বিতর্কে নারী ডিসি-ইউএনও
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’ (কাজী নজরুল ইসলাম)। জাতীয় কবির ‘নারী’ কবিতার এই পঙক্তি বাংলা ব্যাকরণে ‘ভাব সম্প্রসারণ’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সত্যিই দেশের নারীরা আগের চেয়ে অনেকদূর এগিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতির শীর্ষে থেকে নারীরাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। নারীরা এখন সেনা-বিমান-নৌ বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর উচ্চপদে কাজ করছেন। বিমানের পাইলট থেকে শুরু করে ট্রেনের ড্রাইভার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, শিক্ষকতা সবখানেই নারীরা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। প্রশাসনে সচিব থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা কাজ করছেন। কিন্তু সব সেক্টরে নারীরা কি সফল হচ্ছেন?
প্রশাসনের মাঠ পর্যায় তথা জেলা, উপজেলায় কর্মরত কয়েকজন নারী কর্মকর্তা তথা ডিসি, ইউএনও, বিচারকের বিতর্কিত কর্মকা- নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের প্রশাসনের সর্বোচ্চ চেয়ারে কর্মরত ওই সব নারী কর্মকর্তার (ডিসি-ইউএনও-বিচারক) প্রশাসনিক কর্মদক্ষতা এবং প্রশাসন চালানোর পারদর্শিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রংপুরের ডিসিকে ‘স্যার’ সম্বোধনের দাবি, কুড়িগ্রামে ডিসির গভীর রাতে আদালত বসিয়ে সাংবাদিককে ‘কারাদ-’, নেত্রকোনার কালমাকান্দায় ইউএনওকে স্যার না বলায় ছাত্রকে হেনস্তা, মানিকগঞ্জের ইউএনওকে ‘আপা’ বলায় ব্যবসায়ীকে ‘লাঠিপেটা’ জামালপুরের সরিষাবাড়ীর ইউএনও’র অপসারণ দাবিতে ‘ঝাড়ু মিছিল’, বগুড়ায় মেয়ের সহপাঠী ছাত্রীর মাকে বিচারকের ‘পা’ ধরতে বাধ্য করাসহ অসংখ্য বিতর্কিত কর্মকা- নিয়ে বিতর্ক চলছে। এসব ঘটনায় সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। প্রশাসনের উচ্চপদে পুরুষের মতো নারীরা দক্ষ কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
মাঠ প্রশাসনের নারী কর্মকর্তাদের বিতর্কিত কর্মকা- নিয়ে গণমাধ্যমে বিতর্ক এবং সমালোচনার ঝড় বইছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নেটিজেনদের কেউ মন্তব্য করছেন, নারী কর্মকর্তারা প্রশাসন চালাতে খেই হারিয়ে ফেলছেন। কেউ লিখেছেন, কোটা পদ্ধতি এবং দলীয় বিবেচনায় কম দক্ষদের সরকারি চাকরির উচ্চপদে বসানোয় এমন অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। তবে অনেকেই বলছেন, নারী ডিসি, ইউএনও, বিচারকদের এমন কর্মকা- বার্তা দেয় প্রশাসন পরিচালনার দক্ষতায় নারীরা এখনো পুরুষের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারেননি।
রংপুরের ডিসিকে ‘স্যার’ বলতে বাধ্য করা বা বগুড়ায় বিচারকের ‘পা’ ধরতে বাধ্য করার ঘটনায় বিতর্ক এখনো চলছে। তবে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সম্পর্কে সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে। সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালায়-২০১৮, নাগরিকদের সঙ্গে যেকোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য হবে’। তবে সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালায় ৩৪টি নির্দেশনা আছে, কিন্তু সেখানে জনগণ বা সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে আচরণের বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। বিশেষ করে সম্বোধনের বিষয়ে কিছু বলা নেই। সে কারণে হয়তো মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আচরণের বিষয়টি বাড়াবাড়ি হচ্ছে।
প্রশাসনের কর্মকর্তারা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ততা, ক্ষমতার অপব্যবহার, গণজমায়েত করা, তথ্য প্রকাশে কঠোরতা, নারী সহকর্মীর সঙ্গে আচরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। গত ১২ মার্চ আচরণ বিষয়ে আলাদা কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
সরকারি কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বলা নিয়ে চলমান বিতর্কের মধ্যে আলোচনায় এসেছে ৪৪ বছর আগে প্রণীত সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯। ২০০২ ও ২০১১ সালে দুই দফায় এই বিধিমালা সংশোধন করা হয়। ২০১৪ সালে আবার এই বিধিমালা সংশোধনের কাজ শুরু হয়। ৯ বছরে বিধিমালার একটা খসড়া তৈরি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তবে এখনো তা চূড়ান্ত করা হয়নি। এই খসড়ায়ও সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে আচরণ বা সম্বোধনের বিষয়ে কিছু বলা নেই। সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালায় ৩৪টি নির্দেশনা আছে, কিন্তু সেখানে জনগণ বা সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে আচরণের বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। বিশেষ করে সম্বোধনের বিষয়ে কিছু বলা নেই। দেশে সরকারি সেবা নিতে গিয়ে কিংবা বিভিন্ন কারণে দায়িত্বে থাকা কোনো কোনো সরকারি কর্মকর্তার আচরণ কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ নতুন নয়। সাম্প্রতিক সময়ে এরকম বেশ কয়েকটি ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনাও দেখা যায়।
জানা গেছে, প্রশাসনে নারীদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। সরকারি চাকরিতে নারীরা আগের তুলনায় বেশি আসছেন। নীতিনির্ধারণী পদগুলোতেও নারীদের উপস্থিতির হার বাড়ছে। বর্তমানে প্রশাসনে সিনিয়র সচিব, সচিব ও সমপদমর্যাদার ৮৫ জন কর্মকর্তার মধ্যে নারী রয়েছেন ১০ জন। সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়ে নারীরা মন্ত্রণালয়, বিভাগ কিংবা অন্য কোনো সরকারি দপ্তর সামলাচ্ছেন। একই সঙ্গে ৬৪টি জেলার মধ্যে ১০ জন নারী জেলা প্রশাসক রয়েছেন। ৪৯২টির মধ্যে ১৩৯টি উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) দায়িত্বে আছেন নারী কর্মকর্তারা।
গত বছরের এপ্রিলে নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলায় নারী ইউএনওকে স্যার না বলায় থানার ওসি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে হেনস্তা করেন। ওই বছরের ৯ জুলাই মানিকগঞ্জে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুনা লায়লাকে ‘ম্যাডাম’ না বলে ‘আপা’ বলায় ব্যবসায়ী তপন চন্দ্র দাসকে লাঠিপেটা করে তাঁর সঙ্গে থাকা পুলিশ। গত জানুয়ারি মাসে জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) উপমা ফারিসার অপসারণ দাবিতে ঝাড়ু মিছিল, বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে নাগরিক কমিটি। বিক্ষোভ সমাবেশে অভিযোগ করা হয়, ইউএনও উপমা ফারিসা ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট সরিষাবাড়ীতে যোগদানের পর থেকে টিআর, জিআর, কাবিখা, এডিপি, এলজিএসপিসহ উপজেলা পরিষদের সরকারি বরাদ্দে নানা অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার ও প্রকাশ্য ঘুষ বাণিজ্য করে আসছেন। দুর্নীতির আলামত নষ্ট করতে গত বছরের ১৬ এপ্রিল সকালে ইউএনওর কার্যালয়ে অগ্নিকা- ঘটানো হয়। পরে ঘটনাটি তদন্ত কমিটির মাধ্যমে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট হিসেবে প্রকাশ করেন।
কুড়িগ্রাম জেলায় জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন ক্ষমতার অপব্যবহার করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এস এম রাহাতুল ইসলাম দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত (মোবাইল কোর্ট) সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানকে কারাদ- দেন। পরে এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে ডিসি ক্ষমাপ্রার্থনা করেন।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ক্যারিয়ার প্ল্যানিং ও প্রশিক্ষণ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. সহিদউল্যাহ বলেন, ফাউন্ডেশন কোর্স মূলত কর্মকর্তাদের সার্বিক আচার-আচরণ সম্পর্কিত। কোনো নাগরিককে কষ্ট দেবেন না। এর পরও মাঠ প্রশাসনে সমস্যা হয়ে যায়। কারণ তিন থেকে ছয় মাসের প্রশিক্ষণে কিছু হয় না। এ জন্য রিফ্রেশার কোর্স চালু করতে হবে।
সম্প্রতি ‘স্যার’ না বলায় রংপুরের জেলা প্রশাসকের (ডিসি) ক্ষুব্ধ আচরণের শিকার হয়েছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। প্রতিবাদে তিনি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচিও শুরু করেছিলেন। ডিসি চিত্রলেখা নাজনীন দুঃখ প্রকাশ করে ওই ঘটনার ইতি টানার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিতর্ক এখনো থামেনি।
২০২১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দায়িত্বরত এক চিকিৎসককে ‘স্যার’ না ডেকে দাদা ডাকায় এক স্ট্রোকের রোগীকে চিকিৎসা না দেয়ার অভিযোগ ওঠে। বছর কয়েক আগে যশোরে একজন কৃষি কর্মকর্তাকে ‘স্যার’ না বলায় ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি অফিস থেকে চার সাংবাদিককে বের করে দিয়েছিলেন। এসব ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।
মাঠ প্রশাসনে কর্মরত নারী কর্মকর্তাদের কয়েকজনের অদূরদর্শী কর্মকা- নিয়ে বিতর্ক উঠলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, সরকারি সেবা নিতে আসা লোকজনকে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বলে সম্বোধন করতে হবে, এমন কোনো নীতি নেই। যদি কোনো সরকারি কর্মকর্তা জনসাধারণের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন তবে তা দুর্নীতির শামিল। জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, বিদেশে সরকারি কর্মকর্তা ও মন্ত্রীদের নাম ধরে ডাকে (নাগরিকরা)। এ দেশেও এই সংস্কৃতি শুরু করে সবাইকে নাম ধরে ডাকা উচিত। এটাই আন্তর্জাতিক চর্চা। এটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। তবেই এ সমস্যার সমাধান হবে।