রাজনীতিতে সৎ থাকা অত্যন্ত কঠিন
কাজী আমিনুল হাসান, ঢাকা : রাজনীতিতে সৎ থাকা অত্যন্ত কঠিন বলে মনে করেন দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া। তবে সবকিছু উপেক্ষা করে সততা ধরে রাখতে পারা অবাস্তব নয় বলেও তার বিশ্বাস। রাজনীতিতে নেতিবাচক অর্থ প্রবাহ সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় নানা বিষয়ের সঙ্গে এ বিষয়টিও উঠে আসে তার কথায়।
নব্বইয়ের দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির যাত্রা শুরু হয়েছে। কিন্তু এ গণতন্ত্রের মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ভোট। আর এই ভোটের রাজনীতিতে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় টিকতে সব নির্বাচনে ঢালা হয় কাঁড়িকাঁড়ি টাকা। দিনে দিনে বাড়ছে নির্বাচনী ব্যয়। নির্বাচন কমিশন এই ক্যানসার প্রতিরোধ ব্যবস্থা না নিয়ে ন্যূনতম ব্যয়ের সীমা বাড়িয়ে উৎসাহ দিচ্ছে।
এ প্রসঙ্গেই রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, ‘১৯৯১ সালে একজন এমপি প্রার্থীর সর্বোচ্চ নির্বাচনী ব্যয় ছিল ৩ লাখ টাকা। আমার আড়াই লক্ষ টাকার মতো খরচ হয়েছিলো। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এলাকায় পায়ে হেঁটে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছি। সেবার আমি এমপি নির্বাচিত হয়েছিলাম। এখন একজন ২৫ লাখ টাকা নির্বাচনে ব্যয় করতে পারে। কিন্তু আসলে তার চেয়ে অনেক অনেকগুন বেশি টাকা নির্বাচনে ব্যয় করেন প্রার্থীরা। একজন রাজনীতিবিদ যিনি সৎভাবে জীবনযাপন করেন, সরকারি ট্যাক্স দিয়ে তার পক্ষে কত টাকা সঞ্চয় করা সম্ভব? কতজনের পক্ষে এই নির্বাচনী ব্যয় বহন করা সম্ভব?’
এরপর পরবর্তী নির্বাচনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘১৯৯৬ সালের নির্বাচনে টাকা এবং প্রতিপক্ষ দলের দাঙ্গা হাঙ্গামা মানসিকতায় আমি নির্বাচন ছেড়ে চলে আসি। সে সময় প্রতিপক্ষ দলের আঘাতে আমি গুরুতর আহত হয়েছিলাম।’
১৯৬২ সালে কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র ছিলেন রফিকুল ইসলাম মিয়া। আইয়ুব খানের শোষণ নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন তিনি। এজন্য তাকে কলেজ থেকে বহিস্কার করে কর্তৃপক্ষ। তখন থেকে ছাত্র রাজনীতি শুরু করে এখন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য।
রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, ‘সৎভাবে জীবনযাপন করা অত্যন্ত কঠিন হলেও তা সম্ভব। রাজনীতি করবেন টাকা কোথায় পাবেন? বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ রাজনীতি করছে। রাজনীতি করলে মন্ত্রী হবেন, এমপি হবেন, কোটি কোটি টাকার মালিক হবেন এটা এখন ফ্যাশন হয়ে গেছে। সর্বত্র রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন শুরু হয়ে গেছে। ভোটারদের একটা অংশও টাকার প্রতি আস্থা রাখছে। ভোটারদেরসহ আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।’
একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রকল্প অফিসে বসে দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট সুরাহার চেষ্টা রাজনীতিবীদদের জন্য কতটুকু ব্যর্থতা বা জনগণের জন্য লজ্জাজনক কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষের সমস্যা দেশের মানুষের সমাধান করা উচিৎ। অন্যরা করলে তা স্বাভাবিক না। তবে বর্তমান কোনো দেশই কিন্তু স্বাধীনভাবে চলতে পারে না। আমাদের বিশ্বের অন্য দেশের সাহায্য নিয়ে চলতে হয়। আমরা যেহেতু এখনো স্বাবলম্বি নই, তাদের প্রভাব রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমান পৃথিবীতো আগের মতো নেই, অন্যরা তো কথা বলতেই পারে তবে নিজের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ছেড়ে দিয়ে কথা বলা ঠিক নয়। কিন্তু আমরা নিজেরা যে আলোচনায় বসতে পারি নাই এটাতো সত্য কথা। সেজন্য কেউ উদ্যোগ নিলে তাকে পুরোপুরি ব্লেম আমি দিতে চাই না। সেক্ষেত্রে প্রথমে আমাদের নিজেদের কাজটা নিজেরাই করা উচিৎ।’
সরকারকে অবৈধ বলে আপনারা সংলাপের কথা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে কয়েকজন বলছে- সরকারের বৈধতা স্বীকার করে আলোচনায় আসুন। এ প্রসঙ্গে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এটা বৈধ অবৈধতার প্রশ্ন নয়, এটা রাজনৈতিক কৌশল। যুদ্ধ হয়, যুদ্ধের সময়ও আলোচনা হয়। আমরা হচ্ছি প্রধান বিরোধী দল। কিন্তু আমরা সংসদে নাই। এখন যে মহাসঙ্কট চলছে তা তো আলোচনা ছাড়া সমাধান সম্ভব নয়। সমাধান করতে হলে তো কথা বলতেই হবে। কথা বলা মানে তো এই নয় যে, তাকে বৈধতা দেয়া।’
জামায়াতকে নিয়ে দেশি-বিদেশি চাপ রয়েছে, বিএনপি কী তাদের সঙ্গ ত্যাগ করবে? জবাবে রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, ‘কে কীভাবে রাজনীতি করবে সেটা তাদের সিদ্ধান্ত। কারো নির্দেশনা নিয়ে আমরা রাজনীতি করি না। আমরা আমাদের মতো করে রাজনীতি করি। জামায়াত একসময় আওয়ামী লীগেরও বন্ধু ছিল। আওয়ামী লীগ জামায়াতকে নিয়ে রাজনীতি করেছে, তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে আন্দোলন করেছে।’
তিনি বলেন, ‘জামায়াতকে নিয়ে তারা এতো কথা বলছেন, জামায়াতকে যদি তারা রাজনীতি করতে দিতে না চায়, তাহলে সংসদে তো তাদের অ্যাবসলিউট মেজরিটি আছে, তারা কেন জামায়াতের বিরুদ্ধে কেন কোনো অ্যাকশন নিচ্ছে না। আমি বলছি না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। কিন্তু এর দায়িত্ব তো সরকারের। যতক্ষণ জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হচ্ছে না, ততক্ষণ জামায়াত কাকে নিয়ে রাজনীতি করবে বা কারা জামাতের সাথে রাজানীতি করবে এটাতে তাদের বিষয়।’
আপনারা খুব তাড়াতাড়ি নির্বাচন চাইছেন, অথচ সরকার বলছে তারা পাঁচ বছরই ক্ষমতায় থাকবে, এ পরিস্থিতিতে আপনাদের করণীয় কী ঠিক করছেন? রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচনের আগে তারা বলেছিল- এটা একটা নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, অল্পসময়ের মধ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে আরেকটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। এখন তারাই আবার বলছেন, পাঁচ বছরই ক্ষমতায় থাকবেন। এ অবস্থায় আমরা আন্দোলনের দিকে জোর দিচ্ছি। দলীয় ফোরাম ও ১৯ দলের সাথে আলোচনা করে আন্দোলন কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হবে।’
তবে বিএনপির পুনর্গঠন এবং আগামী আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে তেমন কিছু জানাতে পারেননি দলের নীতি নির্ধারণী ফোরামের এই সদস্য। বেশ কয়েকদিন ধরে বহিষ্কার এবং বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হচ্ছে দলের মধ্যে, এটা দলের সাংগঠনিক ঐক্যে কোনো প্রভাব পড়বে কি না- সে প্রসঙ্গে রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, ‘দল পুনর্গঠন হচ্ছে, এটা চলবে।’
বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচি পালনে ব্যর্থতার কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা মহানগর কমিটিতে আপনাকে নিয়ে আলোচনা রয়েছে। এ বিষয়টি তিনি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘এটা আমার বিষয় না। নগরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে কমিটি গঠন করতে হবে।’