ভারতে বন্ধ হলো মুসলিম নারীদের অনলাইনে ‘নিলামে’ তোলার অ্যাপ
একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ছবি আপলোড হচ্ছে নানা বয়সী ও পেশার মুসলিম নারীদের। ঘটনাটি নজরে আসার পর দিল্লির একজন নারী গণমাধ্যমকর্মী পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেন। একই সময় একজন শিবসেনা সংসদ সদস্য মুম্বাই পুলিশের কাছে বিষয়টি তদন্তের আহ্বান জানান। সেই সঙ্গে রাজ্যের মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব এ ব্যাপারে কঠোর থেকে কঠোরতর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।
ভারতের দুটি রাজ্যের পুলিশ ওই অ্যাপের নির্মাতাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। মামলা হওয়ার পর গিটহাব কর্তৃপক্ষ এর কনটেন্ট নামিয়ে দিয়েছে।
যে ঘটনা নিয়ে এমন তোলপাড় সেটি হলো ‘বুল্লিবাই’ অ্যাপে মেয়েদের ছবি আপলোড করা। জানা গেছে, গত বছরের শুরুতে ‘সুল্লি বাই’ অ্যাপে ‘সুল্লি ডিল’ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। ‘সুল্লি’ বা ‘সুল্লা’ মুসলমানদের জন্য ব্যবহৃত একটি অবমাননাকর শব্দ। অনেকে মনে করছেন, ‘বুল্লি’ এই ‘সুল্লি’রই পরিবর্তিত রূপ। ‘বুল্লিবাই’ অ্যাপটি দেখতে ‘সুল্লি ডিল’-এর ক্লোনের মতো। সুল্লি ডিলে নারীদের ছবি সাঁটিয়ে তাতে লেখা হয়েছে- ‘ডিল অব দ্য ডে’।
গত শনিবার দিল্লি পুলিশের কাছে একজন নারী সাংবাদিক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। তিনি তাঁর অভিযোগে বলেন, মুসলিম নারীদের বিব্রত ও অপমান করার উদ্দেশ্যে একটি ওয়েবসাইটে তাঁর একটি ঈষৎ পরিবর্তিত ছবি পোস্ট করা হয়েছে। তিনি দক্ষিণ দিল্লির সিআর পার্ক থানায় অনলাইনে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। যার একটি অনুলিপি তিনি তাঁর টুইটার হ্যান্ডেলে শেয়ার করেন। তিনি সোশ্যাল মিডিয়া ও ইন্টারনেটে ‘মুসলিম নারীদের হয়রানি ও অপমান’ করার চেষ্টাকারী অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে এফআইআর ও তদন্তের দাবি জানান।
অভিযোগে বলা হয়, “আমি জানতে পেরে অবাক হই যে ‘বুল্লিবাই’ নামে একটি ওয়েবসাইট/পোর্টালে আমার একটি অনুপযুক্ত, অগ্রহণযোগ্য ছবি রয়েছে এবং সেটি টেম্পার করা। এ বিষয়ে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কারণ এটি আমাকে এবং অন্যান্য স্বাধীন নারী এবং সাংবাদিকদের হয়রানির উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। দিল্লি পুলিশ টুইটারে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলে, বিষয়টি দ্রুত বিবেচনায় নেওয়া হবে।”
শিবসেনা সংসদ সদস্য বলেন, ‘আমি তথ্য-প্রযুক্তিমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব মহোদয়কে বেশ কয়েকবার অনুরোধ করেছি, যারা সুল্লি ডিলসের মতো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নারীদের টার্গেট করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। এটা উপেক্ষা করা সত্যিই লজ্জাজনক।’
পরে মুম্বাই সাইবার পুলিশ ‘আপত্তিকর’ বিষয়টির তদন্ত শুরু করে। অ্যাপটির ডেভেলপার এবং যিনি এর টুইটার হ্যান্ডেলে ছবি ও বিষয়বস্তু শেয়ারের দায়িত্বে রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় মামলায়।
গত কয়েক মাসের মধ্যে ভারতে মুসলমান নারীদের অনলাইনে ‘নিলাম’ বা ‘বিক্রি’র মতো হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ডের এটি দ্বিতীয় ঘটনা।
বুল্লি বাই কিংবা সুল্লি ডিলস কোনো ক্ষেত্রেই, সত্যিকার অর্থে বেচাকেনা ছিল না, কিন্তু এর উদ্দেশ্য ছিল মুসলমান মহিলাদের ব্যক্তিগত ছবি শেয়ার করে তাদের হেয় করা এবং অপমান করা।
ওই অ্যাপে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক, অধিকারকর্মী, একজন পুরস্কার বিজয়ী বলিউড অভিনেতা এবং এমনকি ২০১৬ সালে নিখোঁজ হওয়া একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মায়ের নাম ও ছবি দেওয়া হয়েছিল।
যাদের ছবি আপলোড করা হয়েছে, অ্যাপে তাদের অনেকেই টুইট করেছেন যে তারা ‘মানসিক আঘাত’ পেয়েছেন এবং প্রচণ্ড ‘আতঙ্কিত’ বোধ করেছেন।
এদিকে, সুল্লি ডিলস মামলা দায়েরের পর প্রায় ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
ভারতের তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব শনিবার বলেছেন যে ওই অ্যাপটি যারা আপলোড করেছে গিটহাব তাদের ব্লক করেছে এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পুলিশ সাইবার সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করছে।
ভারতে অনলাইন হয়রানি নিয়ে ২০১৮ সালের অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো নারী যত বেশি সোচ্চার বা উচ্চকণ্ঠ হবেন, তার লক্ষ্যবস্তু হওয়ার আশঙ্কা তত বেশি, আর তিনি যদি ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং অনগ্রসর বর্ণের নারী হন, তাহলে এর মাত্রা আরো বেড়েছে।
সমালোচকরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে রাজনৈতিক পরিবেশ জটিল মেরুকরণ হয়ে যাওয়ার কারণে মুসলমান নারীদের বিরুদ্ধে ট্রোলিং পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
লেখক এবং ভারতে অ্যামনেস্টির সাবেক মুখপাত্র নাজিয়া এরাম সুল্লি ডিলস ঘটনার পর বলেন, এই টার্গেটেড এবং পরিকল্পিত হামলার মাধ্যমে আসলে শিক্ষিত মুসলমান নারী, যারা নিজেদের মত প্রকাশ করেন এবং ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাদের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা।