বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক নির্বাচনী : ফখরুল
প্রধান প্রতিবেদক : বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক নির্বাচনী। এটা নিয়ে অপপ্রচার করার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ‘কোনো একটা ঘটনা ঘটলেই আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা সমানে বলতে থাকেন বিএনপি-জামায়াত, বিএনপি-জামায়াত। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কটা কিন্তু ইলেক্টোরাল অ্যালায়েন্স। নির্বাচনী অ্যালায়েন্স ছিল জামায়াতের সঙ্গে। আগামী নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে জোট হবে কি হবে না, সেটাও কিন্তু এবার আমাদের জোটের ঘোষণাপত্রে বলি নাই।’
দৈনিক কালের কণ্ঠের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ফখরুল এসব কথা বলেন।
সাক্ষাৎকারে ফখরুল বলেন, “২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন হয়েছে, পরের বছরের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে। টু থার্ড মেজরিটি পাওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রচলিত যে ব্যবস্থা ছিল, তা বিনষ্ট করার কাজ শুরু করেছে। এখানে যে ব্যবস্থা ছিল, সেটি হলো একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যারা জয়ী হবে তারা সরকার গঠন করবে, সেই ব্যবস্থাকে তারা পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়েছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনের মাধ্যমে। সংবিধানে এই মৌলিক পরিবর্তনের ফলে তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনটাকে নিয়ে এলো। সংবিধানের এই পরিবর্তন বাংলাদেশের পলিটিকসকে ইমব্যালান্স (ভারসাম্যহীন) করে দিল। রাজনীতির ভারসাম্য নষ্ট হলো, স্থিতিশীলতা নষ্ট হলো। এর ফলেই গোটা বাংলাদেশে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। একটা নির্বাচন হবে, সেখানে সবাই অংশগ্রহণ করবে, সেখানে যারা জয়ী হবে তারাই সরকার গঠন করবে- এই ধারণা কিন্তু পাল্টে গেল। আওয়ামী লীগ এটাকে পারসু করার জন্য দমন নিপীড়নের রাস্তা বেছে নিল। ইলিয়াসসহ অনেককে গুম করা হলো, অনেকে মারা গেল। মামলা হলো। আমাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করা হলো। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ রকম দমন-নিপীড়ন অতীতে সেভাবে ছিল না। অনিশ্চয়তা শুরু হলো। মানুষ বুঝতে পারছিল না আসলে দেশের সরকার কিভাবে পরিবর্তন হবে।”
এক প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, “জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগ জোর করে নির্বাচনে নিয়েছে। নির্বাচনটা করার জন্য আওয়ামী লীগ যে পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছে তা আনএথিক্যাল। এরশাদ সাহেবকে তারা ধরে নিয়ে গিয়ে সিএমএইচের মধ্যে দিল। জাতীয় পার্টিকে সর্বদলীয় সরকারের মধ্যে নিয়ে আসা হলো। সিপিবি (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি)-বাসদ (বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল) বলেছিল তারা নির্বাচনে যাবে না। তারা কিন্তু যায়নি। গণফোরাম বলেছে তারা নির্বাচনে যাবে না। অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল বলে দিয়েছে নির্বাচনে তারা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ এভাবে গণতন্ত্রের চেতনাটা নষ্ট করে দিল।”
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের কথা বলে, গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করেছে কিন্তু এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক চেতনা নষ্ট করার কারণে গণতন্ত্র ধ্বংস হলো। ফলে আমরা যখন আন্দোলন করেছি সেই আন্দোলনের পর দেখা গেল তারা বিভিন্নভাবে ছলচাতুরি শুরু করল। এবারের এই নির্বাচনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক নির্বাচন। ১৫৩টি আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগ জয়ী হলো, যা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ সেটাই ভেঙে গেল। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি মানুষকে ভোট দেওয়া থেকে বঞ্চিত করল আওয়ামী লীগ। আর বাকি ১৪৭ আসনে যে নির্বাচন তারা করল, সেই নির্বাচনটি দেশের সব মানুষই দেখেছে। আসলে সেখানেও কোনো নির্বাচন হয়নি। সেখানে ৫ শতাংশ মানুষও ভোট দিতে যায়নি। এমনকি সুরক্ষিত ঢাকা শহরে ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছেন। ফলে এ নির্বাচনটি মানুষের কাছে যেমন গ্রহণযোগ্য হয়নি, তেমনি এ নির্বাচন কেউ মেনে নেয়নি। বিভিন্ন টেলিভিশন ও পত্রিকায় যেসব জরিপ এসেছে, সেখানেও মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নির্দলীয় সরকারের পক্ষে মত দিয়েছেন। অথচ সরকার গণদাবি উপেক্ষা করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করল। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ বলেছিল, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য নির্বাচন হচ্ছে। এরপর তারা আরেকটি নির্বাচন করবে যেটা সঠিকভাবে হবে।”
ফখরুল বলেন, “আওয়ামী লীগ নির্বাচনের আগে বলেছিল এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচন হচ্ছে। এখন তাদের সুর পাল্টে গেছে। এখন তারা বলছে পাঁচ বছরের আগে তারা ক্ষমতা ছাড়বে না।”
উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী নির্বাচন প্রসঙ্গে ফখরুল বলেন, “সবার আগে একটা কথা বলে রাখি, ঢাকা বা কেন্দ্র থেকে কোনো প্রার্থী দেয়া হয়নি। স্থানীয়ভাবেই তারা প্রার্থী ঠিক করেছে। যেখানে দুই বা তিনজন প্রার্থী হয়ে গেছেন সেই জায়গা আমাদের বিভাগীয় কমিটি রয়েছে তারা সহযোগিতা করছে। আমরা তো দলীয়ভাবে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছি না। আমরা একটা মনিটরিং করেছি।”
বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ট্রাইব্যুনালের ভবিষ্যৎ কী হবে এমন প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, “এ বিষয়টি নিয়ে আমরা বহুবার বলেছি। বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ পরিকল্পিত অপপ্রচার করছে তাদের স্বার্থে। এই অপপ্রচার হলো বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় না বা তারা এই ইস্যুতে জামায়াতের সঙ্গে কাজ করছে। এটা টোটালি ফলস অ্যান্ড লাই। এটা ঢাহা মিথ্যা কথা। আমরা সব সময় বলে এসেছি যে আমরা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চাই; কিন্তু সেই বিচার হতে হবে সম্পূর্ণভাবে স্বচ্ছ, আন্তর্জাতিক মানের এবং কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছাড়া। আজকে যেকোনো একটা ঘটনা ঘটলে আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা সমানে বলতে থাকেন বিএনপি-জামায়াত, বিএনপি-জামায়াত। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কটা কিন্তু ইলেকটোরাল এলায়েন্স। আগামী নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে জোট হবে কী হবে না সেটাও কিন্তু এবার আমাদের ১৮ দলীয় জোটের ঘোষণাপত্রে বলিনি। আমাদের জোটের ঘোষণাপত্র পুরোপুরিভাবে আন্দোলনের একটা ঘোষণাপত্র। এ বিষয়গুলো কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিষয়ে অপপ্রচার করার সুযোগ নেই।”
ভারত প্রসঙ্গে ফখরুল বলেন, “ভারত আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী। আমরা মনে করি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক থাকা উচিত। কিন্তু সেই সুসম্পর্ক হতে হবে সমতার ভিত্তিতে। যেমন এখন পর্যন্ত আমরা তিস্তা নদীর পানির হিস্যা পাইনি। আমাদের ৫৮টি নদী আছে, যার উজানে ভারত বাঁধ দিয়েছে। এ কারণে আমাদের দেশের নদ-নদীর পানির প্রবাহ আমরা ঠিকমতো পাই না। এ ছাড়া সীমান্তে হত্যা আজও বন্ধ করা যায়নি। ভারতের সঙ্গে আমরা সুসম্পর্ক বাড়াতে চাই। কিন্তু সেই সম্পর্ক হবে সমতার ভিত্তিতে। আত্মমর্যাদার সঙ্গে। ভারতকে এগিয়ে আসতে হবে। যে সমস্যাগুলো রয়েছে সেগুলোর সমাধান করতে হবে।”
তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়টি কতদূর-এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, “তারেক রহমান কিন্তু তার নিজের যোগ্যতাবলে বিএনপির নেতৃত্বে এসেছেন। তিনি যে আজকে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছেন সেটা তিনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান-খালেদা জিয়া দম্পতির ছেলে হিসেবে নন, দলে তার যে কন্টিবিউশন, দলের জন্য তিনি যে কাজগুলো করেছেন তারই কারণে দল তাকে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান করেছে। এক-এগারোতে তাঁর ওপর যে নির্মম নির্যাতন নেমে এসেছিল তারও অন্যতম কারণ কিন্তু সেটা। তারেক রহমান তৃণমূল পর্যায়ে যে কাজগুলো শুরু করেছিলেন তাতে বিএনপির ভিত শক্ত হচ্ছিল। তার যে ডায়নামিজম, তার যে মেধা ও প্রতিভা তা যাতে পুরোপুরি কাজে না লাগে সে জন্য তাঁর ওপর নির্মম নির্যাতন নেমে এসেছিল। তাকে আসলে মেরে ফেলার পরিকল্পনা ছিল। সত্য কথা বলতে কি, যে রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের স্বার্থে কথা বলে সেই বিএনপি যাতে রাজনৈতিক দল হিসেবে দাঁড়াতে না পারে, সে লক্ষ্যে বিএনপিকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য একটি নীলনকশা করা হয়েছিল। তখনকার ইলেকশন কমিশনের দিকে তাকান। তারা কিভাবে বিএনপিকে ভাঙতে চেয়েছিল। তখন সেটা তারা করতে পারেনি। কারণ বিএনপি মানুষের দল।”