বিপদে পিএসসি, বিসিএস পরীক্ষায় উত্তর সিরিয়ালি না লেখায়
লিখিত পরীক্ষাকে ধরা হয় বিসিএসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এখানে ভালো করা মানেই ক্যাডারের পাশাপাশি নন–ক্যাডারেও একটি চাকরি অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যাওয়া। আর এই লিখিত পরীক্ষা দেওয়া থেকে শুরু করে খাতা দেখা পর্যন্ত বেশ সময় লাগে। সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সময় নিয়ে খাতা দেখে লিখিত পরীক্ষার। কিন্তু খাতা দেখতে দেরি হওয়ার কারণে ফল দিতেও দেরি হয়। কেন দেরি হয় এই লিখিত পরীক্ষার খাতা দেখতে। কী কী কারণে দেরি হয়। কীভাবে এটি দূর করা যায়, এমন নানা বিষয় নিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালাচ্ছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। উদ্দেশ্য বিসিএসের সময় কমিয়ে আনা।
সম্প্রতি পিএসসি বেশ কিছু সভায় লিখিত পরীক্ষার খাতা দেখেতে দেরি হওয়ার কারণ সম্পর্কে পরীক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করেন। এগোতে একটি বিষয়ে জোর দেন পরীক্ষকেরা। আর সেটি হলো, চাকরিপ্রার্থীরা লিখিত পরীক্ষায় যে উত্তর লেখেন, তা সিরিয়ালি না থাকায় পরীক্ষককে বেগ পোহাতে হয়। যেমন কোনো পরীক্ষার্থী সবার আগে মাঝের কোনো প্রশ্নের উত্তর লিখলেন। এ সময় পরীক্ষককে মাঝের প্রশ্নে চলে গিয়ে প্রশ্ন কী, এর উত্তর কতটা প্রাসঙ্গিক লেখা হয়েছে, তা যাচাই করে উত্তর মিলিয়ে নম্বর দিতে হয়। আবার ওই পরীক্ষার্থী যদি লেখেন শেষের দিকের কোনো প্রশ্নের উত্তর, তখন একইভাবে পরীক্ষককে সেই প্রশ্নে যেতে হয়। এভাবে সিরিয়াল ব্রেক করার কারণে পরীক্ষকদেরও সিরিয়াল ব্রেক করে প্রশ্ন দেখে খাতা মূল্যায়ন করতে হয়।
পরীক্ষকেরা মনে করেন, যদি পরীক্ষার্থীরা সিরিয়াল ব্রেক না করে সিরিয়ালি সব প্রশ্নের উত্তর লিখতেন, তাহলে খাতা দেখতে সুবিধা হতো। সিরিয়াল ব্রেক করায় আমাদের পরীক্ষার্থীর লেখা সিরিয়ালের সঙ্গে সঙ্গে চলতে হয়। খাতা দেখতে দেরি হওয়ার এটি অন্যতম একটি কারণ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিএসসির এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘পরীক্ষার্থীরা সিরিয়ালি না লেখায় পরীক্ষকদের মনোযোগ বা কাজের ধরন বদলাতে হয়। সেভাবে খাতা দেখতে সময় বেশি লাগে। পরীক্ষার্থীদের তো আর কোনটি আগে কোনটি পরে লিখবে, তাতে বাধ্য করা যায় না। তবে তাঁরা যেন সিরিয়ালি লেখেন, সেই আহ্বান থাকবে। আসন্ন ৪৬তম বিসিএস থেকেই যাতে তাঁরা লিখিত পরীক্ষার খাতায় প্রশ্নের উত্তর সিরিয়ালি লেখেন, সেটি আমরা ঘোষণা আকারে দিতে পারি নির্দেশনায়। তবে বাধ্যবাধকতা থাকবে না। আমরা শুধু বলতে পারি, সিরিয়ালি লিখলে আমাদের পরীক্ষকদের দেখতে সুবিধা হয়। সময় কম লাগে। তবে ৪৭তম বিসিএস থেকে প্রশ্নের নিচেই উত্তর লেখার জায়গা নির্দিষ্ট থাকবে। তখন আর চাইলেও সিরিয়াল ব্রেক করা যাবে না।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পিএসসি চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, ‘প্রতিনিয়ত আমরা সংস্কারের মধ্য দিয়েই যাচ্ছি। নানা বিষয়ে পরিকল্পনা চলছে। কিছু কিছু প্রয়োগ করে ভালো ফল মিলছে। চাকরিপ্রার্থীবান্ধব পিএসসি গড়ার জন্য আমাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’
পিএসসির এক সাবেক পরীক্ষক (ক্যাডার) বলেন, গত পাঁচটি বিসিএসের ফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিসিএসে ফল প্রকাশের প্রধান বাধা হচ্ছে লিখিত পরীক্ষার খাতা দেখা। গড়ে এক বছরের মতো সময় লেগে গেছে এই খাতা দেখতে। কেননা, এই খাতা দেখেন প্রধানত দুই পরীক্ষক। আবার তাঁদের নম্বরে ২০ শতাংশ বা এর বেশি পার্থক্য হলে সেসব খাতা চলে যায় তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে। তিনি সব দেখে নম্বর চূড়ান্ত করেন। সেখানেও অনেক সময়ের বিষয়। পরীক্ষকের খাতা জমা দেওয়ার বেঁধে দেওয়া সময়ও তাঁরা খাতা দেন না। দিচ্ছি, দেব করে দেন না। ফোন ধরেন না। খাতা না দেখেই বিদেশে চলে যান। ভুলেও যান খাতা দেখতে দেওয়ার কথা। দেখলেও দায়সারা করে দেখেন। সব মিলে এই লিখিত পরীক্ষার ফল দিতে অনেক সময় লাগে পিএসসির।
পিএসসির একটি সূত্র জানায়, ৪১তম বিসিএসের ফল প্রকাশ দেরি হওয়ার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে পিএসসি। ফল দিতে দেরির কারণ হিসেবে তদন্ত কমিটি ৩১৮ পরীক্ষকের গাফিলতি বা দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পায়। পরীক্ষকদের এমন অবহেলা কীভাবে কমানো যায়, সে জন্য তদন্ত কমিটি বেশ কিছু সুপারিশ করে। সেই সুপারিশের অংশ হিসেবে পিএসসি বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করে। পিএসসির নানা উদ্যোগের কারণে তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে খাতা যাওয়ার হার কমেছে। ৪১তম বিসিএসে ১৫ হাজার, ৪৩তম বিসিএসে ১০ হাজার ও ৪৪তম বিসিএসে ৯ হাজারের কিছু বেশি খাতা তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে যায়। এতে দেখা যাচ্ছে, তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে খাতা যাওয়ার হার কমেছে। তবে তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে খাতা যাওয়াকে বিসিএসের ফল দেরির অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এসব কারণ থেকেই খাতা দেখতে দেরির কারণগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে। সেখানেই সিরিয়ালি উত্তর না লেখাকে খাতা দেখতে দেরি হওয়ার একটি অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।