টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর্দা উঠছে আজ
স্পোর্টস ডেস্ক : আজ স্বাগতিক বাংলাদেশ আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের নতুন সদস্য দেশ আফগানিস্তানের খেলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে শুরু হচ্ছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আসর।
মাত্র ক’দিন আগে ঢাকাতেই শেষ হয়েছে এশিয়া কাপ- যে টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের খেলা অনেক ক্রীড়ামোদীকে বেশ হতাশ করেছে।
এখন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ কি বাংলাদেশের জন্য কোন সুযোগ নিয়ে আসছে? আর টি-টোয়েন্টির যে জনপ্রিয়তা, তাতে কি এমনটা ভাবার কোনো সুযোগ রয়েছে যে এটিই বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ হতে যাচ্ছে?
মিরপুরের শের-এ-বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে শেষ মূহুর্তের প্রস্তুতি চলছে। গ্যালারিতে ধোয়া মোছার কাজ শেষ প্রায়, এরপরই শুরু হবে সাজানো। ষোলটি দলের উপস্থিতিতে শুরু হবে লড়াই।
ক্রিকেট দুনিয়ার বেশ বড় রকমের এই আয়োজনকে ঘিরে বাংলাদেশের ক্রিকেট আয়োজকরা বলছেন তারা সব প্রস্তুতি শেষ করেছেন।
এই আসরকে বেশ গুরুত্বের সাথেই নিয়েছেন তারা। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের একজন পরিচালক মাহবুব আনাম বলছিলেন, এই ইভেন্ট আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, “একটা হলও নিজেরা আয়োজক হিসেবে কিভাবে নিজেদের উপস্থাপন করলাম সে বিষয়টি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে এই সুযোগে নতুন সংযোজন হওয়া আটটি ক্রিকেট মাঠ যা ভবিষ্যতে ক্রিকেটের উন্নয়নে বড় অবদান রাখবে।”
স্বাগতিক বাংলাদেশ এ যাবত অনুষ্ঠিত চারটি টি-টোয়েন্টি বিশ্ব প্রতিযোগিতাতেই খেলেছে এবং ২০০৭ সালে জোহানেসবার্গে প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র জয়টি পায়। সে সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ছয় উইকেটে হারায় বাংলাদেশ।
কিন্তু এর পরের ইতিহাস আবার ভাল নয়। সেই থেকে আজ অব্দি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মোট দশটি খেলা খেলেছে বাংলাদেশ, আর সব কয়টিতেই পরাজয় ছিল সঙ্গী ।
এবারে নিজ দেশের মাটিতে হতে যাচ্ছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের মাটিতে উপস্থিত হয়েছে বাঘা বাঘা সব লড়াকু দল।
ক’দিন আগেই শেষ হলও এশিয়া কাপ। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে কয়েকটি খেলাতে। কিন্তু নিজ মাটিতে হলেও এশিয়া কাপের কোন খেলাতেই জয় পায়নি বাংলাদেশ। এবারে টি-টোয়েন্টি কে ঘিরে কেমন প্রস্তুতিতে স্বাগতিকরা?
বাংলাদেশ দলের অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান বলছিলেন, “দেশের মাটিতে হোম কন্ডিশন, আর টিমে যারা আছে তারা ভালো পারফর্ম করেছে। স্বাভাবিকভাবেই সবাই কনফিডেন্ট । ইনশাল্লাহ ভাল হবে আশা করি। দল হিসেবে কেমন খেলবো সেটাই দেখার ব্যাপার হবে।”
২০১২ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে র আসরে বাংলাদেশ হেরেছিল নিউ জিল্যান্ড ও পাকিস্তানের কাছে। সেই সময়কালে এই সাকিবই ৮৪ রান করে টি-টোয়েন্টিতে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড গড়েছিলেন।
২০১৩ তে এসে মুশফিকুর রহিম দলের দায়িত্ব নেয়ার পর টেস্ট, ওয়ান ডে কিংবা টি-টোয়েন্টি – সব ফরম্যাটেই বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে ভালো করা শুরু করে।
টেস্ট ম্যাচের মতো টানা কয়েকদিন দর্শকদের বসে থাকতে হয়না টি-টোয়েন্টি ম্যাচে। তাই টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে আগ্রহ বেশি।
একই সাথে টি-টোয়েন্টি বিভিন্ন দেশসহ বাংলাদেশেও জনপ্রিয়তার বেশ ওপরের দিকে উঠে গেছে। দর্শকপ্রিয়তা তো আছেই, যারা ক্রিকেটেই জীবন গড়তে চান তাদের অনেকের স্বপ্নই এখন ভবিষ্যতে টি-টোয়েন্টির দিকে।
ধানমন্ডির আবাহনী মাঠে ক্রিকেট প্র্যাকটিস করছিলেন শতাধিক কিশোর তরুণ।
রাজধানীর নানা জায়গা থেকে তারা এখানে এসেছেন অনুশীলন করতে। কথা হলও তাদের বেশ কয়েকজনের সাথে।
তাদের অনেকেই বললেন স্বল্প সময়ে নিয়ে টি-টোয়েন্টি অনেক বেশি উত্তেজনা ছড়ায়, আর ক্ষণিকের সেই উত্তেজনা উপভোগ করেন দর্শক।
টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের খেলায় দুটি দল ১২০ টি করে ২৪০ টি বলের ওপর ভর করে জয় পরাজয় নির্ধারণ করে। কম সময়ে কে কত বেশি রান করবে, কে কত বেশি চার ছক্কা হাঁকাবে তার ওপর নির্ভর করে অনেক কিছু। আর টেস্ট ম্যাচে ক্রিজে টিকে থাকার লড়াইটাই হলও আসল।
কবিরুল ইসলাম জনি নামে এক কিশোর বললেন, টি-টোয়েন্টি নিয়েই এখন বেশির ভাগ মানুষ বেশি আগ্রহী এবং নতুন প্রজন্মের খেলোয়াড়রাও এতে অনেক আগ্রহ দেখাচ্ছে। তবে ক্ষণিকের উত্তেজনা টি-টোয়েন্টি ছড়ায় ঠিকই তবে ক্রিকেটে ভাল করতে হলে টি-টোয়েন্টি নয়, বরং জোড় দিতে হবে টেস্ট খেলার ওপরই।
আইসিসি টি-টোয়েন্টি প্রতিযোগিতা শুরু করার পর বিগত বছরগুলোতে এই ফর্মের ক্রিকেট এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে, যে অনেকেই মনে করেছেন বিশ ওভারের এই ম্যাচই হয়ত ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ হয়ে দাঁড়াবে। এমন ধারনার ভিত্তি শক্ত করেছে ভারতের আইপিএল এবং অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ।
বাংলাদেশেও টি-টোয়েন্টির রয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। কিন্তু তার মানে এই নয় যে বাংলাদেশ কিংবা বিশ্ব ক্রিকেটে ভবিষ্যৎ হয়ে দাঁড়াবে টি-টোয়েন্টি । কথা বলছিলাম বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি দলের অভিজ্ঞ স্পিন বোলার আব্দুর রাজ্জাকের সাথে।
টেস্ট ক্রিকেটের জায়গায় টেস্ট আর টি-টোয়েন্টির জায়গায় টি-টোয়েন্টি। টেস্টে যে এক্সসাইটমেন্ট ছিল, আমার মনে হয় তা আরও বেড়েছে এখন। তবে এটাও ঠিক যে টি-টোয়েন্টি হয়তো এখন অনেক জনপ্রিয় বলে মনে হচ্ছে এবং কভারেজ পাচ্ছে। তার মানে এই না যে এই ফরম্যাট টেস্ট বা ওয়ানডে কে পেছনে ফেলে দিচ্ছে।
অবশ্য অনেকেই বলে থাকেন ক্রিকেটের অনেক কিছু এখন অনেকটাই স্পন্সরদের হাতে। দর্শকপ্রিয়তা থাকায় অনেক স্পন্সরই টি-টোয়েন্টির দিকে বেশি ঝুঁকছেন। ফলে এক সময় হয়ত দেখা যাবে স্পন্সররা টেস্ট ম্যাচে হয়ত প্রাধান্য নাও দিতে পারেন। কেননা দিনের পর দিন বসে বসে টেস্ট দেখার সময় অনেকেরই নেই। আর টিভিগুলো একে খুব একটা প্রাধান্য দেবে না।
এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অন্যতম স্পন্সর কোমল পানীয় পেপসি। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা মোঃ আরিফ হোসেন। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম স্পন্সররা কি টি-টোয়েন্টি দিকে ঝুঁকছে?
জবাবে হোসেন বলছেন, তারা আইসিসির পার্টনার হিসেবে সব ফরম্যাটের ক্রিকেটকেই স্পন্সর করে থাকেন।
তিনি বলেন, “এটাও ঠিক যে টি-টোয়েন্টির জনপ্রিয়তা দিনের পর দিন বাড়ছে আর টেস্টের জনপ্রিয়তা কমছে আস্তে আস্তে। কেননা দিনের পর দিন বসে বসে টেস্ট দেখার সময় অনেকেরই নেই।”
তবে টেলিভিশন কোম্পানিগুলোরও নিজেদের স্বার্থ রয়েছে যা আসলে টেস্ট ক্রিকেটকে সমর্থনই করে।
ঢাকার ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজের ক্রীড়া সম্পাদক আজাদ মজুমদার বলছিলেন, তিনটা ফরম্যাটর মধ্যে ওয়ানডে ফরম্যাট ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারাচ্ছে। কিন্তু টেস্ট আমার ধারনা টিকে থাকবে এবং এর বড় কারণ হলও টেলিভিশন।
“পাঁচ দিনের টেস্ট যখন চলে তখন সেই কয়দিনের প্রোগ্রাম নিয়ে টিভির ভাবতে হয়না, বিজ্ঞাপন নিয়ে ভাবতে হয়না। সুতরাং সমস্যা হবেনা। আর সময়ের ধারায় যে বিবর্তন তা হয়তো এর জনপ্রিয়তাকে বাড়িয়ে দেবে,” বলছিলেন আজাদ মজুমদার।
এই প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে যাদের সাথে কথা হয়েছে তাদের মধ্যে একজনও বলেনি যে টি-টোয়েন্টি র প্রতাপে টেস্ট ক্রিকেট গুরুত্ব হারাবে।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক, ক্রিকেট বোর্ডের একজন পরিচালক এবং গেমস ডেভেলপমেন্ট কমিটির প্রধান খালেদ মাহমুদ সুজন।
তিনি বলছেন টেস্ট ক্রিকেটেই আসল ক্রিকেট, যদিও এখন টি-টোয়েন্টি বেশ ডমিনেট করছে। টি-টোয়েন্টি মানুষের ব্যস্ত জীবনে ভিন্ন রকমের স্বাদ দিচ্ছে, তবে একই সাথে বহু লোককে এই ফরম্যাট ক্রিকেটে আগ্রহী করে তোলায় এটি ক্রিকেটের জন্যই ভাল হচ্ছে। তবে আমাদের জন্য মুখ্য হচ্ছে টেস্ট। বাংলাদেশের জন্য এর কোনো বিকল্প নেই।
হাটি হাটি পা পা করে বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন যে অবস্থান বিশ্বে তৈরি করেছে এবং বিগত বছরগুলোতে যে নৈপুণ্য দেখিয়েছে, তাতে করে সহসাই বলা যাবেনা ক্রিকেট দুনিয়ার শীর্ষে যেতে বাংলাদেশের পথ বাকী নেই খুব একটা। একই সময়ে নতুন নতুন লড়াকু দল এসে যাচ্ছে ।
ক্রিকেটের ময়দানে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে যে আরও খানিকটা সময় লাগবে তাতে যেমন কোনো সন্দেহ নেই, তেমনি টেস্ট, ওয়ান ডে কিংবা টি-টোয়েন্টি সব ক্ষেত্রেই কৌশলী হবারও কোনো বিকল্প নেই।– বিবিসি।