জান্তার মিয়ানমারে ‘নিখোঁজ’ ব্যক্তিদের ফেরার অপেক্ষায় স্বজনেরা
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের পক্ষ থেকে ওই থানায় ফোন করা হয়েছিল। কিন্তু সেখান থেকে ওয়ে সোয়ের অবস্থান সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।
রয়টার্স আরও দুজন নিখোঁজ ব্যক্তির বিষয়ে খোঁজ নেয়। কিন্তু তাঁদের সম্পর্কেও থানা কর্তৃপক্ষ কিছু জানাতে পারেনি।
এ বিষয়ে জানতে জান্তার একজন মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে রয়টার্স। তবে ওই মুখপাত্র রয়টার্সের পাঠানো ই–মেইল ও ফোনের সাড়া দেননি।
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ওয়ে সোয়ের মতো অনেকে নিখোঁজ।
এএপিপির হিসাব অনুযায়ী, মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর এখন পর্যন্ত আট হাজারের বেশি মানুষকে আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে আছেন দেশটির নেত্রী অং সান সু চি ও তাঁর মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্য। এ ছাড়া জান্তার হাতে নিহত হয়েছেন প্রায় দেড় হাজার মানুষ।
তবে রয়টার্স স্বাধীনভাবে এএপিপির দেওয়া হিসাব যাচাই করতে পারেনি।
এএপিপি বলছে, জান্তার নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটক-গ্রেপ্তার হওয়ার পর কয়েক শ মানুষ মারা গেছে।
জান্তার দাবি, এএপিপির এই হিসাব অতিরঞ্জিত। সংস্থাটি মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে।
তবে আটক, গ্রেপ্তার বা নিহত ব্যক্তির প্রকৃত সংখ্যা কত, সে সম্পর্কে জান্তা কর্তৃপক্ষ কিছু জানায়নি।
প্রিয়জনের খোঁজে
সামরিক জান্তা যখন কাউকে গ্রেপ্তার করে, তখন তারা বিষয়টি পরিবারকে জানায় না। কারাগারের কর্মকর্তারাও একই কাজ করেন। তাই নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা থানা ও কারাগারে ফোন করেন। ছুটে যান। এভাবে তাঁরা তথ্য জানার চেষ্টা করেন। এ ছাড়া তাঁরা তথ্য জানার জন্য স্থানীয় গণমাধ্যম বা মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ওপর নির্ভর করেন।
এএপিপির সহপ্রতিষ্ঠাতা বো কি বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যেমনটা হয়, কাকে গ্রেপ্তার করা হলো, সংগঠনটি তা জানতে পারে। কিন্তু গ্রেপ্তারের পর তাঁকে কোথায় রাখা হয়েছে, তা জানা যায় না।
নিখোঁজ এসব মানুষের পরিবারের লোকজন মাঝেমধ্যে কারাগার বা থানায় খাবার পাঠান। তাঁদের ধারণা, যদি পাঠানো খাবারগুলো নেওয়া হয়, তাহলে হয়তো ওই কারাগার বা থানা হেফাজতে স্বজনেরা রয়েছেন।
গুমবিষয়ক জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপের চেয়ারপারসন তায়ে-উং বাইক রয়টার্সকে বলেন, গত বছরের ফেব্রুয়ারির পর থেকে তাঁরা মিয়ানমারের অনেক পরিবারের কাছ থেকে স্বজন গুম হওয়ার বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছেন। এই পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী একটি শহরে অবস্থান করছেন অ্যাকটিভিস্ট অং নে মিও (৪৩)। সামরিক অভ্যুত্থান–পরবর্তী প্রেক্ষাপটে তিনি দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের সাগাইং থেকে পালিয়ে সেখানে আশ্রয় নেন। তিনি রয়টার্সকে বলেন, গত বছরের ডিসেম্বরে জান্তার সেনারা তাঁদের বাড়ি থেকে তাঁর বাবা-মা ও ভাই-বোনদের তুলে নিয়ে যায়। তিনি জানেন না, এখন তাঁরা কোথায় আছেন।
অং নে মিও ব্যঙ্গাত্মকধর্মী লেখা লিখেন। তাঁর ধারণা, এই লেখার জন্যই পরিবারের সদস্যদের আটক করেছে জান্তা। পরিবারের আটক সদস্যদের মধ্যে তাঁর বাবার বয়স ৭৪ বছর। তিনি স্ট্রোক করে পঙ্গু হয়ে গেছেন।
অং নে মিও বলেন, ‘পরিবারের নিখোঁজ সদস্যদের জন্য প্রতিমুহূর্তে চিন্তা করা ছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই।’
এ বিষয়ে জানতে শহরটির দুটি থানায় ফোনে যোগাযোগ করলেও সেখান থেকে কোনো সাড়া পায়নি রয়টার্স।
কর্তৃপক্ষের এমন দমনপীড়নের মধ্যে মিয়ানমারের কিছু এলাকায় জান্তাবিরোধী প্রতিরোধ সহিংস রূপ নিয়েছে। অনেকে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন।
জান্তার নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের লড়াইয়ের কারণে হাজারো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, মিয়ানমার হাজারো মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে থাইল্যান্ড ও ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
ভাইরাল ছবি
মিয়ানমারের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় কায়াহ রাজ্যে তুমুল লড়াই চলছে। কারেনি হিউম্যান রাইটস গ্রুপের পরিচালক বানার খুন নাউং বলেন, সেখানে অন্তত ৫০ জন নিখোঁজ রয়েছেন।
নিখোঁজ এসব ব্যক্তিকে খুঁজে পেতে পরিবারকে সাহায্য করছে মানবাধিকার সংস্থাটি। বানার খুন নাউং বলেন, ‘নিখোঁজ মানুষগুলোর পরিবার খুব কষ্টে আছে, বিশেষ করে মানসিকভাবে। কারণ তাঁরা জানেন না, তাঁদের প্রিয়জন কোথায় আছেন।’
সংঘাতের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন মিন্ট অং। কায়াহর একটি আশ্রয়শিবিরে আছেন তিনি। তাঁর বয়স পঞ্চাশের কোটায়। মিন্ট বলেন, গত সেপ্টেম্বর থেকে তাঁর ১৭ বছর বয়সী ছেলে পাসকালাল নিখোঁজ।
মিন্ট বলেন, তাঁর ছেলে এক দিন তাঁকে বলে, সে রাজ্যের রাজধানী লোইকাতে পরিবেশ পরিস্থিতি দেখতে যাচ্ছে। কিন্তু সে আর ফিরে আসেনি।
রয়টার্সকে মিন্ট বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাঁর ছেলেকে আটক করেছে। স্থানীয় লোকজন তাঁকে এ কথা বলেছেন। এক দিন তিনি তাঁর ছেলের জন্য খাবার নিয়ে থানায় যান। গিয়ে দেখেন, সেনারা এলাকাটি ঘিরে রেখেছে। এটা দেখে তিনি সেখান থেকে পালাতে বাধ্য হন।
তার পর থেকে ছেলের সম্পর্কে আর কিছুই জানতে পারেননি মিন্ট। কিন্তু মানবাধিকার সংস্থাটি তাঁকে বলেছে যে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া কিছু মানুষের সঙ্গে তারা কথা বলেছে। তারা জানতে পেরেছে যে মিন্টের ছেলে আর থানায় নেই। তবে এসব তথ্য স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি রয়টার্স।
কারেনি হিউম্যান রাইটস গ্রুপের পরিচালক বানার খুন নাউং বলেন, যে দুই কিশোরকে আটকের পর রাস্তার পাশে হাঁটু গেড়ে রেখে বেধড়ক মারধর করা হয়েছিল, তাদের একজন পাসকালাল। এ ঘটনার ছবি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। পাসকালালের বোন রয়টার্সকে নিশ্চিত করেন, সেনাদের হাতে নির্যাতিত দুই কিশোরের মধ্যে একজন ছিল তাঁর ভাই।
ভাইরাল ওই ছবি এমন একটি অ্যাকাউন্ট থেকে সামাজিকমাধ্যমে পোস্ট করা হয়েছিল, যেটি মিয়ানমারের উচ্চপদস্থ একজন সেনা কর্মকর্তার। ছবির ক্যাপশনে লেখা ছিল, ‘আমরা তাদের মাথায় বুলেট চালিয়ে দেওয়ার আগে তারা যা চায়, তা করতে দিই।’
পরে অ্যাকাউন্টটি মুছে দেওয়া হয়। অ্যাকাউন্টটি যে সেনা কর্মকর্তার, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি রয়টার্সের।
পাসকালালের বাবা মিন্ট বলেন, ‘সে একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক সাধারণ ছেলে। সে ভুল কিছু করেনি।’
এ ব্যাপারে জানার জন্য লোইকাওয়ের পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে রয়টার্স। তবে পুলিশের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
ইয়াঙ্গুনে ওয়ে সোয়ের পরিবার তাঁর চার বছরের মেয়েকে এই বলে এখন বুঝ দিচ্ছে যে তার বাবা দূরের এক জায়গায় কাজ করতে গেছেন।
ওয়ে সোয়ের বাবা উইন হ্লাইং বলেন, ছোট মেয়েটি তার বাবাকে নিয়ে মাঝেমধ্যে অপরিস্ফুটভাবে কথা বলে। সে বলে, ‘আমার বাবা অনেক দূরে চলে গেছে।’