বাংলাদেশে প্রথম ট্যুরিজম ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল|Sunday, December 22, 2024
সাইটে আপনার অবস্থানঃ Home » জাতীয় » সরকারের ভুল ও ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে

সরকারের ভুল ও ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে 

article

নিজস্ব প্রতিবেদক : সিস্টেম লসের কারণে ক্ষতি বছরে হাজার কোটি টাকারও বেশি। বিদ্যুৎ চুরির হিসাব সিস্টেম লসের নামে চালিয়ে দেয়া হয়। এই চুরি রোধ করা গেলে ক্ষতির ৮০ শতাংশ বাঁচানো যাবে।

সরকারের ভুল নীতি ও ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। সিস্টেম লসসহ অন্যান্য খাতে লোকসান কমিয়ে ব্যয় কমানো উচিত।

বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোই সমাধান নয় : শামসুল আলম, জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা : ক্যাব

টিটু সাহা : গত মহাজোট সরকারের আমলে কয়েক দফা বৃদ্ধির পর আবারো বাড়ছে বিদ্যুতের দাম। আর বিদ্যুতের এ মূল্যবৃদ্ধির উদ্যোগে সব মহল থেকেই সমালোচনার মুখে পড়েছে সরকার। রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে সবাই বলছে এতে সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে যাদের ঘাড়ের ওপর এই মূল্যবৃদ্ধির কোপ পড়তে যাচ্ছে সেই গ্রাহকশ্রেণী বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তরা এ নিয়ে রয়েছেন আতঙ্কে।

এদিকে খুচরা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আইনি প্রক্রিয়া বা গণশুনানি শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই দেশের অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি এ নিয়ে কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে। পাশাপশি সিপিবি-বাসদসহ বিভিন্ন বামদলও এর প্রতিবাদে বিভিন্ন কর্মসূূচি পালন করছে। তেলগ্যাস, খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ঘোষণা দিয়েছে দরকার হলে তারা হরতালও করবে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা মারুফ বিল্লাহ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, এমনিতেই বাড়িভাড়া, গাড়িভাড়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অতিরিক্ত মূল্য দিতে দিতে অবস্থা খারাপ। তার ওপর বারবার সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের পথে বসতে হবে।

অর্থনীতিবিদরাও এর সমালোচনা করে বলছেন, গত কয়েক মাসে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এমনিতেই দেশের অর্থনীতি কঠিন সময় পার করছে। এখন যখন পরিস্থিতি একটু সামলে উঠছে তখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানো অযৌক্তিক। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দামও বাড়েনি যে হঠাৎ বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। তাছাড়া বিভিন্ন বিতরণ কোম্পানি যেভাবে দাম বাড়াতে চাইছে তাতে দেশের অর্থনীতির প্রাণ কৃষি খাত মার খাবে মারাত্মকভাবে। আর এ খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার দায় পড়বে সরকারের ওপর।

পিডিবির প্রস্তাবের উদাহরণ দিয়ে অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, এক্ষেত্রে যারা সবচেয়ে কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন সেই নিম্নবিত্তদের বিদ্যুতের ক্ষেত্রে মূল্য সবচেয়ে বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি। যারা শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিটের মধ্যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন তাদের জন্য পিডিবি বিদ্যুতের খুচরা মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে ইউনিট প্রতি এক টাকা ৭০ পয়সা। অন্যদিকে সচ্ছল গ্রাহকদের জন্য মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে মাত্র দুই পয়সা। এরকম সব প্রতিষ্ঠানেই বৈষম্যমূলক প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এটা সরকারের ইঙ্গিতেই করা হয়েছে।

বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির জন্য অনুষ্ঠিত গণশুনানিকে ‘লোক দেখানো নাটক’ মন্তব্য করে তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে সরকার এমন সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে রেখেছিল। এ প্রস্তাব মন্ত্রণালয় থেকে এসেছে। নিয়ম অনুযায়ী বিইআরসি কোনো অনুসন্ধান করেনি।

তিনি বলেন, যারা পরিমাণে বেশি ও বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন তারা বিদ্যুৎ বিল ফাঁকি দেন। অন্যদিকে যারা কৃষক ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত তারা নিয়মিত বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করলেও তাদের বিদ্যুতের দাম তুলনামূলক বেশি বৃদ্ধি করে জীবনযাত্রার ব্যয়ভার আরো বাড়ানো হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার সেচ গ্রাহকদের জন্য দেশের সর্ববৃহৎ বিতরণ সংস্থা আরইবি ইউনিটপ্রতি ২৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। কৃষিতে বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৪ টাকা ২৬ পয়সায় কিনে ৩ টাকা ৮৫ পয়সায় বিক্রি করে আরইবি। এতে আরইবির লোকসান প্রতি ইউনিটে ৪১ পয়সা। কিন্তু এটা আপেক্ষিক লোকসান। এতে আরইবির লোকসান হলেও কৃষক লাভবান হয় এবং তাতে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি লাভবান হয়। তাই এই লোকসানকে সরকার সোজাভাবে দেখলে তা ঠিক হবে না।

কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, সরকারের ভুলনীতি এবং ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। সরকারি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ না করে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। একই গ্যাস দিয়ে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে কম দামে গ্রাহকরা বিদ্যুৎ পেতো। তিনি বলেন, ডিপিডিসি ও ডেসকোর উন্নয়ন ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে। যা বিদ্যুৎ খাতের সঙ্গে
সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তিনি বলেন, সিস্টেমলসসহ অন্যান্য খাতে লোকসান কমিয়ে তাদের ব্যয় কমানো উচিত। বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোই সমাধান নয়।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সরকারি হিসাবে বর্তমানে বিদ্যুতের সিস্টেম লসের কারণে বছরে ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৩৪২ কোটি টাকা। গড়ে দেশের পাঁচটি বিতরণ কোম্পানির বিদ্যুতের সিস্টেম লস শতকরা ১৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এরমধ্যে বিতরণের ক্ষেত্রে লসের পরিমাণ ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। অবশিষ্ট ২ দশমিক ৯৬ শতাংশ লস হচ্ছে সঞ্চালনে।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিপিডিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, সিস্টেম লসের কারণে ক্ষতির পরিমাণ বছরে হাজার কোটি টাকারও বেশি। অবশ্য এরমধ্যে কিছু বিষয় আছে। আসলে কারিগরি কারণে কখনোই বিদ্যুতের সিস্টেম লস ৭-৮ শতাংশের বেশি হবার কথা নয়। কিন্তু বিদ্যুৎ চুরির হিসাব সিস্টেম লসের নামে চালিয়ে দেয়া হয়। তাই এই চুরি রোধ করা গেলে ক্ষতির ৮০ শতাংশ বাঁচানো যাবে। ফলে বিদ্যুতের দাম বারবার বাড়াতেও হবে না।

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগের সমালোচনায় মুখর ব্যবসায়ী সমাজও। এফবিসিসিআইর প্রথম সহ-সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, এ সময় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় সরকারের কিছুটা ভর্তুকি কমবে। সেটা ভালো দিক। তবে যে হারে বিদ্যুতের বিল বাড়ছে তাতে অচিরেই শিল্প খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভিশন ২০২১ বাস্তবায়নে এখনই খরচের চেয়ে বেশি আয় করতে চায় বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো। ভবিষ্যৎ প্রকল্প বাস্তায়নে এখনই গ্রাহকদের কাছ থেকে বেশি টাকা নেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। শুধু আয় ব্যয়ের ঘাটতি মেটানো নয়, রীতিমতো উচ্চলাভ করতে চায় বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো। সরকারও তাতে সায় দিয়েছে।

তিনি বলেন, দেশের বিদ্যুৎ খাতে বছরে ভর্তুকির পরিমাণ প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা। এ ভর্তুকির অর্থে খুচরা গ্রাহক পর্যায়ের মানুষের লাভ হয় সামান্যই। ছয় হাজার কোটি টাকার পুরোটাই চলে যায় রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের ভাড়া ও বিদ্যুৎ কেনা বাবদ। অথচ বর্তমানে গড়ে উৎপাদিত সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের মধ্যে মাত্র এক হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল থেকে।

উল্লেখ্য, আগে গত ৪ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত বিইআরসি কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি), ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) এবং পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) খুচরা বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির জন্য যথাক্রমে ১৫ দশমিক ৫০, ৮ দশমিক ৫৯, ২৩ দশমিক ৫০, ১৫ দশমিক ৯০ এবং ১২ দশমিক ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করে। বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি এর পরিপ্রেক্ষিতে মূল্য ৬ দশমিক ৬৬, ৭ দশমিক ৫১, ৬ দশমিক ০৩, ২ দশমিক ০১ এবং ৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করে। বিইআরসি সূত্র ইঙ্গিত দিয়েছে দাম বাড়তে পারে ৫ থেকে ৮ শতাংশ। আগামী ১৫ মার্চ নাগাদ মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা দিতে পারে বিইআরসি।

শেয়ার করুন !!Share on FacebookTweet about this on TwitterShare on Google+Share on LinkedInShare on RedditBuffer this pageDigg thisShare on TumblrPin on PinterestShare on StumbleUponFlattr the authorEmail this to someone