‘কিছু বই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্তকাল’
বাংলাদেশের সমকালীন সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদ সমধিক পরিচিত নাম। আজ ১৩ নভেম্বর তাঁর ৭৫তম জন্মদিন। উপন্যাস, গল্প, সরস রচনা, টিভি নাটক, চলচ্চিত্র নির্মাণ—সবখানে তিনি নিজ গুণে অনন্য। গীতিকার হিসেবেও অগণিত শ্রোতার মন জয় করেছেন।
বিজ্ঞাপন
প্রয়াণের এক বছর পরও এতটুকু ম্লান হয়নি তাঁর পাঠকপ্রিয়তা, জনপ্রিয়তা।
হুমায়ূন আহমেদের গদ্য ও রচনাশৈলীর বিমুগ্ধ বিপুলসংখ্যক পাঠকের পাশাপাশি কিছু সমালোচকও রয়েছেন, যাঁরা তাঁর সাহিত্যকে নানাভাবে কটাক্ষ করার চেষ্টা করেছেন। এই পক্ষ-বিপক্ষের মাঝখানে হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য নিয়ে কয়েকজন অনুসন্ধানী করছেন উচ্চতর গবেষণা। এমন চারজন গবেষক হলেন সানজিদা ইসলাম, মো. সাইদুর রহমান, মুম রহমান ও নাহিদা নাহিদ।
হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য নিয়ে তাঁর জীবদ্দশায়ই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একাডেমিক গবেষণার কাজ শুরু করেন লেখক ও গবেষক মুহম্মদ মজিবুর রহমান। মুম রহমান নামে ঢাকার সাহিত্যাঙ্গনে তিনি পরিচিত। ২০১০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্প : করণকৌশল ও বৈচিত্র্য’ শিরোনামে এমফিলের কাজ শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির বাংলা বিভাগের অধ্যাপক খালেদ হোসাইনের তত্ত্বাবধানে এমফিল শেষ করে এখন পিএইচডি করছেন। তাঁর পিএইচডির বিষয় ‘হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র ও সাহিত্যের তুলনামূলক আলোচনা’।
গবেষক মুম রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, হুমায়ূন আহমেদ যে একজন বিশ্বমাপের ছোটগল্পকার, সে কথাই উঠে এসেছে তাঁর গবেষণায়। বিশ্বের অন্য বড়মাপের গল্পকারদের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা করেছেন তিনি। হুমায়ূনের গল্পের কাঠামোর ভাষাশৈলী, কৌশলগত দিক, ভাবনা ও গল্পের মূল বিষয়বস্তু নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন।
হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে গবেষণার কারণ জানতে চাইলে মুম রহমান বলেন, ‘আমার বিবেচনায় তিনি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের একজন। জনপ্রিয়তার আড়ালে উনার মানটা ঢাকা পড়ে গেছে। তথাকথিত সাহিত্যিকরা ফ্যাশন করে বলার চেষ্টা করেন যে হুমায়ূন আহমেদ একজন দুর্বল লেখক। সবল লেখক আসলে কাকে বলে, এ বিষয়ে তাঁদেরও একটু জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করেছি। ’
একাডেমিক গবেষণায় তথ্যসূত্র দিয়ে উপসংহারে পৌঁছতে হয়। ‘হুমায়ূন আহমেদ ভালো লিখেন’—এ কথা বললেই হয়ে যাবে না। জায়গায় জায়গায় তথ্যসূত্র দিয়ে তা প্রমাণ করতে হবে। মুম রহমান যেহেতু হুমায়ূনকে নিয়ে গবেষণার শুরুটা করেছিলেন, তাই তাঁর কাছে তেমন তথ্যসূত্র ছিল না। হুমায়ূন তখন জীবিত ছিলেন বলে পত্রপত্রিকায়ও তাঁকে নিয়ে তখন অতটা লেখা হয়নি। ফলে তথ্যসূত্র বের করে নিজের বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করাটাই ছিল এই গবেষকের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ সফলভাবেই মোকাবেলা করতে পেরেছেন তিনি। এমফিল তো আগেই করেছেন। ২০২৩ সালের ভেতর পিএইডির কাজও শেষ করতে পারবেন বলে তাঁর আশা।
নেত্রকোনার শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষক সানজিদা ইসলামের মধ্যে তাঁর গবেষণার কাজ শেষ করেছেন। তাঁর গবেষণার শিরোনাম ‘হুমায়ূন আহমেদের কথাসাহিত্যে স্বাদেশিক চেতনা’। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে পিএইচডির কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। তাঁরও তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির বাংলা বিভাগের অধ্যাপক খালেদ হোসাইন। ছয় বছর গবেষণার পর সানজিদা ইসলাম অর্জন করেন পিএইচডি ডিগ্রি।
কালের কণ্ঠকে সানজিদা ইসলাম বলেন, ‘কথাসাহিত্য এমন একটি সাহিত্য আঙ্গিক, যার উদ্দেশ্য জীবনের সমগ্রতার সন্ধান করা। আধুনিক কথাসাহিত্য মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব, মানসিক সংকট ও জীবন বাস্তবতার মূলিভূত সত্তার অন্বেষণ করেছে। সেই দিক থেকে আমি মনে করি, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা কথাসাহিত্যের একজন অন্যতম শিল্পী হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর এমন কিছু বই আছে, যা তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্তকাল। এসব ভাবনা থেকেই মূলত হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে গবেষণা করা। ’
‘হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস : বিষয়-বৈচিত্র্য ও উপস্থাপন-কৌশল’ শিরোনামে ২০১৫ সালের আগস্টে পিএইচডি গবেষণা শুরু করেন নরসিংদী সরকারি মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. সাইদুর রহমান। হিমু ও মিসির আলী সিরিজ বাদ দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের ১৬১টি উপন্যাস নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন। অভিধান তত্ত্ববিধ অধ্যাপক স্বরোচিষ সরকারের তত্ত্বাবধানে তিনি গবেষণা কাজ শেষ করেন। তাঁর বহিঃপরীক্ষক ছিলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য পবিত্র সরকার। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ (আইবিএস) থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত হন।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক নাহিদা নাহিদের (নাহিদা বেগম) পিএইচডির কাজ চলমান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক অনিরুদ্ধ কাহালির তত্ত্বাবধানে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসে মধ্যবিত্ত জীবন বিষয়ে তিনি গবেষণা করছেন। হুমায়ূনের উপন্যাসে বিবৃত মধ্যবিত্তের বিড়ম্বিত জীবন তাঁর গবেষণার প্রধান বিষয়। ২০২৩ সালের ভেতর তিনিও পিএইচডি সম্পন্ন করতে পারবেন বলে আশাবাদী।
মুম রহমান ও সানজিদা ইসলামের গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক খালেদ হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের অনেক জনপ্রিয় একজন লেখক। জনপ্রিয়তার পেছনে কোনো না কোনো কারণ থাকে। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর শুরুর দিকের রচনায়ই উন্নত রচনাশৈলীর মাধ্যমে নিজের যোগ্যতার পরিচয়টা দিয়েছেন। এ অঞ্চলের মানুষের আবেগ, মুখের ভাষা, তাদের আচরণ নিয়ে লেখার মধ্য দিয়ে তিনি জনচিত্রগ্রাহ্য হয়ে উঠতে পেরেছেন। মহৎ সাহিত্যের নামে সাহিত্যকে জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেননি। মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক তাঁর লেখা ছোট গল্প বা উপন্যাসগুলো আকারে খুব বড় নয়, কিন্তু সেগুলোতে হৃদয় কামড়ে তোলার উপাদান রয়েছে, এগুলো লেখক হিসেবে তাঁর শক্তি। এসবই তিনি সহজ ভাষায় করতে পেরেছেন। এ জন্য তাঁর মূল্যায়ন হওয়া দরকার। তাঁর প্রতি গবেষকদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছেও। ’
গবেষকদের সবাই জানালেন, হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যের প্রতি গবেষকদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। আগামী দিনগুলোতে হুমায়ূন সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে আরো অনেকেই গবেষণা করবেন।
জন্মদিনে নুহাশপল্লী
গাজীপুর থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, জীবদ্দশায় হুমায়ূন আহমেদ কখনো ঘটা করে জন্মদিন পালন করেননি। তাই তাঁর নুহাশপল্লীও আজ থাকবে আড়ম্বরহীন।
চাঁদ ছিল হুমায়ূনের ভীষণ পছন্দের। চাঁদের সৌন্দর্য উপভোগ করতে কাছের বন্ধু ও স্বজনদের নিয়ে জোছনা রাতে ছুটে যেতেন নুহাশপল্লীতে। আড্ডা হতো লিচুতলায়। জন্মদিনে আজ তিনি আছেন তাঁর সেই প্রিয় লিচুগাছতলায়।
গতকাল নুহাশপল্লীর তত্ত্বাবধায়ক সাইফুল ইসলাম বুলবুল বলেন, ‘স্যার কখনো ঘটা করে জন্মদিন পালন করতেন না। তাই আমরাও কখনো জন্মদিনে উৎসব করি না। ’
বুলবুল জানান, প্রতিবছরের মতো আজও স্যারের জন্মদিনে তাঁরা রাত ১২টা ১ মিনিটে মোমবাতি জ্বেলে স্যারকে স্মরণ করবেন। নুহাশপল্লীকে আলোকিত করবেন।
অন্যান্য বছরের মতো আজ সকালে হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী শাওন দুই ছেলেকে নিয়ে নুহাশপল্লীতে আসবেন। তাঁর সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন এবং পরে কেক কাটবেন। এর বাইরে নুহাশপল্লীতে আর কোনো কর্মসূচি নেই।