কী জাদু আছে নীল চোখে
ডেস্ক রিপোর্ট : নীল নয়নার বন্দনা বাংলা গানে, কবিতায় অনেকবারই উঠে এসেছে। ভারতীয়দের চোখ কখনো নীল ছিল না। এখানে মেয়েদের চোখ তালপুকুরের জলের মতো গভীর কালো। সেখানে মোটা করে টানা কাজল গভীরতা আরো বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু কীভাবে এখানকার কবিরা নীল নয়নার প্রেমে পড়লেন সেটার খোঁজ করতে গেলে হয়ত উপনিবেশ শাসন এবং বর্ণবাদের হদিস করতে হবে। তারপরও এই চোখের রহস্য নিয়ে দু’চার কথা না বললেই নয়।
অনেকের ধারণা ‘নীল চোখ’ হলো সৌন্দর্য এবং আন্তরিকতার প্রতীক। এটা প্রথম দিকে ইউরোপের শিকার-সংগ্রহ যুগের কৃষ্ণকেশীদের মধ্যে দেখা যায়। শীতপ্রধান অঞ্চলেই চোখের এ রঙ বেশি দেখা যায়।
‘নীল চোখ’ দেখতে একেবারে সমুদ্রের পানির মতো। ওই চোখের আকর্ষণে হারিয়ে যায় মানুষ। তবে যাদের নীল চোখ রয়েছে তাদের অনেক সময় নেকড়ে বাঘের মতো ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ করে উপস্থাপন করা হয়। আবার তাদের শীতল প্রকৃতিরও মনে করা হয়।
মূলত ৭ হাজার বছর আগে ইউরোপে বসবাস করা শিকার ও সংগ্রহ সমাজের মানুষেরা কালো ত্বক, কালো চুল এবং নীল চোখের অধিকারী ছিল। এই আবিষ্কারটি মূলত উত্তর-পশ্চিম স্পেনে পাওয়া কঙ্কালের জেনেটিক পরীক্ষার মাধ্যমে করা হয় যা বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছিলেন যে, আদি ইউরোপীয়দের ত্বক সাদা ছিল এবং তাদের নীল চোখ ছিল।
নীল চোখের প্রতি মানুষের আকর্ষণের বিষয়টি দ্বৈত। একটা হলো- নীল চোখকে সৌন্দর্যের আদর্শ মনে করা হয়। এবং এটা হলো একটা মিথ (বদ্ধমূল ধারণা) যা পৃথিবীর সর্বত্র ছড়ানো। অন্যটি হলো- নীল চোখকে মনে করা হয় শীতল এবং কিছু সংস্কৃতিতে তারা অভিশাপ বয়ে আনতে পারে বলে মনে করা হয়। কৃষিপ্রধান সমাজে নীল চোখকে শয়তানের চোখ মনে করা হতো।
প্রটোট্রপিকাল নাৎসি বাহিনীর সোনালী চুল ও নীল চোখ ছিল। এ কারণেই জার্মানিতে হিটলারের ভয়ঙ্কর উত্থান ও পতনে নীল চোখ ফ্যাসিজম, গণহত্যা এবং খুন করার ক্ষমতার প্রতীক হয়ে উঠে।
অনুরুপভাবে ঔপনিবেশিক ইউরোপীয়দের জন্য ‘নীল চোখা শয়তান’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। যারা সোনা এবং দাসদের খোঁজে সারা বিশ্ব চষে বেড়িয়েছে। তা সত্ত্বেও ওই শয়তানদের নীল চোখকে ভালো মনে করা হতো। সেটা হয়ত একটা বর্ণবাদ এবং শাসিতদের মধ্যে হীনমন্যতার চেতনা থেকে উৎসারিত।
অন্তত তেমনটাই মনে করেন আমির রহমান। তার মতে, এ ধরনের বিষয়গুলো বিপরীত ধরনের বর্ণবাদ। কারণ পৃথিবী যা কিছু পছন্দ করে তা মূলত কালো এবং বাদামী মানুষদের দ্বারা নির্ধারিত ছিল। তিনি আফ্রিকা এবং এশিয়ার বাঙালিদের মধ্যে আদর্শ সৌন্দর্য নির্ণয়ের জন্য ‘white people to coloured peoples’ শিরোনামে একটি কাজ করেন। তিনি তার গবেষণায় দেখান যে, তারা নিজের শরীরের রঙ, চোখ এবং চুলের প্রতি অতিমাত্রায় যত্নশীল।
ঔপন্যাসিক টনি মরিসন ‘The Bluest Eye’ উপন্যাস লিখেছেন, একজন অল্প বয়সী কালো মেয়ে নিজেকে খুব ঘৃণা করছে। আর এই ঘৃণার পেছনে যে কারণটি রয়েছে তা হলো তার কালো ত্বক। সে নীল চোখের স্বপ্ন দেখতো। কারণ, সে মধ্যপশ্চিম আমেরিকাতে বসবাস করতো। যেখানকার মানুষ নীল চোখকে পছন্দ করতো। এ ধরনের বিষয়গুলো ফ্যাসিজম এবং ঔপনেবেশিক নীপিড়নের বিষয়ে নীল চোখের সম্পৃক্ততাকে প্রমাণ করে।
লেখক পিটার ওটুলস নীল চোখের সৌন্দর্য, অসভ্যতা এবং বিপদ সম্পর্কে একটা পংক্তি লিখেছেন। পিটার লরেন্স অব অ্যারাবিয়ার নীল চোখ নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, তারা ভয়ঙ্কর হলেও খুব সুন্দর। একেবারে নেকড়ের চোখের মতো।
হোমারের ওডেসির সময়ে দেবী এথেনার নীল চোখের ঝলকানি ছিল। তিনি অনেক সুন্দর ছিলেন কিন্তু একই সঙ্গে ভয়ঙ্করও ছিলেন।
তবে এই নেতিবাচক ধারণাগুলো কখনোই নীল চোখের ইতিবাচক দিকগুলোকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। নীল চোখের উদযাপনকে থামাতে পারবে না।
ভারতের উড়িশ্যায় কালো বর্ণের কিছু নীল চোখওয়ালা মানুষ রয়েছে। যাদের কথা অবশ্যই স্মরণীয়। কারণ তারা মানুষের উপকারে কখনো পিছপা হয় না।
শুধু ভারতেরই নয় পাকিস্তানের খায়বারের মানুষরাও অনেক উপকারী। যদিও তাদের হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হারিয়ে যাওয়া রেজিমেন্টের উত্তরসূরী বলে মনে করা হয়।
তবে নীল চোখ একাকীত্ব আর বিষণ্ণতারও প্রতীক। যেমন, বব ডিলান প্রিয় সন্তান হারা এক পিতার হয়ে বলেছেন, ‘ও আমার নীল চোখের ছেলে, তুমি কোথায় ছিলে’।
তবে যাই হোক, কালো ত্বক এবং নীল চোখের এই সমন্বয় আদী ইউরোপীয়দের কাছ থেকে এসেছে বলেই মনে করা হয়। এই সমন্বয়টা মূলত আমাদের মধ্যে বিভাজন না করে বরং একত্রিত করে।