রুদ্ধশ্বাস জয়ে চেন্নাইয়ের হাই-ফাইভ
ম্যাচটা দুলছিল পেন্ডুলামের মতই। শেষ ওভারে চেন্নাই সুপার কিংসের প্রয়োজন ছিল ১৩ রান। টুর্নামেন্ট জুড়ে দুর্দান্ত বল করা গুজরাট টাইটান্স পেসার মোহিত শর্মা প্রথম চার বলে তিনটি ইয়র্কার ও একটি লো-ফুল টসে করে রান দেন কেবল ৩। পঞ্চম বল ইয়র্কারের চেষ্টায় সামান্য গড়বড় হয়ে যায়, স্পটে পেয়ে লং অন দিয়ে ছক্কায় ওড়ান রবীন্দ্র জাদেজা। শেষ বলের আগে আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামের এক লক্ষ তিরিশ হাজার ধারণক্ষমতা সম্পন্ন গ্যালারিতে দর্শকরা তখন চরম উৎকণ্ঠায়, দুই দলের ডাগ-আউটে নিশ্বাস বন্ধ হওয়া অবস্থা। জাদেজার পায়ের ওপর নিচু ফুল টস, ফাইন লেগ দিয়ে চার মেরেই বাঁধনহারা উদযাপনে মেতে ওঠেন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। এরপর তিনি দৌঁড়ে চলে গেলেন তাঁর অধিনায়কের কাছে। কিছুটা রহস্য থেকে গেলেও ধরে নেওয়া যায় এটি মাহেন্দ্র সিং ধোনির পেশাগত জীবনের শেষ ম্যাচ। জাদেজা যেন বুঝানোর চেষ্টা করলেন এই শিরোপাটা তিনি দীর্ঘ দিনের অধিনায়ক ধোনির জন্যই জয় করলেন।
পরশুরাতে আইপিএল ফাইনালে স্বাগতিক গুজরাট টাইটান্স প্রথমে ব্যাটিং করে ২০ ওভারে ৪ উইকেটের বিনিময়ে গড়েছিল ২১৪ রানের পাহাড়-সম পুঁজি। ম্যাচ পুরোটা হলে কাজটা কঠিনই হতো চেন্নাইয়ের জন্য। তবে বৃষ্টির কারণে ওভার ও জয়ের লক্ষ্য দুটিই কমে আসে। ফলে ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে ১৫ ওভারে চেন্নাইয়ের সামনে বেঁধে দেওয়া হয় ১৭১ রানের লক্ষ্য। দলীয় প্রচেষ্টায় ৫ উইকেটে জয় লাভ করে চেন্নাই। এই জয়ের ফলে আইপিএলে সবচেয়ে বেশি শিরোপা জয়ে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের রেকর্ড স্পর্শ করল চেন্নাই, দুই দলেরই পাঁচটি করে। অধিনায়ক হিসেবে রোহিত শর্মার ৫ শিরোপাও স্পর্শ করলেন ধোনি। অন্যদিকে টানা দ্বিতীয় শিরোপা জয়ের আশা চুরমার হয়ে গেল গুজরাটের।
বড় লক্ষ্যে ব্যাটিং করতে নেমে উড়ন্ত সূচনা হয় চেন্নাইয়ের। উদ্বোধনী জুটিতে ৬.৩ ওভারে ৭৪ রান যোগ করেন রুতুরাজ গায়কোয়াড় ও ডেভন কনওয়ে। ১৬ বলে ২৬ রান করে আফগান স্পিনার নূর আহমেদের বলে আউট হন গায়কোয়াড়। ৪ রান পর একই বোলার থামান কনওয়েকেও। এর আগে ২৫ বলে ৪৭ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলেন নিউজিল্যান্ডের বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান। এরপর শিবাম দুবেকে সঙ্গে নিয়ে মারকুটে ব্যাটিং শুরু করেন অজিঙ্কা রাহানে। তবে দুবে প্রথমভাগে সহজাত ব্যাটিং করতে না পারায় রান-বলের ব্যবধান বাড়তে থাকে। এর মাঝেই বিদায় নেন ১৩ বলে ২৭ রান করা রাহানে।
শেষ তিন ওভারে চেন্নাইয়ের দরকার পড়ে ৩৮ রান। মোহিতের ১৩তম ওভার থেকে ১৭ রান পায় চেন্নাই। তবে পেশাগত জীবনের শেষ ম্যাচ খেলতে নামা দুই ব্যাটার অম্বতি রাইডু ও তর্কসাপেক্ষ ধোনিকে এই ওভারেই ফেরান মোহিত। ৮ বলে ১৯ রান করা রাইডুর বিদায়ের পরের বলেই সাজঘরে ফেরেন অধিনায়ক ধোনি। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ম্যাচে অভিষেকের দিনও গোল্ডেন ডাক দেখতে হয়েছিল ধোনীকে। শেষ ২ ওভারে দরকার পড়ে ২২ রান। তবে ১৪তম ওভারে দারুণ বোলিং করেন এবারের আসরের সর্বোচ্চ ২৮ উইকেট শিকারি মোহাম্মদ শামি। ৮ রান খরচা করেন তিনি। শেষ ওভারে জাদেজার সেই বীরোচিত ব্যাটিং। বাঁহাতি এই অলরাউন্ডার ৬ বলে ১৪ রান ও দুবে ২১ বলে ৩২ রানে অপরাজিত ছিলেন।
এর আগে টসে হেরে ব্যাটিং করতে নামা গুজরাট উদ্বোধনী জুটি থেকেই পায় ৬৭ রান। তাদের জুটি ভাঙে এবারের আসরের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক শুভমান গিলের বিদায়ে। ২০ বলে ৩৯ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান কাটা পরেন ধোনীর এক সেকেন্ডের চেয়েও কম সময়ে করা স্টাম্পিংয়ে। যার মাধ্যমে আইপিএলে নিজের ২৫০তম ম্যাচে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ৩০০ ডিসমিসালের মাইলফলক স্পর্শ করেন ধোনি। পুরো আসরজুড়ে আলো ছড়ানো শুভমান ১৭ ম্যাচে ৩টি সেঞ্চুরি ও ৪টি হাফ সেঞ্চুরিসহ ৫৯.৩৩ গড়ে ৮৯০ রান করেছেন, যা আসরের সর্বোচ্চ। একই সঙ্গে এই রান আইপিএলের এক আসরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ২০১৬ আইপিএলে ১৬ ম্যাচে ৪টি সেঞ্চুরি ও ৭টি হাফ সেঞ্চুরিতে ৯৭৩ রান করে শীর্ষে বিরাট কোহলি।
শুভমানের বিদায়ে চাপ বুঝতে হয়নি গুজরাটকে। ঋদ্ধিমানের সঙ্গে যোগ দিয়ে ঝড় তোলেন সাই সুদর্শন। এই জুটি থেকে আসে ৪২ বলে ৬৪ রান। দলীয় ১৩১ রানে থামার আগে ৩৯ বলে ৫৪ রান করেন ঋদ্ধিমান। এরপর হার্দিককে এক পাশে রেখে ২২ গজে সাইক্লোন বইয়ে দেন সুদর্শন। শেষ ওভার পর্যন্ত চেন্নাইয়ের বোলারদের কোণঠাসা করে রেখে ৪৭ বলে ৮টি চার ও ৬টি ছক্কায় ৯৬ রানের ঝলমলে এক ইনিংস খেলেন তিনি। সুদর্শন-হার্দিকের জুটি থেকে মাত্র ৩৩ বলে ৮১ রান পায় গুজরাট। হার্দিক ২১ রানে অপরাজিত ছিলেন।
এটা ধোনীর বিদায়ী ম্যাচ ছিল কিনা সেই ব্যাপারে রহস্য রেখে দিয়েছেন ৪২ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার। ধোনি জানান, ‘এই বছর যেখানেই গেছি, যে পরিমাণ ভালোবাসা ও অনুরাগের ছোঁয়া পেয়েছি, তাতে খুব সহজেই বলে দিতে পারি যে, ধন্যবাদ, অনেক হয়েছে। আরও ৯ মাস কঠোর পরিশ্রম করা এবং আবার ফিরে এসে আইপিএলের অন্তত আর একটি মৌসুম খেলা আমার জন্য কঠিন। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আরও ৬-৭ মাস সময় আছে আমার হাতে। আরেক মৌসুম খেলা হবে আমার তরফ থেকে ভক্তদের উপহার। কাজটি যদিও আমার জন্য সহজ হবে না।’