নৃশংস তালেবান স্নাইপার থেকে মেয়র হয়ে যা করছেন মহিবুল্লাহ
যুদ্ধদিনে মহিবুল্লাহর হাতে বা কাঁধে থাকত স্নাইপার। প্রাণঘাতী এই অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে বিচরণ করতে তিনি। আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলে তালেবানের ‘শত্রু’নিধনই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য।
বিদেশিদের হটিয়ে, পশ্চিমা-সমর্থিত সরকার উৎখাত করে আফগানিস্তানের ক্ষমতা তালেবানের দখলে যাওয়ার পরের প্রেক্ষাপটে মহিবুল্লাহর দায়িত্ব বদলে যায়। স্নাইপার চালানোর বদলে তিনি এখন একটি শহর চালান।
তবে মহিবুল্লাহকে এখনো প্রচুর ঘুরতে হয়। পায়ে হেঁটে চষে বেড়াতে হয় শহরের অলিগলি।
ভয়ংকর-নৃশংস তালেবান যোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি পাওয়া মহিবুল্লাহর এখন আর যুদ্ধের ব্যস্ততা নেই। কিন্তু তাই বলে তাঁর অবসরও নেই। মায়মানার মেয়র হিসেবে স্থানীয় সরকারের নানান কাজ নিয়ে তাঁকে সারাক্ষণ ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়।
মেয়র হওয়ার পর থেকে মহিবুল্লাহকে নগরবাসীর নানা সমস্যার কথা শুনতে হচ্ছে। অভাব-অভিযোগ-সমস্যার কথা শুনে তা সমাধানের চেষ্টা করছেন তিনি।
এখন মহিবুল্লাহর দৈনন্দিন কাজের তালিকায় রয়েছে বন্ধ হয়ে থাকা নর্দমা সচল করা, সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন, স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যকার বিবাদ-বিরোধ নিরসনের মতো অনেক বিষয়।
তালেবান ক্ষমতায় এসে সরকার পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছে। দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয়। খোদ জাতিসংঘই বলছে, আফগানিস্তান একটি মানবিক সংকটের মুখোমুখি।
তালেবান এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি। এই স্বীকৃতি অর্জনের জন্য তারা আন্তর্জাতিক মহলে দেনদরবার করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বীকৃতির আগে মানবাধিকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে তালেবানকে শর্ত দিয়েছে। তালেবান বলছে, তারা তাদের আগের শাসনকালের কুখ্যাতি ঘুচিয়ে একটি রূপান্তরিত সরকার হওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে।
বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, নৃশংস স্নাইপার যোদ্ধা থেকে মহিবুল্লাহর নগর ও জনবান্ধব কর্মব্যস্ত মেয়র হওয়ার প্রচেষ্টার বিষয়টি তালেবানের রূপান্তর প্রক্রিয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
মহিবুল্লাহকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এএফপি। তিনি এএফপিকে খোলামেলাভাবে বলেন, ‘আমি যখন যুদ্ধে ছিলাম, তখন আমার লক্ষ্য ছিল খুবই স্পষ্ট—বিদেশি দখলদারি, বৈষম্য ও অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটানো।’
মহিবুল্লাহ বলেন, ‘এখন আমার লক্ষ্য স্পষ্ট—দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা ও দেশকে সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলা।’
শৈশব-কৈশোর-তারুণ্য
মায়মানার রাস্তার পাশের নর্দমা পরিষ্কার করছিলেন পৌর কর্মীরা। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পৌর কর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায় নতুন মেয়র মহিবুল্লাহকে।
প্রায় এক লাখ বাসিন্দার শহরের অনেক মানুষ মহিবুল্লাহর কাছে অভিযোগ নিয়ে আসছিলেন। কেউ-বা দিচ্ছিলেন পরামর্শ। তিনি সব অভিযোগ ও পরামর্শ টুকে নিচ্ছিলেন। আর প্রয়োজন অনুযায়ী নিচ্ছিলেন পদক্ষেপ।
মহিবুল্লাহর সহকারী হিসেবে কাজ করছেন সৈয়দ আহমাদ শাহ গেয়াসি। তিনি তালেবানের সদস্য নন। মহিবুল্লাহ সম্পর্কে তাঁর এই সহকারী বলেন, ‘নতুন মেয়র বয়সে তরুণ। তিনি সুশিক্ষিত। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তিনি এই শহরেরই সন্তান। তিনি ভালো করেই জানেন যে এখানকার মানুষের সঙ্গে কীভাবে চলতে হবে।’
তালেবানের বেশির ভাগ সদস্য সাধারণত গরিব। তাঁরা গ্রামের মাদ্রাসাপড়ুয়া লোকজন। কিন্তু মহিবুল্লাহ তাঁদের থেকে ভিন্ন।
ধনী বণিক পরিবারের সদস্য মহিবুল্লাহ। তিনি মায়মানাতেই বেড়ে উঠেছেন। স্কুলে ভালো ছাত্র হিসেবে তাঁর নাম ছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলায়ও তিনি বেশ পারদর্শী ছিলেন।
শৈশব-কৈশোরে মহিবুল্লাহর নানান অর্জন আছে। এসব অর্জনের নানা স্মারক ও সনদ তাঁর কার্যালয়ে শোভা পেতে দেখা যায়। এর মধ্যে হাইস্কুলে পড়ালেখার সময় মার্শাল আর্ট প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পাওয়া কৃতিত্বের সনদও রয়েছে।
মহিবুল্লাহ ১৯ বছর বয়সে তালেবানে যোগ দেন। পরে তাঁকে ফারিয়াব প্রদেশের একটি ছোট তালেবান ইউনিটের প্রধান করা হয়।
অনেকে মহিবুল্লাহকে তালেবানের অন্যতম দক্ষ স্নাইপার যোদ্ধা বলে বর্ণনা করে থাকেন। তবে এই প্রসঙ্গ উঠলে যুদ্ধসংক্রান্ত কোনো গল্প বলার ক্ষেত্রে অনীহা দেখান তিনি।
এএফপির প্রতিনিধির সঙ্গে মায়মানার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে একটি বাড়ির সামনে গিয়ে থেমে যান মেয়র মহিবুল্লাহ। বাড়িটিতে এখনো যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। এই বাড়িতে থেকেই একসময় তিনি তাঁর তালেবান ইউনিট চালাতেন।
এখানেই মহিবুল্লাহ স্নাইপার নিয়ে লুকিয়ে থাকতেন। স্নাইপারের নিশানার নাগালে মার্কিন সেনাদের পাওয়ার জন্য তিনি অপেক্ষা করতেন।
সাইফুদ্দিন নামের স্থানীয় এক কৃষক বলেন, এই বাড়ি থেকেই তিনি (মহিবুল্লাহ) গুলি করে এক মার্কিন সেনাকে হত্যা করেন। পরে একটি যুদ্ধবিমান এসে বাড়িটি লক্ষ্যবস্তু করে তাঁর ওপর বোমা হামলা করে।
এক ভিন্ন তালেবান
গত আগস্টে ক্ষমতা দখলের পর তালেবান আফগানিস্তানে ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ তুলেছে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা।
দেশটির সাবেক সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীর শতাধিক সদস্যকে হত্যার জন্য তালেবানকে দায়ী করা হচ্ছে। নারী অধিকারকর্মীদের আটকের পাশাপাশি বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহকারী সাংবাদিকদের মারধরের অভিযোগও আছে তালেবানের বিরুদ্ধে।
তালেবানের বহুল পরিচিত মুখশ্রী ও পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে হয়তো মহিবুল্লাহকে পার্থক্য করা যায় না। কিন্তু তিনি নানাভাবে কট্টরপন্থী নীতিতে বিশ্বাসী অন্য সব তালেবান থেকে ব্যতিক্রম।
তালেবান ক্ষমতায় এসে জনপরিসর থেকে আফগান নারীদের ঘরে ঠেলে দিয়েছে। তরুণ নারী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দরজা বন্ধ করে রেখেছে। কর্মক্ষেত্র অনেকাংশে নারী কর্মীকে আসতে বাধা দেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু মেয়র মহিবুল্লাহর কার্যালয়ের দৃশ্য ভিন্ন। তাঁর কার্যালয়ে নারী কর্মীদের কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে। শহরের একটি পার্ক নারীদের জন্য সংরক্ষিত করে দিয়েছেন তিনি।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবানের প্রথম শাসনামলে আফগানিস্তান নারীদের জন্য মুখমণ্ডলসহ পুরো শরীর ঢেকে রাখার বোরকা পরা বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু এবার ক্ষমতায় এসে আগেরবারের মতো তালেবান এই ব্যাপারটিতে ততটা কঠোর অবস্থানে নেই। তা সত্ত্বেও রাজধানী কাবুলে নারীরা যাতে বাইরে তাঁদের মুখ ঢেকে চলাচল করেন, সেই আদেশ জারি করা হয়েছে।
এখানেও মেয়র মহিবুল্লাহ ব্যতিক্রম। তাঁর কার্যালয়ে কাজ করা নারীদের পোশাক পরার ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়নি।
মায়মানায় মেয়র মহিবুল্লাহর কার্যালয়ে মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন কাহেরা নামের ২৬ বছর বয়সী এক নারী। বিদ্যমান পোশাকবিধি মেনে তিনি হিজাব পরে অফিস করেন। তবে পোশাকের ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
কাহেরা বলেন, মায়মানায় মেয়রের কার্যালয়ে কেউ আমাদের বলে না যে কীভাবে বা কোন ধরনের পোশাক পরতে হবে।