প্রস্তুত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর’ ঘিরে বিশাল ব্যাপ্তিতে শিল্পায়নে স্বপ্নের বাস্তব রূপায়ন ঘটতে চলেছে। চট্টগ্রামের মীরসরাই ও সীতাকু-, ফেনী জেলার সোনাগাজী মিলে প্রায় ৩৩ হাজার একর বিস্তীর্ণ জায়গায় গড়ে উঠছে দেশের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক জোন। যা এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ এবং বিশে^র ‘মডেল ইকোনমিক জোন’ হিসেবে আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায়। মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের সাথে লাগোয়া মীরসরাই সমুদ্র উপকূলে একটি কন্টেইনার বন্দর স্থাপন করা হবে। তাছাড়া মীরসরাই-সীতাকু–চট্টগ্রাম হয়ে দক্ষিণে কক্সবাজারমুখী মেরিন ড্রাইভওয়ের সাথে যুক্ত হবে এই শিল্পনগর। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক জোন কর্তৃপক্ষ (বেজা) বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের অবকাঠামো সুবিধাদি নির্মাণ করছে। এর পাশাপাশি চলছে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে শিল্প-কারখানা স্থাপনের কাজ।
তবে দেশে চলমান দীর্ঘমেয়াদি ডলার সঙ্কটের প্রবল ধাক্কা এসে পড়েছে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের অবকাঠামো নির্মাণ কাজের ক্ষেত্রেও। ব্যাহত হচ্ছে অবকাঠামো বাস্তবায়ন। বিনিয়োগকারী ও শিল্পোদ্যোক্তাগণ বলছেন, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে শিল্প, কল-কারখানা স্থাপনের জন্য অপরিহার্য অবকাঠামো নির্মাণ কাজে ধীরগতি ও সময়ক্ষেপণ কাটেনি। এর মধ্যে রয়েছে ভূমি উন্নয়ন, মাটি ভরাট, অভ্যন্তরীণ সংযোগ সড়ক ও রাস্তাঘাট, শিল্প প্লট তৈরি, চাহিদা মাফিক গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, ড্রেনেজ ও পয়োঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন ধরনের ইউটিলিটি সার্ভিস এবং অপরিহার্য অবকাঠামো সুবিধাদির কাজ। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সরবরাহের নিশ্চয়তা এবং পরিকল্পিত পূর্ণাঙ্গ অবকাঠামো সুবিধা চান শিল্পোদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীরা।
এমনিতেই কাজের গতি ছিল কিছুটা ধীরলয়ে। তার ওপর দেশে চলমান ও সুদূরপ্রসারি ডলার সঙ্কটের প্রভাবে অবকাঠামো স্থাপনের কাজ কম-বেশি ব্যাহত হচ্ছে। সবধরনের অবকাঠামো খাতে গিয়ে পড়েছে ডলার সঙ্কটের ধকল। কেননা শিল্প স্থাপনে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ, যন্ত্রাংশ ও উপকরণ, কাঁচামাল আমদানি, এলসি খোলাসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটাতে ডলারের যোগান মিলছে না। তাছাড়া ডলার সঙ্কটের সাথে পাল্লা দিয়ে সিমেন্ট, রডসহ স্টিল ও লোহাজাত নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে নির্মাণকাজে ভাটা পড়েছে। সবকিছু মিলিয়ে শিল্পনগর পরিকল্পিত সব রেডি শিল্পপ্লটসহ পরিপূর্ণ অবয়ব পেতে বিলম্ব ঘটছে।
এ প্রসঙ্গে অভিমত জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধাসমূহ বাস্তবায়ন কাজ খুবই ধীরগতিতে চলছে। এ কারণে বর্তমানে এই শিল্পনগরটি শিল্পোদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের মাঝে তেমন সাড়া জাগাতে পারছে না। তারা অবকাঠামো সম্পন্ন হওয়ার জন্য অপেক্ষা করেই আছেন। অবকাঠামো কাজের গতি অত্যন্ত ধীর হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো ডলার সঙ্কট। ডলার সঙ্কটের বিরূপ প্রভাবের ফলে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরসহ দেশের বিভিন্ন প্রকল্পের অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ কম-বেশি ব্যাহত হচ্ছে। তিনি জানান, ডলার সঙ্কট মোকাবেলা করতে হলে সরকারকে কঠোরভাবে হুন্ডি রোধ করতে হবে। কেননা হুন্ডি চ্যানেলে আমাদের বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা প্রতিনিয়ত পাচার হয়ে যাচ্ছে।
দেশের একশ’টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে একক বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। ৩০টি জোনে বিভক্ত এই শিল্পনগর। সেখানে বর্তমানে ভূমি উন্নয়ন, সংযোগ সড়ক রাস্তাঘাট নির্মাণ, মাটি ভরাট, পানি-গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার কাজ চলছে। তবে প্রায় সবকিছুই চলছে আগের তুলনায় ধীর গতিতে। এই শিল্পনগরে ‘এ’ থেকে ‘এল’ পর্যন্ত শিল্প এলাকার ১২টি ব্লক রয়েছে। তবে আপাতত ‘এফ’ ব্লকে হালকা ও মাঝারি শিল্প স্থাপনের উপযোগী অভ্যন্তরীণ সংযোগ সড়ক, রাস্তাঘাট, গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ এবং অন্যান্য অবকাঠামো সুবিধা সৃজন করে দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এ শিল্পনগরে শিল্পোদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীরা ১০ বছরের জন্য শতভাগ আয়কর রেয়াত পাচ্ছেন। তাছাড়া বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি ব্যবহারের ওপর ৮০ শতাংশ হারে ভ্যাট মওকুফ সুবিধা দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশি ও বিদেশি ১৫০-এরও বেশি প্রতিষ্ঠানকে শিল্প প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে প্রাথমিকভাবে উৎপাদন শুরু করেছে মাত্র দশটির মতো প্রতিষ্ঠান। প্লট বুঝে নিয়েও যৌক্তিক সময়ের মধ্যে শিল্প-কারখানা স্থাপনে ব্যর্থ এমন প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দ বাতিলের পদক্ষেপ নিয়েছে বেজা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে এ যাবৎ দুইশ’রও বেশি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে। এদের সঙ্গে প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি হয়েছে। এ শিল্পনগর কোম্পানীগঞ্জ ও সন্দ্বীপ পর্যন্ত সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিদেশি এবং বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকে আকৃষ্ট করেছে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর। দেশি-বিদেশি শিল্প জায়ান্টরা বিনিয়োগ ও শিল্পায়নে এগিয়ে এসেছে।
শিল্পনগরের ৩৩ হাজার একর জায়গায় পর্যায়ক্রমে ৩০ থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। প্রথম ধাপে ৭ লাখ, প্রকল্প সম্পন্ন হলে ১৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের টার্গেট রাখা হয়েছে। এখানে ভারতীয় বিনিয়োগকারীরা প্রায় এক হাজার একর জমিতে শিল্প স্থাপন করবে। বেপজার বিশেষায়িত ইপিজেজেড নির্মিত হবে সোয়া এক হাজার একর জমিতে। বেশিরভাগই হচ্ছে রফতানিমুখী শিল্প। সরাসরি শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই), বেসরকারি উদ্যোগ এবং যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাব আসা অব্যাহত আছে।
শিল্পে বিনিয়োগকারীরা টেক্সটাইল, গার্মেন্টস ও নীটওয়্যার, ইস্পাত ও লোহাজাত শিল্প, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত, পাটজাত শিল্প, চামড়া শিল্প, রাসায়নিক, প্লাস্টিক ও মেলামাইন, স্পোর্টস সামগ্রী, খেলনা, সাইকেল, বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জাম, ওষুধ, মেডিকেল সামগ্রী, কন্টেইনার ম্যানুফ্যাকচারিং, ভোজ্যতেল, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, হাইব্রিড গাড়ি, মোটরযান ও অটোমোবাইল, আইটি, বিভিন্ন সেবাখাতের পণ্যসামগ্রী উৎপাদনের উপযোগী শিল্প-কারখানা স্থাপনে আগ্রহ ব্যক্ত করছে।