বেওয়ারিশ কুকুরকে ‘ঠাঁই’ দেবে ডিএনসিসি
রাত সাড়ে ১১টা। অফিস থেকে নিজের মোটরসাইকেলে করে কল্যাণপুরের বাসায় ফিরছিলেন আবীর রহমান। আগারগাঁওয়ের নির্বাচন কমিশন ভবন পার হওয়ার সময় হঠাৎ তাঁর পিছু নেয় কয়েকটি বেওয়ারিশ কুকুর। তিনি মোটরসাইকেলের গতি বাড়ালে কুকুরগুলো আরো আগ্রাসী হয়ে ওঠে। শেষমেশ কুকুরের কামড় খেতে না হলেও আতঙ্ক কাটেনি আবীরের।
গত বুধবারের এমন ঘটনার মুখে আগেও তাঁকে পড়তে হয়েছে বলে জানালেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এই কর্মকর্তা। গতকাল শুক্রবার তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, অফিস থেকে ফিরতে প্রায় প্রতিদিনই রাত ১১টা থেকে সাড়ে ১১টা বেজে যায়। ইদানীং যখনই এই পথে (আগারগাঁও) দিয়ে অফিস থেকে ফেরেন, কুকুর তাড়া করে। তিনি বলেন, ‘ভয় লাগে, কোন দিন কামড়ে দেয়। এই কুকুরগুলো রাস্তার, এদের তো টিকাও দেওয়া নাই।’
আগারগাঁও ছাড়াও রাজধানীর বেশ কিছু এলাকায় বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা বেড়েছে বলে জানাচ্ছে এলাকাবাসী। তাদের অভিযোগ, কুকুরগুলো কখনো কখনো আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে। মানুষকে তাড়া করছে। ফলে জনমনে ভীতি তৈরি হচ্ছে।
যদিও পশুপ্রেমীরা বলছে, খাবার না পাওয়ায় মাঝেমধ্যে এসব কুকুর আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। তবে এ কারণে কুকুর অপসারণ বা স্থানান্তর না করে বরং প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে প্রাণীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে সবার আগে কুকুরের টিকাদান নিশ্চিত করতে হবে বলে মত দেয় তারা।
এ পটভূমিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) বেওয়ারিশ কুকুরকে টিকাদান, বন্ধ্যাকরণসহ পাঁচটি কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। ‘কুকুর ব্যবস্থাপনা ২০২১’ নামের প্রকল্পের আওতায় রাজধানীর মালিকবিহীন কুকুরের নতুন করে শুমারিও করা হবে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত তিন দফা বৈঠকের পর প্রকল্পটি চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে ডিএনসিসি সূত্র জানিয়েছে। দুই বছরব্যাপী প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে তিন কোটি টাকা।
সূত্র মতে, এই প্রকল্পের আওতায় বেওয়ারিশ কুকুর রক্ষায় অভয়ারণ্য এবং ক্লিনিক করা হবে। এ জন্য এরই মধ্যে এক বিঘা জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এই প্রকল্পের আওতায় ডিএনসিসিতে দক্ষ জনবল নিয়োগ এবং তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হবে। আর যাদের কুকুর আছে তাদের ১০০ টাকার বিনিময়ে লাইসেন্স দেওয়া হবে।
গত কয়েক দিন রাজধানীর বারিধারা, ভাটারা, উত্তর ইব্রাহিমপুর, ভাষানটেক, মোহাম্মদপুর, আগারগাঁও ও কল্যাণপুরের বেশ কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা জানান, তাঁদের এলাকায় বেওয়ারিশ কুকুর বেড়েছে। কুকুরের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় খাবারেরও অভাব দেখা দিচ্ছে। ফলে পথচারী কিংবা সাইকেল-মোটরসাইকেল ও রিকশায় মানুষ দেখলেই আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে দৌড়ে যাচ্ছে তাদের কাছে। সাইকেল নিয়ে বেরোনো শিশুদের দিকেও তেড়ে যাওয়ার কথা জানালেন কয়েকজন। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন অভিভাবকরা। উত্তর ইব্রাহিমপুরের মুন্সিবাড়ী সড়কের বাসিন্দা শরীফুল আলম বলেন, ‘এলাকায় কুকুর অনেক বেড়েছে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলেই কুকুর ডাকতে ডাকতে তেড়ে আসে। আমার বাচ্চাটা সাইকেল নিয়ে রাস্তায় বের হয়েছিল, ওকেও তাড়া করেছে। বাচ্চা মানুষ, ভীষণ ভয় পেয়েছে।’
তবে পশুপ্রেমীরা বলছে, মানুষ যদি তাদের বেঁচে যাওয়া, উচ্ছিষ্ট খাবার ড্রেনে না ফেলে রাস্তার কুকুরগুলোকে দিত তাহলে এমনটা হতো না। ডাস্টবিনে যা ফেলা হয় তা পরিষ্কার করে ফেলেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। ফলে কুকুরদের খাবারের অভাব দেখা দিচ্ছে। কুকুর দেখে আতঙ্কিত না হয়ে, ভয় না পেয়ে, বরং তাদের প্রতি মানবিকতা দেখানোর আহ্বান পশুপ্রেমীদের।
রাজধানীতে কুকুরসহ অন্যান্য প্রাণী উদ্ধারে ২০১০ সাল থেকে কাজ করছে রবিনহুড দি এনিমেল রেসকিউয়ার। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান আফজাল খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রাণীর ভারসাম্য রক্ষায় কুকুরকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ওরা তো আমাদের বহু উপকার করে। আমরা যদি ওদের বেঁচে যাওয়া খাবারগুলো দিই, তাহলে ওরা আর তেড়ে আসবে না।’
খাবার না পেয়েই বেওয়ারিশ কুকুরগুলো আক্রমণাত্মক হচ্ছে বলে মনে করেন ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমানও। এ জন্য তিনিও রাস্তার কুকুরকে বেঁচে যাওয়া খাবার দেওয়াসহ তাদের প্রতি ভালোবাসা দেখানোর আহ্বান জানান। এই কর্মকর্তা বলেন, ‘কুকুরের জন্য টিকা কার্যক্রম এখনো চালু আছে। নতুন করে কুকুরের জন্য আমরা এক বিঘা জায়গা বরাদ্দ দিয়েছি। সেখানে একটি কুকুরের জন্য অভয়ারণ্য এবং ক্লিনিক করা হবে।’