সবাই মিলে করোনা ঠেকাই
আজ ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। আজকের এই দিনে যখন আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালন করে মানুষকে নতুন কোনো বিষয়ে স্বাস্থ্যসচেতন করব, তখন আমাদের সব বালুকাবেলা করোনা ঢেউয়ে নিমজ্জিত। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহান শহর থেকে নতুন করোনাভাইরাস আজ পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো বিশ্ব। সংক্রমিত করেছে কোটি কোটি মানুষকে। কেড়ে নিয়েছে লাখ লাখ প্রাণ। ধস নামিয়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। বিপন্ন করে তুলেছে জনজীবন। হুমকির মুখে জীবিকা। সব মিলিয়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ভবিষ্যৎ। নতুন ভাবনা দূরের কথা, করোনা ব্যতিব্যস্ত রেখেছে আমাদের জীবনের সব ক্ষেত্র।
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার এক বছর পরে ১৯৪৬ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রূপরেখা তৈরির জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন কমিশন গঠন করা হয়। অন্তর্বর্তীকালীন এই কমিশনের মতামতের আলোকে ১৯৪৮ সালের ৭ এপ্রিল গঠন করা হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও)। মানুষের সুস্থতা নিশ্চিত করা এবং জীবন রক্ষার শপথে পরিচালিত হতে থাকে সংস্থাটি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রথম সম্মেলনটি হয়েছিল প্রতিষ্ঠার দুই মাসের মাথায়, ১৯৪৮ সালের ২৪ জুন। নির্ধারিত দিনে জেনেভায় সংস্থাটির প্রথম সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ৪৬টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা। বিভিন্ন রাষ্ট্রের উপস্থিত প্রতিনিধিদের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালনের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা হয়। সেই সম্মেলন থেকেই সিদ্ধান্ত হয় বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসচেতনতা তৈরিতে ১৯৫০ সালের ৭ এপ্রিল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালন করা হবে। সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাদিনের সঙ্গে মিল রেখেই ৭ এপ্রিল নির্ধারণ করা হয়।
প্রতিবছর সংস্থাটি পৃথিবীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি স্বাস্থ্য ইস্যু বেছে নেয়, যার মাধ্যমে সেদিন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হয় দিবসটি। ১৯৫০ সালের প্রথম স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘নো ইওর হেলথ সার্ভিসেস’ অর্থাৎ ‘নিজের স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতন হোন’। এভাবে এখন পর্যন্ত ৭ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে।
সেই ১৯৫০ সাল থেকেই সারা বিশ্বের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বার্তা নিয়ে প্রতিবছর পালিত হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস।
বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস ২০২১-এর প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘Building a fairer, healthier World’। বাংলায় বলা যায়, ‘সুন্দর, সুস্থ পৃথিবী গড়ে তুলি’। এবারের প্রতিপাদ্য যথাযথ হয়েছে। কারণ ১৪ মাস ধরে পুরো পৃথিবী অসুস্থ জীবন যাপন করছে। এই পৃথিবীকে সুন্দর ও সুস্থ করে তোলা আমাদের প্রতিজন বিশ্ববাসীর দায়িত্ব। ১৪ মাস ধরেই চলছে নানা গবেষণা, চিকিৎসার উদ্ভাবন, টিকার উদ্ভাবন, স্বাস্থ্যবিধি প্রণয়ন—হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। সব দেশের সরকার মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষার জন্য নিরন্তর লড়াই করে চলেছে। এ রকম মহামারি/অতিমারি বিশ্ববাসী এর আগে কখনো দেখেনি।
করোনা নিয়ন্ত্রণে পুরো বিশ্ব হিমশিম খাচ্ছে। বিশ্বে প্রথম সফলতা দেখিয়েছিল চীন। ১২টি কঠিন শর্ত আরোপ করে তারা মাত্র তিন মাসে নিয়ন্ত্রণে এনেছিল। মার্চ ২০২০-এর শেষে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃতে একটি আন্তর্জাতিক কমিটি চীন সফর করে মন্তব্য করেছিল, চীন যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে সেটি আর কোনো দেশ পারবে না, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও না। করোনাভাইরাস সংক্রমণ আবার বাড়ছে চীনে। দেশটিতে গত রবিবার এক দিনে ৩২ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। গত দুই মাসে দৈনিক সংক্রমণ শনাক্তের হিসাবে এটি সর্বোচ্চ সংখ্যা। সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে করোনাভাইরাসের রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে ভারতে। দেশটিতে এক দিনে এক লাখের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে গত রবিবার, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। আর যুক্তরাষ্ট্রের পর এই প্রথম কোনো দেশে এক লাখের বেশি রোগী এক দিনে শনাক্ত হলো। করোনাভাইরাস সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় ফ্রান্সে তৃতীয় দফায় লকডাউন দেওয়া হয়েছে। গত শনিবার থেকে শুরু হয়েছে দেশজুড়ে লকডাউন। একই সঙ্গে সকাল-সন্ধ্যা কারফিউও দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলছে করোনা নিয়ন্ত্রণের নানা পদক্ষেপ, তবু বেড়েই চলেছে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার।
বাংলাদেশে গত রবিবার ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্ত হয়েছে সাত হাজার ৮৭ জনের, যা দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকে এক দিনে সর্বোচ্চ। ২৪ ঘণ্টায় করোনা সংক্রমণে মারা গেছে ৫৩ জন। এ নিয়ে টানা ছয় দিন ধরে ৫০ জনের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। ২৪ ঘণ্টায় (গত শনিবার সকাল ৮টা থেকে রবিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) ৩০ হাজার ৭২৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে, যা এক দিনে সর্বোচ্চ নমুনা পরীক্ষার রেকর্ড। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় রোগী শনাক্তের হার ২৩.০৭ শতাংশ।
৫ এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত দেশে মোট ছয় লাখ ৩৭ হাজার ৩৬৪ জনের করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে ৯ হাজার ২৬৬ জন। বিশ্বে ১৩ কোটি ১৯ লাখ ৩৩ হাজার ২৫৫ জন শনাক্ত হয়েছে, মৃত্যুবরণ করেছে ২৮ লাখ ৬৬ হাজার ৪১১ জন।
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশে গত সোমবার সকাল ৬টা থেকে এক সপ্তাহের জন্য শুরু হয়েছে লকডাউন।
এ সময়ে আমাদের সবার তিনটি দায়িত্ব : ১. সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ; ২. জীবন রক্ষা করা; ৩. মানুষের ন্যূনতম চাহিদা, যেমন—খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। পুরো বিশ্বের জন্যই করোনাভাইরাস একটি নতুন অভিজ্ঞতা ছিল। গত ১৪ মাসে অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরলেও বাস্তবতা অনেক দূরে। বেশ কিছু নতুন ভেরিয়েন্ট এসে সংক্রমণের হার বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। করোনার চিকিৎসা, টিকা—সবই জরুরি ভিত্তিতে (BDG-EUA) ব্যবহার করা হচ্ছে। গবেষণায় এখন পর্যন্ত করোনার কোনো বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
গত ১৪ মাসে আমরা যে অভিজ্ঞতা পেলাম তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য—১. স্বাস্থ্যবিধি যথাযথ অনুসরণই হচ্ছে সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ। ২. একই ব্যক্তি একাধিকবার সংক্রমিত হচ্ছে। ৩. টিকা নেওয়ার ১৪ দিন পরও আক্রান্ত হচ্ছে। ৪. শুধু স্বাস্থ্যবিধি মেনে লকডাউন ছাড়াই করোনা নিয়ন্ত্রণ করেছে অনেক দেশ; যেমন—হংকং। ৫. যেসব দেশ যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেছে, তারাই ভালো আছে।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও করোনা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ অন্য অনেক দেশের তুলনায় অনেক ভালো ছিল। সম্প্রতি অবস্থা পাল্টে যাচ্ছে। শেখ হাসিনা সরকার করোনা পরিস্থিতিতে সময়োচিত সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দিয়েছে, চিকিৎসার সুযোগ বাড়িয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সংক্রমণ যে হারে বাড়ছে, তাতে হাসপাতালের সুযোগ যতই বাড়ানো হোক না কেন, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা কঠিন হবে। তাই আমাদের প্রধান কাজ সংক্রমণকে বাধাগ্রস্ত করা। এর জন্য প্রয়োজন জনসম্পৃক্তি। সরকারের পক্ষ থেকে যথাসময়ে সব উদ্যোগ ও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এখন আমাদের সবাইকে ধৈর্যসহকারে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে সম্মিলিতভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে।
আজ বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। আমাদের প্রতিজ্ঞা গ্রহণের দিন। আমরা নিজেদের স্বার্থে সম্মিলিতভাবে করোনাভাইরাসকে প্রতিহত করব, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলব এবং অন্যকে মানতে বলব। ঘরের বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক পরব। শারীরিক দূরত্ব মেনে চলব। প্রয়োজনে বারবার সাবান-পানি দিয়ে হাত পরিষ্কার করব। ভিড় এড়িয়ে চলব। এই চারটি বিধি মেনে চললেই করোনা সংক্রমণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসবে।
আমরা সবাই মিলে প্রয়াস নিলে আমাদের প্রিয় দেশ অবশ্যই দ্রুত করোনামুক্ত হবে।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়