পাড়া-মহল্লায় আতঙ্ক
ঢাকা মহানগরী আওয়ামী লীগ ও যুব লীগে দলীয় পদ পেতে জোর তৎপরতা শুরু হয়েছে। মাঠ গরম করা ও নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে ইতোমধ্যে এলাকায় ফিরেছে পলাতক ও বিতর্কিত নেতারা। এসব বিতর্কিতদের কাছে পেয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে রাজধানীর বিভিন্ন ওয়ার্ড ও থানা এলাকার কিশোর গ্যাংসহ পাতি মাস্তানরা। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ওয়ার্ড কমিটি গঠনের উদ্দেশ্যে সম্মেলন সম্পন্ন হয়েছে। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ প্রার্থীদের জীবনবৃত্তান্ত জমা নিয়েছেন মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ। শীঘ্রই ঘোষণা হতে পারে এ দুই পদের ব্যক্তিদের নাম। মহানগরের কমিটি গঠনকে সামনে রেখে লবিং, তদবীরসহ বিভিন্নভাবে টাকা উড়াচ্ছেন পদ প্রত্যাশীরা। বিতর্কিতরা ফিরে আসায় ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এক ধরনের অজানা আতঙ্ক ভর করছে।
মতিঝিলের ফকিরাপুলের ব্যবসায়ী এমদাদ হোসেন বলেন, গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে দেশ-বিদেশে পালিয়ে থাকা নিষিদ্ধ ক্যাসিনোকাÐের অন্যতম হোতা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বহিস্কৃত কাউন্সিলর ও ঢাকা দক্ষিণ যুব লীগের বহিস্কৃত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন। তিনি দেশে আসার খবর ছড়িয়ে পড়ায় ফকিরাপুল, মতিঝিল, আরামবাগ ও দিলকুশা এলাকায় এক ধরনের অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। এমদাদ বলেন, গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে সাঈদ ফিরে এসেছেন। এখন হয়তো ক্লাবগুলোতেও পুরোনো কার্যক্রম শুরু হয়ে যাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৩০ জানুয়ারি তিনি নিজের বিরুদ্ধে ক্যাসিনো মামলায় আগাম জামিন পেতে হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন সাঈদ। কিন্তু তার করা পৃথক আগাম জামিনের আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবে তাকে দুই সপ্তাহের মধ্যে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বহুল সমালোচিত ও ক্যাসিনো সাঈদ নামে পরিচিতি পাওয়া সাবেক এ কাউন্সিলর পলাতক থাকলেও মতিঝিল, ফকিরাপুল-আরামবাগসহ আশপাশের এলাকায় তিনি এক আতঙ্কের নাম। তার দেশে ফেরার খবরে ৯ নং ওয়ার্ডের সর্বত্রই আতঙ্ক বিরাজ করছে। ক্যাসিনোকাÐে আওয়ামী যুব লীগের প্রায় ডজনখানেক প্রভাবশালী নেতা পদ হারিয়েছেন, জেলের ঘানি টানছেন এবং পালিয়েছেন অনেকে। কিন্তু সাঈদ পলাতক থেকেও গত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্ধন্দিতা করেছেন। প্রার্থী ছিলেন তার স্ত্রী বৈশাখী সাঈদও। অবৈধভাবে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা উপার্জনের অভিযোগে সাঈদের নামে দুদকে মামলা থাকার পরেও তার প্রার্থীতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন দেখা দেয় তখন। মানিলন্ডারিং মামলায় সিআইডি তাকে সহ নয় জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়। সাঈদের বন্ধু আবুল কাশেম প্রতিদিন পাঁচ লাখ টাকা দেওয়ার বিনিময়ে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব হল রুম ভাড়া নেন। সাঈদের ব্যবস্থাপক আসামি সালাউদ্দিন প্রতিদিন ওই ক্লাব থেকে মমিনুল হক সাঈদের জন্য পাঁচ লাখ টাকা নিতেন। অভিযোগপত্রে আরো বলা হয়, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনার মাধ্যমে ১২ কোটি টাকা আয় করেন আসামি মমিনুল হক সাঈদ। বিতর্কিত সাঈদ আওয়ামী লীগে পদ পেতে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। দ্বারস্থ হচ্ছেন অনেক প্রভাবশালী নেতাদের কাছে। এলাকায় বিচরণ করলেও পুলিশ তাকে গ্রেফতার করছে না।
জানা গেছে, মহানগরীতে পদপ্রত্যাশীদের অনেকেই ভ‚মি দস্যূ, জুয়ারী কিংবা বিতর্কিত। যাদেরকে তৃণমূল পর্যায়ের নেতা এবং সাধারণ জনগণ বিষফোঁড়া মনে করেন।
ডেমরা থানাধীন ৬৪ নম্বর ওয়ার্ড থেকে সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশীদের মধ্যে একজন মো. সোহেল খানের বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। রয়েছে হত্যা মামলাও। ২০০৩ সালে মাতুয়াইল, কোনাপাড়া এলাকার বাসিন্দা নাদিম ও তার বন্ধু তাজেল ওরফে তাজুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপায় সোহেল খান ও তার লোকজন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর তাজেল মারা যায়। এ ঘটনায় নাদিমের বাবা সোহেল খানকে প্রধান আসামী করে ৫ জনের বিরুদ্ধে ডেমরা থানায় মামলা করেন। সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে মামলাটি ঢাকা মহানগর বিশেষ দায়রা জজ ও দ্রæত বিচার ট্রাইবুনাল-৩ এ বিচারাধীন। কোনাপাড়ার স্থানীয়বাসিন্দা এবং যুব লীগ কর্মী ফোরকান মিয়া বলেন, সোহেল দলীয় পদ পেতে বিস্তর টাকা ওড়াচ্ছেন। ফোরকানসহ এলাকার অনেকের মন্তব্য, সোহেল খান নেতৃত্বে এলে তৃনমূলে অসন্তোষ বিরাজ করবে।
একইভাবে ৬০ নং ওয়ার্ডের সভাপতি প্রার্থী লুৎফর রহমান রতনের বিরুদ্ধে স্বর্ণচোরাচালান মামলা ও স্কুলে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ৬১ নং ওয়ার্ডের সভাপতি প্রার্থী বদরুদ্দিন সানা গত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। ৫৮ নং ওয়ার্ডের মারুফ হোসেন মামুনের বিরুদ্ধে রয়েছে সন্ত্রাসী কার্যক্রমসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ।
এদিকে ঢাকা উত্তরের ৩৩ নং ওয়ার্ডের অপসারিত সাবেক কাউন্সিলর রাজীব দীর্ঘদিন জেলে থাকার পর মাস দুয়েক আগে জামিনে মুক্তি পায়।মোহাম্মদপুর সাতমসজিদ রোড় মার্কেটের ব্যবসায়ী এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কর্মী মিঠু জানান, চাঁদাবাজি আর দখলবাজির টাকায় হঠাৎ বড়লোক হওয়া রাজীব এখন মোহাম্মদপুরের নিজ এলাকায় কম যাতায়াত করলেও পদ পেতে তিনি জোর লবিং করছেন। তিনি ছিলেন মোহাম্মদপুর থানা যুব লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। দুদকের মামলায় তিনি গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘদিন কারাবন্দি ছিলেন।
মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী শরীফ, ফয়সাল কালাচানসহ একাধিক ব্যক্তি বলেন, ২৯ নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন সামিউল আলিম চৌধুরী। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের চাঁদাবাজি ও দখলের অভিযোগ রয়েছে। নিজের লাইসেন্স করা অস্ত্র দিয়ে সাধারণ মানুষদের ভয়-ভীতির প্রতিবাদে এর আগে তার বিরুদ্ধে একাধিকবার বিক্ষোভ মিছিল করেন এলাকাবাসী।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মিরপুর পল্লবীর ৬ নং ওয়ার্ডের যুব লীগ কর্মী সবুজ ও বিপ্লব জানিয়েছেন, ৬ নং ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর ও মহানগর যুব লীগের বহিস্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক তাজুল ইসলাম বাপ্পির বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। তিনি দলের স্বার্থে নয়, নিজের স্বার্থে রাজনীতি করেন। সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাজুল ইসলাম বাপ্পি ছিলেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী তাজুল ইসলাম বাপ্পি বোমা হামলার চার্জশীটভ‚ক্ত আসামি বলে জানা গেছে।
পল্লবী ২ নং ওয়ার্ডের সভাপতি প্রার্থী কদম আলী মাতব্বরের বিরুদ্ধে সরকারি ড্রেন ও রাস্তা দখল করে পাকা দোকান তৈরি করাসহ মুসলিমবাজার মার্কেট কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদ বাগিয়ে ফুটপাতে চাঁদাবাজিসহ বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড থেকে বলা হয়েছে, চার্জশিটভ‚ক্ত আসামিসহ বিতর্কিতদের কমিটিতে পদ পাওয়া বা সদস্য হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।