৩৮ বিদেশি ফল আমদানির খরচ ১৬ হাজার কোটি টাকা, বেশি আসে মাল্টা
বেশি আসে মাল্টা
শুল্ক–কর ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিদেশি ফলের দামও বাড়ছে। তবে ডলার–সংকটের কারণে ফল আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপে কমেছে আমদানি। আমদানি কমলেও বাড়তি দামের কারণে ক্রেতাদের খরচ বেড়েছে ফল কেনায়।
দুই বছর ধরে বিদেশি ফলের দাম বাড়তি। দাম বাড়তে থাকায় আপেল, মাল্টা ও কমলার মতো বিদেশি ফল খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন ক্রেতারা। এতে ধারাবাহিকভাবে বিদেশি ফল আমদানি কমেছে। দেশের মানুষ বিদেশি ফল খাওয়া কমিয়ে দিলেও এ বাবদ ক্রেতাদের খরচ বেড়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশি ফল আমদানি ১০ হাজার টন কমেছে। গত অর্থবছরে ফল আমদানি হয়েছে ৫ লাখ ৮৯ হাজার টন বা প্রায় ৬০ কোটি কেজি। ফলভেদে খুচরা গড় মূল্য হিসাবে এসব ফল কিনতে ক্রেতাদের খরচ হয়েছে ন্যূনতম ১৬ হাজার কোটি টাকা।
আমদানি করা ফলের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিদেশ থেকে ৩৮ ধরনের ফল আমদানি করা হয়। এর মধ্যে আমদানির ৯৫ শতাংশই আপেল, মাল্টা, কমলা, আঙুর ও আনার। বাকি ৫ শতাংশ ফলের মধ্যে রয়েছে নাসপাতি, কিনুই, কতবেল, অ্যাভোকাডো, রাম্বুটান, কিউই ইত্যাদি।
আমদানি কম, খরচ বেশি
বিদেশি ফলের দাম বাড়তে শুরু করে মূলত ২০২২ সালের জুন-জুলাই থেকে। ডলার–সংকটের কারণে আমদানি নিরুৎসাহিত করতে বিদেশি ফলের শুল্ক–কর বৃদ্ধি ও ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যাওয়ায় আমদানি খরচও বেড়ে যায়। এর বিপরীতে কমেছে চাহিদা। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশি ফল আমদানি হয় ৮ লাখ ২২ হাজার টন। সেখানে গত দুই অর্থবছরে আমদানি ২ লাখ ৩৩ হাজার টন বা ২৮ শতাংশ কমেছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাজারে ফলের দামও বেড়েছে। এতে চাহিদা কমে গেছে। কৃষিবিদেরা বলছেন, দেশে এখন ফলের উৎপাদন বাড়ছে। বিদেশি অনেক ফলেরও আবাদ হচ্ছে। ফল আমদানিতে এর প্রভাব পড়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মেহেদি মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, দেশে এক দশক আগে বছরে এক কোটি টন ফল উৎপাদিত হতো, যা এখন বেড়ে হয়েছে দেড় কোটি টন। প্রতি একরে ফলন ও আবাদ দুটোই বেড়েছে। আবার পেয়ারা, বরইসহ দেশে উৎপাদিত কিছু ফল বছরজুড়েই বাজারে পাওয়া যায়। এসব কারণে বিদেশি ফলের চাহিদা কিছুটা কমেছে।
এদিকে আমদানির পরিমাণ কমলেও আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। শুল্ক–কর ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এ খরচ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। দুই বছর আগে বিদেশি ফল আমদানিতে শুল্ক–কর ছিল ৮৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। ২০২২ সালের মে মাসে বিদেশি ফল আমদানিতে ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করে এনবিআর। তাতে সব মিলিয়ে ফল আমদানিতে শুল্ক–কর বেড়ে দাঁড়ায় ১১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকার ফল আমদানিতে সরকারকে রাজস্ব দিতে হবে ১১৩ টাকা ৮০ পয়সা।
আবার ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যাওয়ায় শুল্ক–কর ও আমদানি মূল্যও বেড়েছে। যেমন প্রতি কেজি আপেল আমদানিতে ২০২১-২২ অর্থবছরে শুল্ক–কর ছিল প্রায় ৩৯ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫২ টাকায়। সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে প্রতি কেজি আপেল আমদানিতে শুল্ক–কর দাঁড়ায় ৮৮ টাকা।
ক্রেতাদের খরচ ১৬ হাজার কোটি টাকা
আমদানি খরচ ও শুল্ক–কর বৃদ্ধি দিন শেষে যুক্ত হয় পণ্যের দামে। আর পরিশোধ করতে হয় ভোক্তাদের। এর মধ্যে ক্রেতাদের সবচেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে আপেল কেনায়। গত অর্থবছরে আপেল আমদানি করা হয়েছে ১ লাখ ৬৯ হাজার টন। প্রতি কেজি আপেলের গড় বিক্রয়মূল্য ছিল ২৮০ থেকে ৩২০ টাকা। এই হিসাবে আপেল কেনায় ক্রেতাদের খরচ হয়েছে ন্যূনতম ৪ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা।
একই সময়ে দেশে মাল্টা আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার টন। আমদানি করা এসব মাল্টার প্রতি কেজির গড় বিক্রয়মূল্য ছিল ২৪০–২৫০ টাকা। ২৪০ টাকা কেজি হিসাবে আমদানি করা মাল্টা কিনতে ভোক্তাদের খরচ হয়েছে ৪ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা।
এনবিআরের হিসাবে, বিদায়ী অর্থবছরে দেশে আঙুর আমদানি করা হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার টন। প্রতি কেজি আঙুরের গড় বিক্রয়মূল্য ছিল ৩০০ টাকা। তাতে আমদানি হওয়া ১ লাখ ২০ হাজার টন আঙুর কিনতে ক্রেতাদের খরচ হয় ৩ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা।
একইভাবে আমদানি হওয়া ৬৯ হাজার টন কমলা কিনতে ক্রেতাদের খরচ হয়েছে (প্রতি কেজির গড় দাম ২৫০ টাকা) ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। একইভাবে আনারে ১ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা, নাসপাতি, কিনুইসহ অন্যান্য বিদেশি ফল কিনতে খরচ হয় ৭০০ কোটি টাকার বেশি। সবমিলিয়ে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে আমদানি হওয়া ফল কেনায় সব মিলিয়ে ক্রেতাদের খরচ হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা।
এনবিআরের হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ফল আমদানি হয়েছিল ৫ লাখ ৯৯ হাজার টন। খুচরা বাজারে গড় বাজারদর হিসাবে ওই বছর আমদানি করা এসব ফল কিনতে ক্রেতারা খরচ করেছেন ন্যূনতম ১৪ হাজার কোটি টাকা।
আমদানির উৎস কমছে
চার-পাঁচ বছর আগেও ৩৫টি দেশ থেকে ফল আমদানি করা হতো। এখন আমদানি করা হয় ২২টি দেশ থেকে। গত কয়েক বছরে জাহাজভাড়া বেড়ে যাওয়ায় আমদানিকারকেরা কাছাকাছি উৎস থেকেই ফল আমদানিতে ঝুঁকেছেন। এতে ফল আমদানির উৎস দেশের সংখ্যা কমে গেছে। গত অর্থবছরে সব মিলিয়ে ২২টি দেশ থেকে ফল আমদানি করা হলেও সিংহভাগ এসেছে মূলত চীন ও ভারত থেকে।
এনবিআরের হিসাবে, বিদায়ী অর্থবছরে চীন থেকেই আমদানি হয়েছে ২ লাখ টন ফল, যা মোট আমদানির ৩৪ শতাংশ। চীন থেকে আপেল, কমলা, আঙুর ও নাসপাতি—চারটি ফল বেশি আমদানি হয়েছে। আর গত অর্থবছর ভারত থেকে আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৯২ হাজার টন, যা মোট আমদানির প্রায় ৩৩ শতাংশ। ভারত থেকে মাল্টা, আঙুর ও আনার বেশি আমদানি হয়েছে।
ফল আমদানির তৃতীয় উৎস দেশ আফ্রিকা। বিদায়ী অর্থবছরে দেশটি থেকে ফল আমদানি হয়েছে ৯৭ হাজার ৬৬২ টন। আফ্রিকা থেকে মাল্টা, কমলা ও আপেল বেশি আমদানি হয়েছে। ফল মিসর, থাইল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসছে নানা ধরনের বৈচিত্র্যময় ফল।
এনবিআরের হিসাবে, বিদেশি ফল আমদানিতে গত অর্থবছর ৩০ কোটি মার্কিন ডলার খরচ হয়েছে। প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ১১৭ টাকা ধরে বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। আর জাহাজভাড়া, বিমাসহ সব মিলিয়ে এ খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকায়। ফল আমদানি থেকে সরকার রাজস্ব আদায় করেছে ৫ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দেশে ফল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৬২২টি। আর পাইকারি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান আছে ন্যূনতম ১০ হাজার। এর বাইরে ফুটপাত থেকে শুরু করে ছোট-বড় কমবেশি ২০ লাখ স্থায়ী-অস্থায়ী দোকানে ফল বেচাকেনা হয়। এতে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। শুল্ক–কর ও ডলারের দাম বেড়ে যেভাবে আমদানি খরচ বেড়েছে, তাতে সাময়িকভাবে লেনদেন বাড়লেও খাতটি ঘিরে সামনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির সম্ভাবনা কম।