রাজস্ব খাতে সংস্কার চেয়ে আইএমএফের চিঠি
কর অব্যাহতিসহ রাজস্ব খাতে সংস্কার নিয়ে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি।
গত ৪ নভেম্বর ইস্যু করা চিঠিটি অর্থ মন্ত্রণালয় পেয়েছে ১৭ নভেম্বর। বাজেট সহায়তা নিয়ে আলোচনার জন্য আসা আইএমএফ প্রতিনিধিদল ঢাকা ছেড়েছিল ৯ নভেম্বর।
বিজ্ঞাপন
পাঁচটি করণীয় বা শর্ত দিয়ে বাংলাদেশকে ৪৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার প্রাথমিক সমঝোতা হয় ওই সফরে। বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত পাঁচটি করণীয়র অন্যতম হলো রাজস্ব খাতে সংস্কার আনা।
চলতি অর্থবছর বিভিন্ন খাতে কর অব্যাহতি দিয়েছে সরকার। এতে বছরে আড়াই লাখ কোটি টাকার মতো রাজস্ব কমছে। দেশের কর-জিডিপি না বাড়ার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতার অন্যতম এটি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো বড় বড় প্রকল্পে সরকার কর অব্যাহতি দিয়ে রেখেছে।
গত ২৪ জুলাই ব্যালান্স অব পেমেন্ট, বাজেট সহায়তা ও অবকাঠামো খাতের জন্য ৪৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ চেয়ে আইএমএফকে চিঠি দেয় সরকার। এই ঋণের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা করতে আইএমএফের দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদল গত ২৬ অক্টোবর থেকে ১৫ দিন ঢাকা সফর করে। এ সময় সংস্থার পক্ষ থেকে বিভিন্ন করণীয় বা শর্ত নিয়ে আলোচনা করা হয়। এর মধ্যে রাজস্ব খাতে সংস্কার, ভর্তুকি কমানো, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা, ব্যাংক খাতে সংস্কার, নয়-ছয় সুদহার তুলে দেওয়া ছিল অন্যতম। সরকারের সঙ্গে আলোচনা শেষে গত ৯ নভেম্বর বাংলাদেশকে ৪৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দেয় আইএমএফ। এখন ঋণের প্রথম কিস্তি পেতে এসব করণীয়র কয়েকটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে হবে। সে বিবেচনায় আইএমএফের এ চিঠি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে বলে জানিয়েছেন এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
আইএমএফের চিঠি প্রাপ্তির কথা স্বীকার করে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একজন সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, আইএমএফের শর্তের জন্য নয়, অর্থনীতির স্বার্থেই কর অব্যাহতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। ক্রমান্বয়ে তা কমিয়ে আনতে তাঁরা কাজ করছেন বলেও জানান এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, রাজস্ব সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া।
চিঠিতে আইএমএফ যা বলেছে : এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, দুই পক্ষের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আইএমএফ রাজস্ব ব্যয় নিয়ে কাজ করবে। এ খাতের সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। কী কী সংস্কার প্রয়োজন, তা নিয়ে আইএমএফ এনবিআরকে কিছু সুপারিশ দেবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। চিঠিতে এনবিআরের কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে বলেও বলা হয়।
চিঠিতে বলা হয়েছে, রাজস্ব ব্যয় একেক দেশে একেক রকম হয়। এনবিআরের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার পর বাংলাদেশের জন্য কোনটা প্রযোজ্য হবে বা কোনটা ভালো হবে, তা নিয়ে একাধিক দল সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করে তা চূড়ান্ত করবে।
চিঠিতে বাংলাদেশের করছাড়ের বিষয়ে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে। এ নিয়ে কর বিশেষজ্ঞদের (এনবিআর ও অর্থ মন্ত্রণালয়) সঙ্গে পৃথক বৈঠকের প্রয়োজন হবে। তা ছাড়া করনীতিসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়েও সহায়তা দেবে আইএমএফ।
সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির তুলনায় কর আহরণ কম হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে আয়কর, মূল্য সংযোজন কর-ভ্যাট ও আমদানি শুল্কে ব্যাপক ছাড় দেওয়া। এসব সুবিধা কমিয়ে আনলে রাজস্ব আদায় বাড়বে।
যেসব খাতে কর ছাড় দেওয়া আছে : দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্পে, জরুরি স্বাস্থ্যসেবায়, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা মেটাতে, কৃষি খাত রক্ষায়, বেসরকারি শিল্প সুরক্ষায় ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে শুল্ক-কর ছাড়সহ নানা সুবিধা দিচ্ছে সরকার। বাংলাদেশের কর জিডিপি না বাড়ার এটি অন্যতম কারণ। দেশে বর্তমানে কর-জিডিপি ৯ শতাংশ। এটি দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। সরকার কর অব্যাহতি না দিলে কর-জিডিপি ১৭.৮১ শতাংশ হতো।
রাজস্ব বোর্ড কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেসব ক্ষেত্রে কর অব্যাহিত বা মওকুফের সুবিধা দেওয়া হয়, তার একটি তালিকা আছে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায়ও এসংক্রান্ত তালিকা দেওয়া হয়।
এতে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি কর ছাড় দেওয়া হয়েছে মেগাপ্রকল্পে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ চলমান বিভিন্ন বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা রকম ছাড় দেওয়া হয়েছে চলতি বাজেটে। মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ, কাঁচামাল আমদানিতে কর অব্যাহতির সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার অধীনে বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পও কর অব্যাহতির সুবিধা ভোগ করছে। আবার যাঁরা পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ পান তাঁদের বেতন-ভাতা বা আয় করমুক্ত বলা হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি কর সুবিধা পাচ্ছে বিদ্যুৎ খাত। এ খাতের সব বড় প্রকল্পই কর অব্যাহিত ভোগ করছে। অবকাঠামো খাতের বড় প্রকল্পগুলো একই রকম সুবিধা পাচ্ছে।
বেসরকারি খাতেও ছাড় দেওয়া হচ্ছে। দেশের অনেক খাতকে প্রতিষ্ঠিত করতে এই কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এসব খাতের মধ্যে মোটরসাইকেল, মোবাইল, কম্পিউটার, ওয়াশিং মেশিন, কম্প্রেসর, লিফট ও মাইক্রোবাস অন্যতম। এসব খাতে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া তথ্য-প্রযুক্তি খাত, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, কৃষি খাতে বিভিন্ন পণ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পসহ আরো প্রায় ১০০টি পণ্যে কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল কর অব্যাহতিকে কর-জিডিপি বাড়ানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, দেশের চলমান উন্নয়নকে টেকসই করতে কর-জিডিপি বাড়ানোর বিকল্প নেই। কর-জিডিপির উন্নতিতে কর অব্যাহতি অন্যতম বড় প্রতিবন্ধকতা।
করছাড়ের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে মন্ত্রণালয়গুলোকে চিঠি দিয়েছিল এনবিআর : এনবিআর মনে করে, প্রকল্পসহ বিভিন্ন খাতে কর অব্যাহতি দেওয়া এক ধরনের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এটি রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর পথে বাধা হিসেবে কাজ করছে। দেশে জিডিপির তুলনায় কর অনুপাত অত্যন্ত কম।
গত এপ্রিল মাসে রাজস্ব আয় বাড়াতে মন্ত্রিপরিষদসচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-বিভাগের সচিবদের কাছে চিঠি দেয় এনবিআর। চিঠিতে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘মূলত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে শুল্ক-কর অব্যাহতি আমাদের অবস্থানের উন্নতিতে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। এই কর আদায় করা গেলে প্রকৃত কর-জিডিপি অনুপাত বর্তমানের দ্বিগুণ হবে। ’ তিনি চিঠিতে বলেছেন, ‘উন্নয়ন প্রকল্পে সরাসরি কর অব্যাহতি দেওয়া যাবে না। এর পরিবর্তে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম আমদানির মাধ্যমে শুল্ক-কর পরিশোধ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। যে পরিমাণ শুল্ক-কর পরিশোধ করা হবে, পরে তা ফেরত দেওয়া হবে। এ জন্য প্রতিবছর বাজেটে আলাদা বরাদ্দ রাখা যেতে পারে। প্রকল্প প্রণয়নের সময় যে ব্যয় প্রাক্কলন করা হবে, তার সঙ্গে শুল্ক ও কর বাবদ কত লাগবে, তা একসঙ্গে যুক্ত করে মোট ব্যয় নির্ধারণ করতে হবে। বর্তমানে প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয়ের সঙ্গে শুল্ক ও কর যুক্ত করা হয় না।
এনবিআর কী করছে : এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফের প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসার আগেই এনবিআর কর অব্যাহতি নিয়ে কাজ শুরু করে। কোন কোন খাতে কর অব্যাহতির দরকার, তার একটি তালিকা তৈরির কাজও চলছে। এ তালিকা ধরে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে অপ্রয়োজনীয় খাতকে এই তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হতে পারে। তবে এক অর্থবছরেই কর অব্যাহতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হবে না বলে জানিয়েছেন এনবিআরের কর্মকর্তারা।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, এনবিআরের নিজস্ব হিসাবেই কর অব্যাহতির পরিমাণ আড়াই লাখ কোটি টাকা। রাজনৈতিক অর্থনীতির কারণে এনবিআর রাজস্ব আয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। অনেক অপ্রয়োজনীয় খাতে কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। সংসদ সদস্যদের অনেকেই ব্যবসায়ী হওয়ায় তাঁরাও করছাড়ের সুবিধা নিচ্ছেন।
নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, গার্মেন্টের মতো খাতকে অঢেল সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন। তাই কর অব্যাহতি খাতে কতটুকু সংস্কার আনা যাবে, তা নিয়েও কথা আছে। তবে সরকার যদি পুরো রাজস্ব খাতে সংস্কার করে, তাহলে খুবই ভালো হবে।