ক্যানসার হচ্ছে মানবদেহে মাছ-মুরগির বিষাক্ত খাবারে
মাছ ও মুরগি খেয়ে মানবদেহে বাসা বাঁধছে মরণব্যাধি ক্যানসার। অল্প সময়ে বড় করতে মাছ ও মুরগিকে খাওয়ানো হচ্ছে বিষাক্ত খাবার। অতি মুনাফার লোভে মাছ-মুরগির এই বিষাক্ত খাবার তৈরি ও বাজারজাত করছে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। চট্টগ্রামে এমন তিন শতাধিক কারখানা রয়েছে।
সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া এলাকায় অবস্থিত এ অ্যান্ড এ সু নামে একটি কারখানার পাশে নামবিহীন একটি গোডাউনে মাছ ও মুরগির জন্য বিষাক্ত খাবার তৈরির তথ্য মিলেছে। যা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর মাছ ও মুরগির বিপুল পরিমাণ খাবার কারখানা থেকে জব্দ করেছে চট্টগ্রাম জেলা গোয়েন্দা পুলিশ।
চট্টগ্রাম জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক নুর আহমদ মঙ্গলবার দুপুরে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়ায় নামবিহীন একটি গোডাউনে বিদেশ থেকে আমদানি করা মেয়াদোত্তীর্ণ হাজার হাজার বস্তা পোল্ট্রি ফিডকে অবৈধভাবে নতুন করে মোড়কজাত করা হচ্ছিল। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে রোববার সন্ধ্যা থেকে চট্টগ্রাম জেলা।
অনুসন্ধান শুরু হয় পুলিশের ওসি (ডিবি) কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে। শেষে সোমবার সকাল থেকে ওই গোডাউনে অভিযান পরিচালনা করে বিকাল পর্যন্ত তিন হাজার প্যাকেট পোল্ট্রি ফিড জব্দ করা হয়। ফিডগুলোর প্রতি প্যাকেটে ৫০ কেজি করে খাদ্য ছিল। প্রতি প্যাকেটের মূল্য ৬-৭ হাজার টাকা। সে হিসাবে জব্দ করা প্যাকেটগুলোর আনুমানিক মূল্য ২ কোটি টাকারও বেশি।
পুলিশের ওসি (ডিবি) কামরুজ্জামান বলেন, এসব ফিড মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়ায় নির্জনস্থানে মাটিতে পুঁতে ফেলার কথা। তা না করে দুষ্কৃতকারী চক্র অল্পমূল্যে কিনে তার সঙ্গে মেয়াদোত্তীর্ণ বিস্কুটের গুঁড়াসহ বিষাক্ত উপাদান মিশিয়ে সৌদি আরবের একটি কো¤পানির নতুন প্যাকেটে পুরে পুনরায় উচ্চমূল্যে বাজারজাত করছিল। শেষে আমরা সেগুলো জব্দ করেছি।
জেলা ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদীপ্ত সরকার জানান, মেয়াদোত্তীর্ণ খাবারগুলো প্রচ- দুর্গন্ধযুক্ত ও বিষাক্ত খাদ্যে পরিণত হয়। অভিযানকালে দুর্গন্ধে প্যাকেটের কাছে দাঁড়ানোই মুশকিল হয়ে যায়। প্রাথমিকভাবে এ ঘটনায় জড়িত হিসেবে মোহাম্মদ ইলিয়াছসহ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। নামগুলো যাচাই করে দেখা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরে বিভিন্ন সময়ে মেয়াদোত্তীর্ণ খাবারসহ নানা সামগ্রী পরিত্যক্ত ঘোষণা করে বর্জ্য হিসেবে টেন্ডার দেওয়া হয়। টেন্ডার যারা নেন তাদের মধ্যে অনেকেই মেয়াদোত্তীর্ণ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যসামগ্রী প্যাকেটজাত করে বাজারে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে থাকেন। এর মধ্যে মানুষ ও পশুপাখির খাদ্যও রয়েছে, যা বাঁশবাড়িয়া এলাকার এ গুদামে পোল্ট্রি ফিড হিসেবে প্যাকেটজাত করা হচ্ছে।
অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া জেলা ডিবির ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক মো. কামরুজ্জামান বলেন, বিশাল আয়তনের গোডাউনের দুটি কক্ষে স্যাঁতস্যাঁতে, দূষিত পরিবেশে স্তূপ করা ছিল শত শত বস্তা ভেজাল খাদ্য, মুরগির বিষ্ঠা, পচা বেকারি পণ্য, কাফকোর ইউরিয়া সার। কারখানার কোনো অংশে পচা খাদ্য খাচ্ছে কাক, শালিকসহ পশুপাখি। আবার কোনো অংশে খাদ্যের বস্তার ওপরে মৃত ইঁদুর ও তেলাপোকা ছিল, মেয়াদোত্তীর্ণ পচা বেকারি পণ্যে পিঁপড়া, মশা-মাছি ও পোকামাকড়ের উপদ্রব দেখা যায়। এসব বস্তা পচেগলে দুর্গন্ধ আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়াও কারখানাটির বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য পাশের ফসলি জমি ও মৎস্য চাষের একটি পুকুরে গিয়ে পড়তে দেখা গেছে। এতে পুরো এলাকার পরিবেশ দূষিত হয়ে পড়েছে।
কামরুজ্জামান আরও বলেন, কারখানাটির বিএসটিআই, পরিবেশ অধিদফতর কিংবা অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দফতরের কোনো অনুমতি নেই। আমরা জব্দ মালামালের তালিকা করে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি এবং কারখানাটির সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। কোনো বৈধ কাগজপত্রও নেই।
চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. রৌশন আক্তারের মতে, দেশে মাছ ও মুরগির খাবারে মিশ্রিত থাকে নানা রকম রাসায়নিক উপাদান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-হেভিমেটাল। এর কারণে এসব খাবার খেয়ে দ্রুত বড় হয় ফার্মের মুরগি, বাড়ে ওজনও। এসব খাবারে লুকিয়ে আছে মরণঘাতী ব্যাকটেরিয়াসহ মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর মারাত্মক জীবাণু, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সহজ নয়। বাজারে বিক্রি হওয়া হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য খাওয়ানো মুরগি কেটে এর রক্ত, মাংস, হাড়, কলিজা, মগজ ও চামড়া আলাদাভাবে পরীক্ষা করে আঁতকে উঠেছেন গবেষকরা।
তিনি বলেন, দুই দফায় এক মাস করে খাদ্য খাওয়ানোর পরে পরীক্ষা করে যে ফলাফল পাওয়া গেছে তা রীতিমতো ভয়ংকর। এসব মুরগির মাথার মগজে সর্বোচ্চ পরিমাণ ক্রোমিয়াম পাওয়া যায়। ক্রোমিয়াম হলোÑএক ধরনের ভারী ধাতু, মানবদেহে যার সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা হলো প্রতিদিন ২৫ পিপিএম বা মাইক্রোগ্রাম।
কিন্তু পরীক্ষায় এক মাস খাদ্য খাওয়া মুরগির মগজে পাওয়া যায় ৭৯৯ পিপিএম এবং দুই মাস খাদ্য খাওয়া মুরগির মগজে (প্রতি কেজিতে) পাওয়া যায় চার হাজার ৫৬১ পিপিএম। এ ছাড়া মাংসে যথাক্রমে ২৪৪ ও ৩৪৪, চামড়ায় ৫৫৭ ও ৩২৮, হাড়ে এক হাজার ১১ ও এক হাজার ৯৯০, কলিজা বা লিভারে ৫৭০ ও ৬১১ এবং রক্তে ৭১৮ ও ৭৯২ পিপিএম ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে। এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, এ মাত্রা মানবদেহের জন্য অসহনীয়। এমন বিপজ্জনক মাত্রার হেভিমেটালযুক্ত মাছ বা মুরগির মাংস কিংবা ডিম খেয়ে দেশের মানুষ এমন পর্যায়ে রয়েছে, যাকে বলা যায় বিষাক্ত পুষ্টি।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, মাছ ও মুরগির খাদ্যে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক উপাদান ব্যবহার করা হলে আমাদের জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকিতে পড়বে। এসব খাদ্য খেয়ে বেড়ে ওঠা মাছ ও মুরগির মাংস, ডিম খেয়ে মানুষ হৃদরোগ, লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারে। এ ছাড়াও পেটের অসুখ, কিডনি, পাকস্থলীর নানারকম রোগ দেহে বাসা বাঁধতে পারে। যেগুলো মানুষকে একসময় মৃত্যুর দিকে ধাবিত করবে।
ফিশ ও পোল্ট্রি খাদ্যে ইউরিয়া সারের ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মানবদেহে এমনিতেই ইউরিয়া থাকে। কিন্তু বেশি মাত্রায় ইউরিয়ার কারণে লিভার, কিডনি থেকে পাকস্থলী সর্বত্র প্রভাব পড়ে। দেখা দেয় নানা উপসর্গ। যেমন তলপেটে যন্ত্রণা, দুর্বলতা, পেশিতে টান ইত্যাদি।
Posted in: জাতীয়