৯৮ শতাংশ কমেছে ৩৩ বছরে আবাদ
স্বাধীনতার পর সবচেয়ে কম আখ চাষ হয়েছে চলতি বছরে। বিলুপ্তির পথে সাতক্ষীরায় আখ চাষ। ১৯৯০ সালে যেখানে জেলাতে আখ চাষ হয়েছিল ৫ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে সেখানে চলতি ২০২৩ মৌসুমে জেলাতে আখ চাষ হয়েছে মাত্র ১১৬ হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ ৩৩ বছরে আখের আবাদ কমেছে প্রায় ৯৮ ভাগ জমিতে। জলবায়ু পরিবর্তন, ভারতীয় চিনি আমদানি, উৎপাদন খরচ বেশি, নতুন করে চিনিকল গড়ে না উঠাসহ নানা কারণে সাতক্ষীরাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে আখের চাষ চরম আকারে হ্রাস পেয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠা এক ফসলী শস্যটি ভারতীয় আগ্রাসনের মুখে বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হতে চলেছে। কৃষকের কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে। আখ নির্ভর গবাদি পশু চরম খাদ্য সংকটের মধ্যে পড়েছে। পরিবেশে টিকতে না পেরে হালের বলদ কৃষকের কাছ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছে যেখান থেকে ভারতীয় চিনি আমদানি করা হচ্ছে সেখান থেকে বাংলাদেশে আখ চাষ কমে গেছে। ফলে কর্মসংস্থান হারিয়ে অসংখ্য কৃষক বেকার হয়েছে।
দুই দশক আগেও এ জেলাতে আখ চাষ হতো বাণিজ্যিকভাবে, সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে। তাদের হিসাব মতে, ১৯৯০ সালে সাতক্ষীরা জেলায় আখ চাষ হয়েছে ৫ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে। ২০০০ সালে আবাদ হয়েছে ৩ হাজার ৯৪৮ হেক্টর। এর পর ২০১০ সালে এ জেলায় আখের আবাদ হয়েছে মাত্র ১৪০ হেক্টর জমিতে। ২০২১ সালে জেলায় আখ চাষ হয়েছে মাত্র ১৩৫ হেক্টর জমিতে। ২০২৩ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে ১১৬ হেক্টরে। বাণিজ্যিকভাবে আখ চাষ করতে কম দেখা যাচ্ছে কৃষকদের। আশ্বিন-কার্তিক মাসে মন্দার সময়ে যারা আখ কেটে রস বিক্রয় করে সংসার চালাত তারাই বর্তমানে আখ চাষ করছে বলে জানা যায়।
এক সময়ের প্রায় ৯৮ শতাংশ অর্থকরী এই ফসলটি তিন দশকের ব্যবধানে উৎপাদন কমেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আখে ছত্রাক, ডগা পচা ও লালচে রোগসহ নানা প্রকার সংক্রামক দেখা দিচ্ছে। এসব কারণে আখ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বলে জানান কৃষক। তবে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, শুধু জলবায়ুজনিত কারণেই আখ চাষ কমছে না, আরও একটি কারণ হলো চিনিকল না থাকার পাশাপাশি ফসলটি এক বছর মেয়াদি হওয়ায় চাষিরা আখ চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
তালা উপজেলার খলিষখালি মঙ্গলানন্দকাটি গ্রামের সৈয়েদ মেখ জানান, তার গ্রামের ৭০-৮০ শতাংশ কৃষক দীর্ঘকাল ধরে আখ চাষ করত। তিনিও ৩০-৩৫ বছর আখ উৎপাদন করেছেন। কিন্তু গত ১০-১২ বছর ধরে তিনি আখ চাষ আর করছেন না। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ২০০০ সালের বন্যা, ২০০৭ সালে সিডর ও ২০০৯ আইলা, ২০২০ সালে আম্পান ও ২০২১ সালে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের পর থেকে আগের মতো আখের ফলন হয় না। ফসলি জমিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি আখ ক্ষেতে বিভিন্ন রোগবালাই দেখা দিচ্ছে। এসব রোগের কোনো প্রতিকার না পেয়ে ফসলটি চাষ করা বন্ধ করে দিয়েছেন বলে জানান তিনি। এছাড়া আখ চাষে এক বছর সময়ের প্রয়োজন হয়। এতে খরচ বেশি হয়ে যায়। অন্যদিকে চিনির দাম অনেক কম। তাই তারা আখ চাষে দিনের পর দিন আগ্রহ হারাতে থাকে।
সূত্রমতে, দেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১৮ লাখ মেট্রিক টন। এর বিপরীতে বিএসএফআইসির বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা মাত্র ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৮০ টন। কিন্তু চলতি মৌসুমে উৎপাদনক্ষমতার মাত্র ১৬ শতাংশ বা ২১ হাজার ৩১৩ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন করতে পেরেছে সংস্থাটি, যা মোট চাহিদার দেড় শতাংশের কম। গত এক দশকে সরকারি মিলগুলোতে চিনি উৎপাদন কমেছে প্রায় ৭৭ শতাংশ।
সরকারি চিনিকলগুলো অকার্যকর থাকায় দেশে চিনির চাহিদার প্রায় পুরোটাই আমদানির মাধ্যমে জোগান দেয় বেসরকারি কোম্পানিগুলো। এসব কোম্পানি অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে পরিশোধন করার পর বাজারে ছাড়ে। ফলে বাজারে চিনির দামের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণও থাকছে তাদের হাতে। অথচ ব্যাপক চাহিদার এ সময়েও বাজারে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না সরকারি চিনিকলগুলো। উল্টো এসব চিনিকলের উৎপাদন কমার পাশাপাশি লোকসানের পরিমাণ বেড়ে চলেছে।
জলবায়ু পরিবর্তন, চিনিকল না থাকা এবং ফসলটি এক বছর মেয়াদি হওয়ায় চাষিরা আগ্রহ হারাচ্ছেন আখ চাষে, জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোঃ সাইফুল ইসলাম জানান। যেখানে একই জমিতে বছরে তিনটি ফসল করতে পারে সেখানে এক বছর মেয়াদি আখ চাষ করতে চাচ্ছেন না কৃষকরা। তিনি জানান, মাঠপর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তারা রোগের প্রতিকারের জন্য কৃষকদের নানাভাবে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।