বাংলাদেশে প্রথম ট্যুরিজম ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল|Sunday, December 22, 2024
সাইটে আপনার অবস্থানঃ Home » জাতীয় » ইউরোপে মানবপাচারে ১৮ চক্র সক্রিয়

ইউরোপে মানবপাচারে ১৮ চক্র সক্রিয় 

1124177687988

বাংলাদেশিদের ইউরোপে পাচারের প্রধান রুট ভূমধ্যসাগরের লিবিয়া-তিউনিশিয়া চ্যানেল। লিবিয়ায় কর্মী পাঠানো বন্ধ থাকায় পাচারকারী সিন্ডিকেট ভ্রমণ ভিসায় বিদেশগামীদের ভারত, নেপাল, দুবাই, মিসর ও জর্দান ঘুরিয়ে সে দেশে নেয়। সেখান থেকে নৌপথে তিউনিশিয়া হয়ে ইতালি ও মাল্টায় পাচার করা হয়।

kalerkanthokalerkantho

এই রুটে মানবপাচারের সঙ্গে ১৫ জেলার অন্তত ১৮টি সিন্ডিকেট জড়িত। লিবিয়ায় ফার্ম হাউসকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্রে রয়েছে কিছু বাংলাদেশি ‘সর্দার’। ইতালি ও ফ্রান্সে বসে কয়েকজন সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে। গত বছরের ২৭ মে লিবিয়ার মিজদায় ২৬ জনকে গুলি করে হত্যার ২৫টি মামলার তদন্তে এমনই তথ্য পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, মানবপাচারের মামলায় দেশের দালাল ও সহযোগীদের গ্রেপ্তার করা গেলেও লিবিয়া, দুবাই ও ইতালিতে থাকা হোতাদের গ্রেপ্তার করা যায়নি। আন্তর্দেশীয় তদন্ত না হওয়ায় লিবিয়াির ফার্ম হাউসে সক্রিয় পাচারকারীদের পর্যন্ত পৌঁছায়নি তদন্ত কার্যক্রম। তবে ভুক্তভোগীদের বর্ণনায় ফার্ম হাউস এবং ইউরোপে সক্রিয়দের ব্যাপারে কিছু তথ্য পেয়েছেন তদন্তকারীরা। ছয়জনকে শনাক্ত করে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করা হলেও চারজনই এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। একজন ইতালিতে গ্রেপ্তার হলেও তাকে দেশে ফেরত আনা যাচ্ছে না।

তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশি হত্যার অভিযোগে দেশে ২৯টি মামলা হয়েছে। সেসব মামলার ২৫টি তদন্ত করে ২৩টির অভিযোগপত্র দিয়েছে সিআইডি। একটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। একটি

তদন্তাধীন। তদন্তে পাচারচক্রের ২৯৯ জনের নাম উঠে এসেছে। এর মধ্যে ১৭১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি, থানা পুলিশ ও র‌্যাব। এদের ৪২ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। বাকি ১২৮ জন অধরা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিক বলেন, মানবপাচারের ঘটনায় সাধারণত দালাল ধরা পড়ে। তাদের মাধ্যমে পাচারকারীর মূল ঘাঁটিতে পৌঁছাতে না পারলে পাচার বন্ধ হবে না।

মানবপাচারের মামলাগুলোর তদন্ত তদারক কর্মকর্তা বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ সাইদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে টাকা ফেরত পেলে অনেকে আর মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করে না। কিছু ব্যক্তি মামলা করলেও মানবপাচারকারীদের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা দেয় না। তিনি আরো বলেন, লিবিয়া থেকে তিউনিশিয়ার চ্যানেল হয়ে পাচার হচ্ছে বেশি। লিবিয়ার ফার্ম হাউসে এদের জিম্মি করে রাখা হয়। সেখানে কিছু বাংলাদেশিও আছে। লিবিয়ায় বেঁচে যাওয়া ৯ জনকে আমরা নিয়ে এসেছি। তাদের এদের বর্ণনায় ইউরোপে ও লিবিয়ায় সক্রিয় কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। দেশ থেকে যারা পাঠিয়েছে তাদের নামও এসেছে।’

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, দালালরা আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। চক্রের মূল হোতারা দেশের বাইরে বসে অনলাইন ভিসা ও বিমানের টিকিটের ব্যবস্থা করে।

যেভাবে নেওয়া হয় : তদন্তকারীরা বলছেন, ঢাকা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, নড়াইল ও বরগুনা থেকে ইউরোপে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। এসব এলাকায় সক্রিয় দেশি দালালচক্র। ২০১৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে লিবিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী পাঠানো বন্ধ। ভারত, নেপাল, দুবাই, মিসর ও জর্দান হয়ে লিবিয়ায় নেওয়া হয়। সেখান থেকে নৌপথে ইতালি ও মাল্টায় পাঠানো হয়। ২০২০ সাল থেকে চলতি বছরের মধ্যে ১৮ মাসে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) একটি হিসাবে, দুবাইয়ে ভ্রমন ভিসা নিয়ে এক লাখ ৯৯ হাজার ৮৬৪ জন নারী ও পুরুষ দেশ ছেড়েছে। তাদের মধ্যে ফেরত এসেছে মাত্র ২১ হাজার ৭৫৪ জন। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও এক লাখ ৭৮ হাজার ফেরেনি। তাদের একটি অংশকে ইউরোপে পাচার করা হয়েছে বা পাচারের চেষ্টা করা হচ্ছে বলেই ধারণা তদন্তকারীদের।

পাচারের হোতারা অধরা : লিবিয়ায় নিহত বাংলাদেশিদের দেশটিতে নিয়ে যাওয়া দালালচক্রের ছয়জনকে ধরতে গত বছরের নভেম্বরে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করা হয়। তাঁদের একজন মাদারীপুরের শাহাদাত হোসেন গত ১৩ জানুয়ারি ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার হন। তিনি লিবিয়ায় অবস্থান করছিলেন। কিশোরগঞ্জের ভৈরবের লক্ষ্মীপুরের জাফর ইকবালকে ইতালির কোসেঞ্জা থেকে সে দেশের পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাঁকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হলেও সে দেশের আইনে হস্তান্তর জটিল। তালিকায় থাকা ভৈরবের শম্ভুপুরের স্বপন এবং শিমুলকান্দির মিন্টু মিয়া সর্বশেষ লিবিয়ায় ছিলেন। তানজিরুল ওরফে তামজিদের অবস্থান ইতালিতে বলে জানায় তদন্ত সূত্র। মাদারীপুর সদরের নজরুল ইসলাম মোল্ল্যার অবস্থান জানা যায়নি।

গত বছরের ৪ জুন বনানী থানার একটি মামলায় কিশোরগঞ্জের ভৈরবের শম্ভুপুর গ্রামের হেলাল মিয়া ওরফে হেলু এবং তাতারকান্দির খবির উদ্দিন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। তাঁরা জানান, ভৈরবের তনজিমুল, স্বপন, জাফর, শাওন ও মিন্টু এলাকা থেকে যুবকদের পাচার করেছেন। লিবিয়ার বেনগাজীতে আছে এই চক্রের অন্যতম সদস্য আব্দুল্লাহ।

দুবাইয়ে অবস্থানরত আফ্রীন আহমেদ আরেকটি চক্রের হোতা। তাঁর সিন্ডিকেটে ঢাকায় সক্রিয় সুজন (গ্রেপ্তার), মামুন ও কাউসার। ফার্মগেটের মনিপুরিপাড়ায় একটি ট্রাভেলস প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁরা লোক পাঠান। তাঁরা নীল রঙের গেঞ্জি পরিয়ে দুবাই থেকে জর্ডানের রাজধানী আম্মানে পাঠান। এরপর টিয়া রঙের গেঞ্জি পরিয়ে জর্ডানের নাগরিকের হাতে তুলে দেন। সেখান থেকে সাদা-কালো গেঞ্জি পরিয়ে নেন লিবিয়ায়। লিবিয়ায় সজীব (সুজনের ছোট ভাই), মানিক ও জাফর বিদেশগামীদের সীমান্তে নেন।

ঢাকার পল্টনের স্কাইভিউ ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস এজেন্সির মালিক মাদারীপুরের শাহীন বাবু (গ্রেপ্তার), প্রোপাইটর কুষ্টিয়া সদরের হাজি কামাল (গ্রেপ্তার), খালিদ চৌধুরী, আব্দুস সাত্তার ও আলী হোসেন আরেকটি সিন্ডিকেট চালান।

মাদারীপুরের চার ভাই নুর হোসেন শেখ, আকবর হোসেন শেখ, ইমাম হোসেন শেখ, আমির শেখ ও রাশিদা বেগম, বুলু বেগম, জাহিদুল শেখ, জাকির মাতুব্বর, কুদ্দুস বয়াতী, নাসির, সজীব মিয়া, রেজাউল বয়াতী, জুলহাস সরদারসহ ২৫ জনের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে।

গোপালগঞ্জের আবদুর রব মোড়ল, মুকসুদপুরের লিয়াকত শেখ ওরফে লেকু শেখ, কাশিয়ানির দুই ভাই শেখ মাহবুবুর রহমান ও শেখ সাহিদুর রহমান গড়েছে বড় সিন্ডিকেট। মাহবুব ও সাহিদুরের ঢাকার শহীদ তাজউদ্দিন সরণিতে নাভিরা লিমিটেড এবং হাতিরঝিলে ফ্লাইওভার ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস নামে দুটি প্রতিষ্ঠান আছে।

শরীয়তপুরের রফিকুল ইসলাম ও পালং থানার সাদ্দামের নেতৃত্বে আছে স্থানীয় একটি সিন্ডিকেট। এ ছাড়া ঢাকায় কামরাঙ্গীর চরের কামাল হোসেন, ফরিদপুরের বক্স সরদার, নড়াইলে মোক্তার মোল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রফিকুল ইসলাম সেলিম ও হোসাইন, কুমিল্লার সনাতন দাশ ওরফে দাদা, শরীফ হোসেন, বরগুনায় সজল ও ইদ্রিস আলী, নোয়াখালীতে রুবেল মির্জা, নাসির উদ্দিন মির্জা ও রিপন মির্জা, কেরানীগঞ্জের আশিকের (গ্রেপ্তার) নেতৃত্বে কয়েক জেলায় এবং হেলাল মিয়া, খবির উদ্দিন ও শহিদ মিয়ার নেতৃত্বে কিশোরগঞ্জে একটি চক্র আছে।

সূত্র মতে, দুবাইয়ে অবস্থান করে লিবিয়া ও ইউরোপে মানব পাচারকারীদের মধ্যে গাজী, কাজী ও বাবুল বেশি আলোচিত। রুবেলের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বড় ভাটারায়। তাঁরা লিবিয়ায় তানজিমুল ও আবদুল্লাহর কাছে লোক পাঠান।

শেয়ার করুন !!Share on FacebookTweet about this on TwitterShare on Google+Share on LinkedInShare on RedditBuffer this pageDigg thisShare on TumblrPin on PinterestShare on StumbleUponFlattr the authorEmail this to someone