বাংলাদেশে প্রথম ট্যুরিজম ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল|Sunday, December 22, 2024
সাইটে আপনার অবস্থানঃ Home » খেলা » সাদা পোশাকে সেরা বাংলাদেশ

সাদা পোশাকে সেরা বাংলাদেশ 

032230Sports_kalerkantho_pic

বে ওভালের প্রেসবক্সে বসে মাঠ থেকে চোখ তুললেই প্রশান্ত মহাসাগরের নীল জলরাশির দেখা মেলে। বড় থেকে ছোট হতে হতে দূরের আকাশে মিশে kalerkanthoযাওয়া জলরাশিতে ছোট ছোট কালো বিন্দুগুলোকে দেখে বোঝাই যায় কোনো বাণিজ্যিক জলযান কিংবা প্রমোদতরি। সেই মিশে যাওয়া নীলাকাশের কোথাও ৫ জানুয়ারি, ২০২২ দিনটির অবিশ্বাস্য পরিণতি ক্ষুদ্রতম বিন্দু হয়েও ভাসতে দেখা গিয়েছিল বলে শোনা যায়নি। বরং চতুর্থ দিনে মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টের লাগাম মমিনুল হকের হাতে তোলা হয়ে গেলেও মনে কাঁটা হয়ে বিঁধছিল সংশয়, এক-আধটা সেশনেই না উল্টে যায় সব সম্ভাবনা! কিন্তু বাংলাদেশের ঘড়ি সকাল ৭টা ছোঁয়ার আগেই সব সংশয় ধুয়ে-মুছে রঙিন উৎসবের রঙে। মমিনুলদের মাউন্ট মঙ্গানুই জয়ের আধাবেলা পরও কম্পিউটারের কি-বোর্ডে হোঁচট খেতে খেতে চলছে অবিশ্বাসে আচ্ছন্ন আঙুল!

টম ক্রুজের ‘মিশন ইম্পসিবল’ অবিশ্বাস্য সব স্টান্টে ঠাসা। টেস্ট ম্যাচের রুদ্ধশ্বাস রোমাঞ্চ অবশ্য অত দ্রুতগতির নয়। তবে মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্ট একজন এবাদত হোসেনকে ‘ঘোস্ট প্রটোকলে’র টম ক্রুজের মর্যাদা দেয় সম্ভবত। ৪৬ রানে ৬ উইকেট তাঁর ক্যারিয়ারসেরা বোলিং। তবে ক্যারিয়ারসেরা বোলিং তো সবারই থাকে, সেই নৈপুণ্য ম্যাচ জেতায় কয়জন? এবাদতের সেরা বোলিং এনে দিয়েছে বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের সেরা জয়। আগের ১১ টেস্টের ক্যারিয়ারে বারবারই প্রশ্নবিদ্ধ এই বিমানসেনা আচমকা লাইমলাইটে, টম ক্রুজের স্টান্টের চেয়ে কম কী! উইকেটপ্রাপ্তির পর তাঁর সামরিক কায়দায় দেওয়া স্যালুটও লুফে নিয়েছে নিউজিল্যান্ড মিডিয়া। বৈশ্বিক ক্রিকেটের রাজাধিরাজরাও অভিনন্দন জানিয়েছেন বাংলাদেশ দলকে।

কোন দল? ছুটি নিয়ে এখন যুক্তরাষ্ট্রে সাকিব আল হাসান। চোটের কারণে ঢাকায় তামিম ইকবাল। টেস্ট থেকে অবসরে মাহমুদ উল্লাহ। তাই আরেকটি নিউজিল্যান্ড সফর মানেই অবধারিত হার ধরে নিয়েছিলেন সবাই। নিউজিল্যান্ডের কভিড প্রটোকলে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে সফর গুটিয়ে দেশে ফেরার অনুরোধও বোর্ড সভাপতি বরাবর করা হয়েছিল দলের পক্ষ থেকে। এমন অনভিজ্ঞ এবং মানসিক অবস্থা নিয়ে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট জয়ের স্বপ্ন কি কেউ দেখেছিলেন? কেউ প্রকাশ্যে বলেননি। তবে নিউজিল্যান্ডের বৈধ ক্রিকেটজুয়ার বাজারের খবর—বাংলাদেশের পক্ষে বাজি যদি কেউ এক ডলার ধরে থাকেন, তবে তিনি এখন ২১ ডলারের মালিক।

আসলে ১ জানুয়ারি থেকে বে ওভালে যা ঘটেছে, তার একটিই বিশ্বাসযোগ্য—টস। ওটা বাংলাদেশ জিতেছিল। এরপর অবিশ্বাস্য সব কাণ্ড ঘটতে থাকে মাঠে। নিউজিল্যান্ডের যেকোনো উইকেটে প্রথম ঘণ্টা মানেই ব্যাটারের অগ্নিপরীক্ষা। কিন্তু ২০১৬ সালে ক্রাইস্টচার্চের সবুজ উইকেটেও তো পথ হারিয়েছিল বাংলাদেশের পেস আক্রমণ। তাই ভরসা পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে যত সময় গড়িয়েছে, ততই ভরসা জুগিয়েছেন তাসকিন আহমেদ, শরিফুল ইসলাম এবং অবশ্যই এবাদত হোসেন। এঁদের সামনে জড়োসড়ো দেখিয়েছে কিউই ব্যাটারদের। অথচ বাংলাদেশের দুই তরুণ ওপেনার সাদমান ইসলাম ও মাহমুদুল হাসান জয় অনায়াসে খেলে দিয়েছেন স্বাগতিকদের পেস আক্রমণকে।

এই দুজনের পর নাজমুল হোসেন শান্ত, মমিনুল হক, লিটন কুমার দাস থেকে শুরু করে ৮ নম্বরে নামা মেহেদী হাসান মিরাজ—প্রথম ইনিংসে লিড নেওয়ার ক্ষেত্রে অবদান আছে এঁদের সবার। ১৭৬.২ ওভার ব্যাটিংয়ে যে টেস্টসুলভ মানসিকতা দেখিয়েছে, তা বাংলাদেশের বেলায় বিরল। ২০১৬ সালে ওয়েলিংটনে উঁকি দেওয়া জয়ের সম্ভাবনা চাপা পড়েছিল আরেকটি হারে। সেই ম্যাচের ৮ উইকেটে ৫৯৫ রানের ইনিংস এখনো নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ইনিংস। কিন্তু সেই ইনিংসটিরও দৈর্ঘ্য ছিল ১৫২ ওভার।

টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদের কণ্ঠে গতকাল এ নিয়েই বেশি উচ্ছ্বাস শোনা গেল, ‘ছেলেরা পাঁচ দিনই ডমিনেট করেছে। তবে সবচেয়ে ভালো লেগেছে ওদের মানসিকতা। কত লম্বা সময় ব্যাটিং করেছে, দেখেছেন?’ কোন দল? যে দলে অভিজ্ঞতা বলতে মুশফিকুর রহিম আর মমিনুল হক। জানা গেছে, জেতার পর ড্রেসিংরুমে চিরায়ত ‘আমরা করব জয়’ কোরাস গেয়ে দল ফিরে গেছে টিম হোটেলে। সেখানে বরাদ্দ বোর্ডরুমে গলা ফাটিয়ে জয় উদযাপন করেছেন মমিনুলরা। সেই পার্টিতে প্রবেশাধিকার ছিল না সিনিয়রদের, মানে টিম ম্যানেজমেন্টের কারোর। কে জানে, এই উৎসব বাংলাদেশের ক্রিকেট ভবিষ্যতের আকাশে নতুন সূর্যোদয়ের পূর্বাভাস কি না!

তবে অধিনায়ক মমিনুল হক জানেন, মাউন্ট মঙ্গানুই জয়ই টেস্ট সামর্থ্যের চূড়ান্ত মানদণ্ড নয়। বড়জোর ভবিষ্যদের অনুপ্রেরণা। ‘আপনারা (মিডিয়া) আবার ভাববেন না যে আগামী দুই বছরের মধ্যে আমরা র্যাংকিংয়ে ৫-৬-এ উঠে যাব’, ম্যাচের পর মনে করিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। তাই এই জয় দিয়ে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপকে ঘিরে প্রত্যাশার বেলুন ওড়ানোরও পক্ষে নন মমিনুল। বরং খুব ভালো করে জানেন যে ঘরের মাঠে টানা ১৭ ম্যাচে অপরাজিত নিউজিল্যান্ড আহত বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে ক্রাইস্টচার্চে।

মাউন্ট মঙ্গানুই জয়ের পর আর ভয় কী? দলও সেভাবেই মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানিয়েছেন খালেদ মাহমুদ, ‘প্রসেসটা ঠিক ছিল বলেই ম্যাচটা জিতেছি। পরের ম্যাচেও নিজেদের কাজগুলো ঠিকঠাক করাতেই মনোযোগ থাকবে। এরপর দেখা যাবে।’

একটি বড় জয় সম্ভবত এভাবেই আরেকটি উন্নতির পথ খুলে দেয়। কোনো বাগাড়ম্বর নয়, আরো উন্নতির পথ খুঁজছে বাংলাদেশ দল— ঐতিহাসিক জয়ের সঙ্গে এটাও কম প্রাপ্তি নয়।

তবে আজ সফরের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্ট খেলার জন্য ক্রাইস্টচার্চ শহরের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে বাঁধভাঙা উদযাপনে কোনো বাধা নেই। নাচ-গানের আসরে প্রবেশাধিকার না পেয়েও খুশি টিম ডিরেক্টর, ‘ওরা এটুকু ডিজার্ভ করে।’ অবশ্যই এটা তাঁদের প্রাপ্য।

শেয়ার করুন !!Share on FacebookTweet about this on TwitterShare on Google+Share on LinkedInShare on RedditBuffer this pageDigg thisShare on TumblrPin on PinterestShare on StumbleUponFlattr the authorEmail this to someone