১৯৯৮ সালের বিরাট বন্যা মোকাবেলা করেই এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু ফের ছন্দঃপতন ঘটে ২০০১ সালে। দীর্ঘ আট বছর অনেক আন্দোলন, কারাবাস, সংগ্রাম শেষে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগান নিয়ে তিনি ফের ক্ষমতায় ফিরে আসেন ২০০৯ সালে। উদারীকরণ নীতি বজায় রেখে ব্যক্তি খাতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিলেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দক্ষতা বৃদ্ধিসহ মানব উন্নয়নে রাষ্ট্রকে পুরোপুরি মনোযোগী করে রেখেছেন। ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসার, তরুণ উদ্যোক্তাদের সমর্থন ও উগ্র ধর্মীয় মতবাদীদের নিয়ন্ত্রণে রেখে সামাজিক শান্তি বজায় রেখে তিনি জোর কদমে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশকে। গত ১২ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তাই এসেছে আশাতীত অগ্রগতি। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের বিস্ময়কর রূপান্তর অস্বীকার করার উপায় নেই। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে প্রবৃদ্ধির ৭৩ শতাংশই হয়েছে গত এক যুগে। ১৯৭৫-এর পরে রেমিট্যান্স বেড়েছে ২৮৫ গুণ এবং রপ্তানি বেড়েছে ১৩৩ গুণ। গত এক যুগে মাথাপিছু আয় সাড়ে তিন গুণ বেড়েছে। এক দশকে রিজার্ভ বেড়েছে প্রায় সাত গুণ (৪৪ বিলিয়ন ডলার)। উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি এসেছে অনিবার্যভাবেই। পদ্মা সেতুসহ মেগাপ্রকল্পগুলো দৃশ্যমান। যেসবের ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য নিরসনে। অর্থনৈতিক শক্তি যথেষ্ট রয়েছে বলেই জিডিপির ৪.৪ শতাংশের সমান স্টিমুলাস ঘোষণা ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে, যদিও সামাজিক নিরাপত্তা বাবদ ১০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার অর্ধেক এখনো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। দারিদ্র্য ও অতিদারিদ্র্য দ্রুত কমিয়ে আনা গেছে। মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা গেছে (৫-৬ শতাংশ)। পাঁচ দশকে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ। গ্রামীণ আয়ের ৬০ শতাংশ আসছে অকৃষি খাত থেকে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মানোন্নয়ন হচ্ছে। আরো যে ইতিবাচক পরিবর্তন আসন্ন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সামষ্টিক অর্থনৈতিক সাফল্যের প্রভাব পড়েছে সামাজিক সূচকগুলোতেও। দম্পতিপ্রতি সন্তানসংখ্যা নেমে এসেছে ২.১-এ। গড় আয়ু ২০০৫ সালে ৬৫ বছর থেকে বেড়ে এখন হয়েছে ৭৩ বছর (দক্ষিণ এশিয়ার গড় ৬৮ বছর)। এই ইতিবাচক রূপান্তরের পেছনে অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে ডিজিটাইজেশন। ই-কমার্সের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ই-কমার্সের বাজারের আকার বিশাল (২০০ বিলিয়ন টাকা)। সরকারি সেবার ডিজিটাইজেশনের ফলে বিকেন্দ্রায়ন ও জনগণকে দেওয়া সেবার মান বেড়েছে। আর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে পথ দেখাচ্ছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। পরিকল্পনার মোট ব্যয় ৬৫ ট্রিলিয়ন টাকা (যার বড় অংশটিই আসবে নিজস্ব উৎস থেকে)। ১১.৩ মিলিয়ন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা আরো চাঙ্গা হবে। ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে জীবনমানের উন্নতি হবে। প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের ৮১ শতাংশ আসবে ব্যক্তি খাত থেকে। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নয়নে নীতি-মনোযোগ অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তায় মনোযোগ বাড়াতে হবে (এ জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে)। কৃষির আধুনিকীকরণ এবং বহুমুখীকরণে বিনিয়োগ ও নীতি-মনোযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। আরএমজি খাতের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি আইসিটি খাতকে প্রবৃদ্ধির নতুন ইঞ্জিন হিসেবে দাঁড় করাতে হবে। স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক ভ্যালু চেইনগুলোতে দেশের অর্থনীতিকে আরো গভীরভাবে যুক্ত করতে হবে। অবকাঠামো উন্নয়নে যে নীতি-অগ্রাধিকার রয়েছে, তা অব্যাহত রাখতে হবে এবং সম্ভব হলে বাড়াতে হবে।

আমাদের সামনে অমিত সম্ভাবনা রয়েছে—এ বিষয়ে সন্দেহ করার অবকাশ নেই। একই সঙ্গে আগামীর চ্যালেঞ্জগুলোর বিষয়েও আমাদের সচেতন থাকতে হবে এবং সেগুলোর বিষয়ে সংবেদনশীল থেকে কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, টেকসই উন্নয়নের জন্য যে বিপুল সম্পদের প্রয়োজন হবে তার জন্য বহিঃস্থ উৎসর ওপর খুব বেশি নির্ভর করা যাবে না। দীর্ঘমেয়াদি পুঁজির জন্য কর আহরণ এবং প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাজারই হবে আমাদের ভরসার জায়গা। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে কর আহরণের দক্ষতা বাড়ানোকে দিতে হবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। আর পুঁজিবাজারেও প্রয়োজনীয় সংস্কারের পাশাপাশি বন্ড মার্কেটকে প্রকৃত অর্থেই সক্রিয় করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনে তাই পুঁজিবাজারের তথ্য প্রকাশের উত্তম চর্চার বিকল্প নেই। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে পুঁজি বাজারকে কাজে লাগাতে উদ্ভাবনী বন্ড সেবা চালু করতে হবে। এতে বিশেষভাবে আগ্রহী হবেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। বিদ্যমান বিশ্ব অর্থনৈতিক বাস্তবতার বিচারে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া সবুজ (অর্থাৎ পরিবেশবান্ধব) রাখাকে নীতি-বিবেচনার একেবারে কেন্দ্রীয় জায়গায় রাখতে হবে।

সব কিছুই থেমে যায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়। তীব্র সমন্বয়হীনতায় সম্পদ পড়ে আছে, ব্যবহার নেই। ব্যবহৃত হলেও অপচয়ের শেষ নেই। তাই বাস্তবায়নের ধারাকে গণমানের রাখতে সর্বক্ষণ মনিটর করে যেতে হবে। বিশেষ করে মেগাপ্রকল্পগুলো সময়মতো বাস্তবায়ন করাটা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। কেননা এসবই বাড়তি প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান দেবে। এসবই গেমচেঞ্জার হতে পারে বাংলাদেশের জন্য। সর্বোপরি সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী মহলের আপসহীন অবস্থানকে প্রতিফলিত করতে হবে একেবারে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত। পাশাপাশি সামাজিক শান্তি ও ন্যায়বিচার বজায় রেখে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ধারাবাহিকতা ধরে রাখা গেলে বহুবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব বলে বিশ্বাস করি।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

শেয়ার করুন !!Share on FacebookTweet about this on TwitterShare on Google+Share on LinkedInShare on RedditBuffer this pageDigg thisShare on TumblrPin on PinterestShare on StumbleUponFlattr the authorEmail this to someone