দোষী সাব্যস্ত ডনাল্ড ট্রাম্প //এ যেন নতুন মাইল-ফলক
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এ যেন নতুন মাইলফলক। এই প্রথম সাবেক বা বর্তমান কোনো প্রেসিডেন্টের মধ্যে ক্রাইম বা ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। বৃহস্পতিবার নিউ ইয়র্কের আদালত তার বিরুদ্ধে আনা ৩৪টি অভিযোগের সবটাতে ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। এর মধ্যে আছে সাবেক পর্নো তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের কাহিনী ধামাচাপা দেয়ার জন্য তার মুখ বন্ধ করার জন্য হাস মানি হিসেবে এক লাখ ৩০ হাজার ডলার দেয়া। আছে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে যে রেকর্ড থাকে, তাতে মিথ্যা তথ্য দেয়া। তার বিরুদ্ধে আদালত আগামী ১১ই জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে রায় ঘোষণা করবেন। এতে তার জেলও হতে পারে। তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পকে খুব সম্ভবত জরিমানা করা হতে পারে। বৃহস্পতিবার এই রায়কে লজ্জাজনক বলে অভিহিত করেছেন। তার বিরুদ্ধে আদালতে রায় দেয়ার কারণে বিচারক হুয়ান মারচানকে আক্রমণ করে বক্তব্য দিয়েছেন।
আগামী ৫ই নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। তাতে রিপাবলিকান দলের হয়ে লড়াই করার কথা ট্রাম্পের। কিন্তু তিনি ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার পর নির্বাচন করতে পারবেন কিনা তাও স্পষ্ট নয়। তিনি ওই নির্বাচনে বর্তমান ডেমোক্রেট দল থেকে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে পরাজিত করতে চান। ওদিকে তাকে দোষী সাব্যস্ত করার ফলে তার সমর্থকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। কোনো কোনো মহল ‘ওয়ার’ বা যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কেউ কেউ এক্সের পোস্টে সিভিল ওয়ার বা গৃহযুদ্ধের ডাক দিয়েছেন। এই রায় নিয়ে এখন শুধু মার্কিন মুলুকেই নয়, সারা দুনিয়ায় আলোচিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা পেরিয়ে তা এখন সব মানুষের মুখে মুখে। নির্বাচনকে সামনে রেখে এই রায় মার্কিন রাজনীতিকে কোন দিকে নিয়ে যায়- তা এখন দেখার বিষয়। আদালত ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করার পর তার আইনজীবীরা এর বিরুদ্ধে আপিল করার ঘোষণা দিয়েছেন।
আদালত ২২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করেন ৬ সপ্তাহ ধরে । এর মধ্যে আছেন পর্নো তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলস। সাক্ষ্য দেয়ার সময় তিনি ট্রাম্প তার সঙ্গে কীভাবে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন তার সবিস্তারে বর্ণনা দেন। এতটাই খোলামেলা ছিল সেই বর্ণনা যে, বার বার বিচারক তাকে থামিয়ে দিতে বাধ্য হন। তার অভিযোগ ২০০৬ সালে একটি হোটেলকক্ষে ট্রাম্প তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। এরপর ২০১৬ সালে প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হন। এর আগে স্টর্মি ড্যানিয়েলসের সঙ্গে সম্পর্কের কথা যাতে কেউ জানতে না পারে, সেজন্য অর্থ দিয়ে তার মুখ বন্ধ করান তিনি। নিজের তখনকার আইনজীবী মাইকেল কোহেনকে দিয়ে এই অর্থ পরিশোধ করেন। মাইকেল কোহেনও আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার সময় এ কথা স্বীকার করেছেন অকপটে। তিনি বলেছেন, ট্রাম্প চাইছিলেন স্টর্মি ড্যানিয়েলসের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা যেন কেউ জানতে না পারে। বিশেষ করে এ কথা প্রকাশ হলে তার সন্তানদের মধ্যে একটি বাজে ধারণা সৃষ্টি হবে। আর নির্বাচনী প্রচারণায় একটি খারাপ প্রভাব পড়বে। এসব অভিযোগ নিয়ে দুইদিন ধরে সর্বসম্মত একটি সিদ্ধান্তে আসেন ১২ জন জুরি। অবশেষে বৃহস্পতিবার ওই তাকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেন। তবে শাস্তি কী হবে তা ঘোষণা করা হবে ১১ই জুলাই। ট্রাম্প টিমের শীর্ষ আইনজীবী উইল শার্ফ বলেছেন, তারা এই রায়ের বিরুদ্ধে সব রকম আপিলের বিষয় বিবেচনা করছেন। দ্রুততার সঙ্গে এই আপিল করা হবে। ট্রাম্প টিমের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ আইনজীবী টড ব্লাঞ্চে বলেছেন, আমার মক্কেল সুষ্ঠু বিচার পাননি। এক বছরের বেশি সময় ধরে আমরা বলে আসছি যে, ম্যানহাটনে আমরা সুষ্ঠু বিচার পাবো না। বিচারক আমাদের সুষ্ঠু বিচার দেবেন না। তিনি আরও বলেন, ডনাল্ড ট্রাম্পের জীবনের মিশনকে ধ্বংস করে দিয়েছেন তার সাবেক আইনজীবী মাইকেল কোহেন। এই মামলায় এমন কিছু সাক্ষী আছেন, যাদের সাক্ষ্য নেয়া উচিত হয়নি।
ওদিকে ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করায় মাইকেল কোহেন বলেছেন, তিনি স্বস্তি পেয়েছেন। তবে বিস্মিত হননি। দিনশেষে সত্য বিজয়ী হয়েছে। এটাই জবাবদিহিতা। যুক্তরাষ্ট্রে ঠিক এই মুহূর্তে প্রকৃতপক্ষে এটাই প্রয়োজন। বৃহস্পতিবারের আগে, মাইকেল কোহেনই একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন, যাকে হাস মানি মামলায় অভিযুক্ত করার কথা ছিল। মামলায় সাক্ষ্য দেয়ার সময় মাইকেল কোহেনকে ট্রাম্পের আইনজীবী টড ব্লাঞ্চে ‘গোট’ বা ছাগল বলে অভিহিত করেন। বলেন, সর্বকালের সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী তিনি। কিন্তু উপযুক্ত সময়ে তার জবাব দিয়েছেন মাইকেল কোহেন। তিনি টড ব্লাঞ্চেকে ‘স্লোট’ বলে অভিহিত করেন। বলেন, তিনি হলেন সর্বকালের মধ্যে সবচেয়ে স্টুপিড আইনজীবী।
ম্যানহাটনের সাবেক প্রসিকিউটর ডানকান লেভিন বলেছেন, প্রশাসনের আইনি বিষয়ে এই রায় এক বিশাল বিজয়। তিনি আরও বলেন, ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির অফিস এই মামলার মধ্য দিয়ে সবকিছু তুলে ধরেছেন। তারা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সন্দেহাতীত তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। তারা প্রমাণ করেছেন যে, ট্রাম্প সত্যি ওই পর্নো তারকার মুখ বন্ধ করতে অর্থ দিয়েছিলেন। তিনি সত্যকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এই মামলা শুধু একজন ব্যক্তির সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে চলেনি। একই সঙ্গে তার ই-মেইল, টেক্সট মেসেজ এবং ফোন রেকর্ড একত্রিত করে তথ্য-প্রমাণ দেয়া হয়েছে। যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করেছে প্রসিকিউশন। জুরিরাও এক্ষেত্রে উপযুক্ত মনোযোগ দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, আইনি প্রশাসনকে খর্ব করতে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতার সবকিছুই ব্যবহার করেছেন। তাকে দশবার আদালত অবমাননার জন্য দায়ী করা হয়েছে। এখন আদালত তাকে সুষ্ঠু বিচার দেবে- এটাই প্রত্যাশা।